এক স্বার্থপর মেয়ের আত্মকথা ( তৃতীয় পর্ব )

  • রীপা চক্রবর্তী
  • মার্চ ৪, ২০১৮

"গুরুজি বলেছেন, তোমার আসন্ন কন্যা তোমার দুর্ভাগ্য আর অসম্মানের কারণ হবে। আমাদের বংশমর্যাদার বিপরীতে থাকবে ও। " "মা,তুমি ভালো করেই জানো আমি এসব মানিনা। এই যুগে এসবের কোন ভিত্তি নেই। আমাদের পিতা-মাতা হওয়ার সৌভাগ্য দিয়েছেন ভগবান আবার। খুব শীঘ্রই   তোমার বউমা-ও সুস্থ হয়ে উঠবে। আর কন্যা সন্তান সব সংসারের জন্যেই লক্ষ্মীস্বরুপ। তুমি নিজে একজন মেয়ে হয়ে,মা হয়ে এমন বলছো?""কমল,তুমি ভালো করেই জানো আমাদের বংশমর্যাদার ধারাবাহিকতা এই মেয়েকে দিয়ে রক্ষা হবেনা।!!আমি ঠাকুরের কাছে তোমার পুত্র হোক,আমার বংশের প্রদীপ আসুক এই মানসা করেছি। সেইমতো দীপাকে গুরুজির আশির্বাদ ও মন্ত্রপুত: প্রসাদ আর ঔষধ দিয়েছি কারণ তিনি আমাদের কূলগুরু!!""মা,বুঝতে চেষ্টা করো। আমি নিজে ডাক্তার হয়ে এসব মানতে পারবোনা। কারণ,দীপা গুরুজির প্রসাদে নয় বরং আমার দেয়া হরমোনের ঔষধের জন্যে আবার কনসিভ করেছে। আর ওকে সুস্থ করার জন্যে আর কোন উপায়েও ছিলোনা। আর সন্তান ছেলে না মেয়ে হবে এটা ভগবান-ই ভালো জানেন। তিনি-ই সর্বজান্তা,সবার মঙ্গলকর্তা। "

"দেখো বাবা,আমার চুল এভাবেই সাদা হয়নি। আমি জানি অনেক আগে থেকেই,বিয়ে দিলেই ছেলে পর হয়ে যায়। ভুলে যেয়োনা দীপাকে আমি-ই পছন্দ করে নিয়ে এসেছিলাম। কিন্তু গুরুজি না বল্লে জানতেই পারতাম না আমরা কেউ যে ওর কুষ্ঠি -তে এতো দোষ! তবুও আমরা ওকে দায়ী করিনি। এত বড় ঘটনার পর ভেবেছিলাম ও বদলাবে নিজেকে। আধুনিক মতধারা ভুলে সঠিক পথে,ধর্মের পথে আসবে। কিন্তু কি পেয়েছি এখন পর্যন্ত?!!!""মা,আমাকে বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দিন। আমি আর এই সংসারে থাকবোনা। অনেক হয়েছে!!!আপনার ছেলের-ই ক্ষমতা নেই আমাকে পুত্র সন্তান দেয়ার। কিন্তু আপনি শুরু থেকে এখন পর্যন্ত আমাকেই দোষ দিচ্ছেন,কেন?""চুপ কর দীপা। " ধমকে উঠলেন বাবা। "কেন চুপ করবো?ভুল কিছু কি বলেছি?পুত্রসন্তান কি আমি চাইনি?ভগবান না দিলে আমি কি করবো?""দেখেছো কমল,তোমার বউ কেমন সম্মান দেয় আর মানে আমাদের?গুরুজি কি একটা কথাও ভুল বলেছেন তাহলে?তুমি আজ-ই আলাদা করে দাও সবকিছু.আমার এখনো এত দূর্দিন আসেনি যে তোমাদের মুখ-ঝামটা শুনবো!আমার জন্মের কয়েকদিন আগের ঘটনা এগুলো !!!আপনারা-ই বলুন, এতে আমার কি দোষ ছিল?
আমার জন্ম কি তবে পিতৃ-মাতৃ ঋণ শোধ করতে হয়নি?অবশ্যই আমার জন্ম সেজন্যেই হয়েছে। তাই জ্ঞান হবার পর থেকে আজ অবধি তাদের কথা ফেলতে পারিনা আমি,সইতে পারিনা তাদের কষ্ট। 

কিন্তু তারপরো আমি পিতৃ-মাতৃকূলের বদনাম আর অযোগ্য সন্তান। কারণ আমি ছেলে নই,কারণ আমি ছেলেদের মত হতে চেয়েছি, কারণ আমি নারী-পুরুষের সমতায় বিশ্বাসী,কারণ আমি জীবনে অনেক বড় হতে চেয়েছি,কারণ আমি চাকুরী করতে চেয়েছি,শিক্ষিত হতে চেয়েছি আমি আজ এতদুর এসেছি শুধুমাত্র নিজের অদম্য ইচ্ছায়। কিন্তু এর জন্যে আমাকে অনেক পূর্বেই নিজের সতীত্ত্ব পর্যন্ত বিসর্জন দিতে হয়েছে। অবাক হলেন?ভাবছেন উপরে উঠার নেশায় মত্ত আমি যৌবনকে নিজের হাতিয়ার করেছি!!!আর এদিকে সবদোষ পরিবারের উপর দিয়ে নিজেকে সাধু প্রমাণ করতে চাইছি?জানেন,সর্বপ্রথম কে আমার ছোট্ট শরীরটাকে ভোগ করেছিল?...আমার আপন ছোট মামা!!!!মাত্র ৮বছর বয়স ছিল আমার তখন। "শুরু হলো হৃদির স্বার্থপর হয়ে ওঠার গল্প" আমার জন্মের আগে থেকেই ঠাম্মী আর মায়ের দ্বন্দ্ব গৃহলক্ষ্মীকে বরণের পথ অনেকটাই রুদ্ব করে দিল।  উপরন্তু আমার আগমণের সময়টা ছিল দুর্যোগময়। চারিদিকে অথৈ বন্যা,বিচ্ছিন্ন যোগাযোগ ব্যবস্থা। সাহায্য করার লোকজনের বড়ই অভাব।  কিন্তু এটাই ছিল অনেক দিন পর আমার বাবা-মায়ের কাছে আসার ,ছিন্ন হয়ে যাওয়া বন্ধনে ভালোবাসার জোয়ার আসার প্রকৃত সময়। যেন তাদের হৃদয়বীণা আবার নতুন সুরে বেজে উঠলো। 

আমার জন্ম হলো,কোন রকমের জটিলতা ছাড়াই,বাবার -ই মেডিকেল জীবনের টীচারের হাতে। বাচ্চা ও মা দুজনেই সুস্থ। কিন্তু মায়ের মুখে যে হাসি নেই কো!কেনই বা থাকবে? আমার শরীরের কোথাও কোথাও কোন শুভ লক্ষণ নেই! আমি দেখতে সুন্দর হয়েছি,একদম পুতুলটা যেন! ডিউটিতে থাকা নার্সগণ রীতিমত কাড়াকাড়ি করেছে আমাকে এক ঝলক দেখতে আর কোলে নিতে!মা কে বলছে-"তুমি বড় ভাগ্যবতী গো!এমন সুন্দর চাঁদপানা মুখ,দুধে-আলতা গায়ের রং,লম্বা হয়েছে কি দেখেছ? ওকে তো এমনিই নিয়ে যাবে, আর যে পাবে সেতো রাজ্যসমেত রাজা হবে!"
মা হাসলো শুধু। ঠাম্মী হাসিমুখেই উলু-জোগার দিয়ে আমাদের বরণ করলেন,কিন্তু শুরু হলো মায়ের উপর আচার-বিচার-নিষেধাজ্ঞার প্রহসন!
মা কেন যেন আমার দেখাশোনা মনযোগ দিয়ে করতে পারছিলেন না,শরীরেও কুলোচ্ছিলো না। আর ঠাম্মী তো নিয়মিত পুজো দেন,কিছুতেই তার শুদ্বি নষ্ট করবেন না!বাবা আর দাদু মিলে কাজের মাসি ঠিক করে আনলেন,কিন্তু ঠাম্মী ভীষন গন্ডগোল করে তাকে তাড়িয়ে দিলেন!
মা মনে মনে খুব-ই বিরক্ত.."বুড়ি মরে না কেন?সারাটা জীবন এভাবে আমাকে জ্বালিয়েই খাবে,ভগবান তুমি বিচার করো!!!"মা আমাকে নিয়ে উপরতলার বউদির কাছে দিতেন আর খানিক জিরিয়ে নিতেন। উনি মুসলমান হয়েও সবকিছু নিজে হাতে করতেন আমার,খুব যত্নে আর পরিপাটি করে। ভগবান এতদিনে মায়ের মনের কথা শুনলেন। দেখতে দেখতে আমার ৮মাস পূর্ণ হল। প্রথম নাতনি তাই দাদুবাড়িতেই মূর্তি তুলে মা কালীর পুজো আর আমার অন্নপ্রাশণের দিন ধার্জ করা হলো। সেইমত ঠাম্মীর আর বাবার কথা অমান্য করে মা আমাকে নিয়ে গেলেন ওখানে। 

কিন্তু ঠাম্মী চেয়েছিলেন আমাদের পৈত্রিক ভিটায় বংশপরম্পরা অনুযায়ী আমার অন্নপ্রাশণ ও বিয়ের কাজ হোক পরবর্তিতে। "লতা, মা তুমি কেমন আছো?আশুতোষ কেমন এখন?""কেন খোঁজ নিচ্ছেন এতোদিন পর?আলাদা হয়ে সব শেষ করে এখন কাঁটাগায়ে নূনের ছিঁটা দিচ্ছেন?আপনার ছোট ছেলে আর বউমা বুঝি এখন আর ভাত-কাপড় দেয় না?মান্য-গন্য করেনা?আমাদের মুখো আর কোনদিন হবেননা বলেছিলেন। আজ সূর্য কোনদিকে উঠলো?""আমি ভুল করেছিলাম মা,তুমিই দীপাকে চিনেছিলে,আমি স্নেহে অন্ধ হয়ে গিয়েছিলাম ওর মা নেই বলে!"
"অনেক হয়েছে আপনাদের অভিনয়। আর সহ্য করবোনা। আপনার ছেলের যদি কিছু হয়,মনে রাখবেন আপনাকে আর কমল কে জেলের ভাত খেতে হবে। আমার সংসারের সুখ দেখে জ্বলছেন না?আর কখোনো ডিস্তার্ব করবেন না আমাদের,যত্তসব বুজরুকি। " ফোনটা রেখে দিলেন জেঠিমা। আমরা আলাদা হয়ে এসেছি দু-বছর আগে,কারণ ছিলো ঠাম্মীর আর মায়ের লাঞ্ছন আর নিয়ত অপমান!"হৃদি একটা অপয়া,আমার গর্ভের কলঙ্ক!""মা,আমায় ক্ষমা করে দিয়োগো মা। আমি তোমার কথা শুনিনি। আগে যদি বুঝতাম তবে স্নেহের কাছে আত্মসমর্পণ কিছুতেই করতাম না। এক ভুল করেছি লোভের মোহে দীপাকে বিয়ে করে,আরেকটি ভুল করলাম যে আমাদের সর্বনাশের কারণ তাকে পৃথিবীতে এনে!....." কি অভিশপ্ত আমি!!!!আমার ঠাম্মী কার্ডিয়াক এরেস্ট হয়ে আমার অন্নপ্রাশণের আগের দিন ইহধাম ত্যাগ করলেন। মেঝোমামা আর বাবা ছিলেন বাড়িতে,ভরদূপুরবেলা। ঠেকে গেল আমার অনুষ্ঠান,কিন্তু আমার দাদুবাড়িতে কারো মন খারাপ হলোনা। শুধু আমার নাম হয়ে গেল 'অপয়া,অলক্ষ্মী'। 

এরপর কোথা থেকে কি যেন হয়ে গেল!জেঠা-জেঠিমা এসে মামা আর মা পরিকল্পনা করে ঠাম্মীকে খুন করেছে এই মর্মে মামলা করলেন। পুলিশ ধরে নিয়ে গেল মা কে,মামা বাড়ি থেকে পালিয়েছিলেন তখন। বাবা এলাকার ও পরিবারের গণ্যমাণ্যদের সাহায্যে জামিনে ছাড়িয়ে আনলেন মা-কে আর পাল্টা জেঠা-জেঠিমার নামে সম্পত্তি হরণ আর মানহানির অভিযোগে মামলা দিলেন। এই হাঙ্গামায় জেঠা স্ট্রোক করলেন,জেঠিমা গ্রামময় আমাদের একঘরে করে দেয়ার আদেশ দিলেন,বাবা -মা সবকিছু ছেড়ে শহরে চলে আসলেন এক কাপড়ে,যেমন করে দু-বছর আগে বেড়িয়ে এসেছিলেন!!!শহরে নতুন জীবন শুরু করলেন তারা,কিন্তু সব পাপের দায়ী কালপীট হয়ে,একটা গলার কাঁটা হয়ে বেঁচে থাকলাম আমি। 

Leave a Comment