এক স্বার্থপর মেয়ের আত্মকথা ( শেষ পর্ব )

  • রীপা চক্রবর্তী
  • মার্চ ৪, ২০১৮

"মামা,ব্যথা লাগে তো,উহ জ্বলে যাচ্ছে,ছাড়োনা। আমার ঘেন্না করছে,খুব পেটে ব্যথা করছে..ও মামা ওভাবে ঠোঁট টা কামড়ে কেন দিলে?...মা গো,বুকে কেন কাঁমড়ে দিলে মামা?" "চুপ,একদম চুপ। জানিস না কেন করি?বলেছি না তোকে তাড়াতাড়ি বড় করে দিব,ভালো দেখে বিয়ে দিয়ে দিব?এখন কাজ করতে দে..." ছোট্ট হৃদির ৮বছরের কচি শরীরটা খুবলে খাচ্ছে একটা মানুষরূপী জ্বলজ্যান্ত হায়েনা!এভাবে প্রতিদিন-ই!"মা,ছোট মামা কে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দাও। কেন আমাকে তাড়িয়ে দিতে চাও.?ও একটা শয়তান মা। আমাকে খেয়ে ফেলছে মা..." মা আমাকে এমন ভাষায় গালমন্দ করলেন যা বলার বা লেখার অযোগ্য!কিন্তু এর চেয়েও বড় শাস্তি আমার জন্যে ঠিক করা হল তাড়াতাড়ি স্কুল বন্ধ করে বিয়ে দিয়ে দেয়া!স্কুল আর আধুনিক শিক্ষাই আমাকে ইঁচড়ে পাঁকা বানিয়ে দিয়েছে!!! শুধু মামা নয়,আমার মায়ের মামা,আমার গৃহশিক্ষক সবাই আমাকে খেতো নিয়মিত!কারণ তারা ছিলেন ভগবানের দূত!!তারা না থাকলে আমার বাবা-মায়ের সংসার হতোনা,এই যুগে টাকা দিয়ে,আশ্রয় দিয়ে কে পাশে দাঁড়ায়?আমাদের যে অশেষ ঋণ তাদের কাছে!!আর আমি বদমাশ,কূলটা বাবা-মায়ের প্রতি দায়িত্ব পালনের বদলে কিনা তাদের উল্টো বিপদে ফেলে দিচ্ছি??

এভাবে চলে গেল আরো ১০টি বসন্ত। কত ঘটনা,পাপ আর পূণ্যের!!!! এর মাঝে আমি বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছিলাম আমার বাল্যবিয়ে রুখতে!!! ভগবান সর্বদাই এই পাপিষ্ঠার সহায় ছিলেন জানিনা কেন!এক ভিখারিণী মা আমাকে আশ্রয় দিয়েছিলেন! তার সাথে তিন-বছর আমি ভিক্ষে করেছি,কিন্তু তিনি আমাকে যেভাবে আগলে রেখেছিলেন দেই ভালবাসার কাঙ্গাল ছিলাম আমি!মা-বাবার আসল স্নেহ কি মনে করতে গেলে আজো ওই বুড়ি মা-কেই আমার মনে পড়ে!!! কিছুদিন পড়ে আমাকে এসে নিয়ে যাওয়া হল ফিরিয়ে বাড়িতে,এক পান-দোকানি টাকাত লোভে আমাকে ধড়িয়ে দিলো পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেখে!!!! হাজার হোক আমি সম্ভ্রান্ত ঘরের মেয়ে কিনা!!!বিয়ে বন্ধ হলেও শারীরিক ও মানসিক অত্যাচার বেড়ে গেল আরো। পড়াশোনার চরম ব্যঘাত,বন্ধুদের সাথে যোগাযোগ বন্ধ,পড়ার টাকা জোগাড় করতে হতো বাড়িতে ঝগড়া করেএভাবে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ দিয়ে দিলাম। হঠাৎ সবাই খুব ভালো হয়ে উঠলো!"মা তোর প্রতি অনেক অন্যায় করেছি,ক্ষমা করে দিস,মা হয়ে বলছি। কেন?কিছুদিন পর থেকে সব পরিষ্কার হল। বড় মামার আমেরিকা প্রবাসী শ্যালক আমার প্রেমে পরেছে গো!!সে চায় আমাকে শীঘ্রই বিয়ে করে নিয়ে যাবে!!!"শোন হৃদি,এমন হীরার টুকরা ছেলে আর পাবিনা। আর তুই বিদেশে সেট্টেল হলে আমাদের বংশপরম্পরা বজায় থাকবে আর ভবিষ্যতে আমার জয়া আর রাজ কে আমি সুউচ্চ পজিশনে নিয়ে যেতে পারবো। আমাদের জন্যে তুই এইটুকু করবিনা? আর বিট্টু তোকে পড়াবেও বলেছে! তুই তো আসলে-ই রাজকন্যা রে!মানুষ তো ভুল বলেনি?নাহলে এমন রাজকপাল কারো হয়?" "মা,বিট্টু কি পাবে আমার কাছে?কি আছে আমার ওকে দেয়ার?সব জেনেও একটা ছেলের জীবন নষ্ট করতে বলছো আমাকে?তুমি কি বুঝোনা....????"

"চুপ কর ,.....(বাজে একটি গালি).....তুই নিজে বুঝে শুনে সব করেছিস, আর এখন সতী-সাবিত্রী সাজিস না?কেন এত চুলকানি তোর!!! তো ঘরের লোক-ই তোকে ঠান্ডা করেছে,বাইরের কেউ তো না!! এত কিছুর পরও তুই এবাড়িতে আছিস,তোর বাবা লাজ-লজ্জার মাথা খেয়েও তোকে উদ্ধার করে দিতে যাচ্ছে, কোথায় সব পাপের স্বীকার করে আমাদের দায়মুক্ত করবি তা না,উনি এসেছেন বুজরুকি করতে!!! এই এই তুই এত স্বার্থপর,এত নির্লজ্জ কি করে হতে পারিস বল তো??"জয়া,হৃদির বোন ,দৃশ্যপটে আসেইনি। কারণ,ওর জীবনে কোন অপূর্ণতা নেই। ও হলো কমল-দীপার নয়নমণি। তাদের হারিয়ে যাওয়া জয়িতা!তাই,ওকে কেউ খেতে পারেনি।!ও রাজকন্যার মত বড় হয়েছে,সবকিছু না চেয়েও পেয়েছে! আর একটি গুণ খুব ভালো আছে তার। সেটি হলো মানুষকে গালমন্দ-অপমান-হিংসে করার গুণ!হৃদি তাই কথায় কথায় ভাই-বোনের মার খাওয়ার সৌভাগ্যেও ভাগ্যবতী!কিন্তু এত সুখেও অসুখ হয়!তাই হয়েছে জয়া আর রাজ এর!জয়া যেই শুনল হৃদির আমেরিকায় বিয়ে হবে,গো ধরে বসল সাথে সাথে তাকেও বড়লোক ঘর দেখে আমেরিকায় বিয়ে দিতে হবে!হৃদিকে কিছুই দেয়া যাবেনা,সব দিতে হবে ওকে। হৃদির মত কূলটা কে সে বোন বলে মানেনা!এদিকে নিজেই একের পর এক ছেলেবন্ধু পরিবর্তন করছে,রাত কাটাচ্ছে,বাবা-মা কে অকথ্য ভাষায় গাল দিচ্ছে ওর বিয়ের জন্যে ছেলে পছন্দ না হলে,তবুও ও সতী!

 সম্বিত ফেরে হৃদির,রিদিতের ঘুম ভেঙে গেছে। "আজকের মত ডায়েরী লিখা বন্ধ করে ছেলেকে নিয়ে পড়লাম আমি.."প্লেন তখন ভারত মহাসাগরের উপর। হঠাৎ........অরুনাভ পাগলের মত ছুটোছুটি করছে হিথ্রো এয়ারপোর্টের লাউঞ্জে। যদি কোনভাবে একটি আর্জেন্ট টিকিট পাওয়া যায়। সে তার ভুল বুঝতে পেরেছে। জয় একজন ধোঁকাবাজ,ওর জন্যেই নিজের সুখের সংসার ফেলে বাইরে মজে ছিলো ও। অরুনাভের বিজনেস ফলডাউন আর হৃদির অসম্মান ,জয়ের প্রতিহিংসা এত মারাত্মক হবে সে ভাবতেই পারেনি.....দেশে বারবার ফোন করেও কোন সাড়া পাচ্ছেনা অরুনাভ। কিন্তু কেন?এখনো টিভিতে টেলিকাস্ট করছে একটি হেডলাইন: "ভারত মহাসাগরে ঝড়ের কবলে পড়ে ইউকে থেকে ৫৫০যাত্রী নিয়ে ঢাকাগামী বোইং-৮৫০ প্লেন বিধ্বস্ত। দুই দেশ-ই তাদের অনুসন্ধান চালিয়ে যাচ্ছে,শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত এখনো উদ্ধারকার্য শুরু করতে পারেনি কেউ"। হৃদির চোখের টলটল করা জল,রিদিতের কান্না,তাদের দুজনের হাসিভরা,মায়াভরা মুখ দুটো... বার বার এমন কালো আর ঝাঁপসা হয়ে আসছে কেন- নিজের কাছে কৈফিয়ত চায় অরুনাভ। আমি নিজে হাতে আমার জীবনের অবলম্বন,আমার আশা,ভরশার জলাঞ্জলি দিয়েছি, তাই ভগবান আমার কাছ থেকে সব কেড়ে নিলেন.....হৃদি তুমি কি বেঁচে আছো?আমার ডাক তুমি শুনতে পারছো?আমার রিদিত কি জানে ওর বাবা ওকে ডাকছে??হৃদি!!!রিদিত!!!!!কেউ আজ নেই সান্তনা দিতে...একা,বড় একা,আবারো একাই রয়ে গেল অরুনাভ.. .শূণ্য ঘরটা ধিক্কার দিচ্ছে আমাকে, স্মৃতিগুলো কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে. .এতদিনে হৃদির পরিবার আর আমার পরিবার সবার-ই শান্তি হলো,কেউ তো চায়নি ওরা সংসার করুক,ওরা পরিবারের অমতে সুখের নীড় গড়তে চেয়েছিল,ভগবান ঠিক-ই পাপের শাস্তি দিয়েছেন!!!অরুনাভের মনে পড়ে যায়...হৃদির মত সুন্দরী মেয়ে কলেজে একটিও ছিলনা!সবাই হৃদিকে পেতে চাইত!

অরুনাভ ও এর বাইরে ছিলোনা,কিন্ত ওর মনযোগ ছিল রীতার দিকে কারণ রীতা বড়লোকের একমাত্র মেয়ে,ভীষন স্মার্ট,হৃদির পরেই ওর স্থান! রীতা ধোঁকা দেয়ার পর হৃদি-ই ওকে সামলেছিল,এমন কি, অরুনাভের তিরষ্কারস্বরুপ ভালোবাসার অভিনয়কে সত্যিকারের মেনে নিয়ে সরল বিশ্বাসে দুই পরিবারের অমতে বিয়ে করে দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছিল!অরুনাভ রাতের পর রাত অন্য মেয়ে নিয়ে পড়ে থেকেছে, হৃদির পরিবারের কথায় প্রচন্ড অত্যাচার করেছে হৃদির উপর,বন্ধুমহলে 'মাল','বেশ্যা এসব বলে ওর থেকে যেন হৃদিকে দূরে সরিয়ে দেয় তাই জয় কে লেলিয়ে দিয়েছে হৃদির উপর!হৃদি বিদেশ-বিভূঁয়েও নিজের সম্মান বাঁচাতে পালিয়ে বেড়িয়েছে,রাতের পর রাত!!!যখন ছোট্ট রিদিত সোনা ওর পেটে এলো,হৃদি বাঁচার রাস্তা পেয়ে গেল কিন্তু অরুনাভ ওকে ও তার সন্তানকে মেরে পর্যন্ত ফেলতে চাইল যাতে অরুনাভের বিজনেসের ভাগিদার কেউ না থাকে!অরুনাভ,ঘৃণা কর নিজেকে,যদি তুমি মানুষ হও!!!!"হ্যাঁ,আমি পাপী,মহাপাপী,যখন ভালোবাসা কি জানলাম,বুঝলাম,তখনি সব হারিয়ে ফেল্লাম!,ভগবান আমায় মৃত্যু দাও".......কিন্তু অরুনাভদের শাস্তি বোধ হয় এভাবেই হয়!!!!!জীবনের চেয়েও কি স্বার্থ, বংশপরম্পরা,লোভ-লালসা,ধর্মের দোহাই দিয়ে চলা প্রহসন বড়?মেয়ে হয়ে জন্ম নেয়াই কি আজন্ম পাপ?তবে সৃষ্টি কর্তা কেন ঘরে ঘরে আজো কন্যাশ্রী দেন?


ভালবেসে সংসার করা কি অন্যায়? এক-ই ঔরসজাত হলেও সন্তানদের মাঝে পার্থক্য করা কি পিতা-মাতার কর্তব্য? উচিত কি কন্যাকে শারীরিক ও মানসিক অত্যাচারিত হতে দেখেও প্রতিকার না করে উল্টো শূলে চড়ানো?এই প্রশ্নগুলো আমি রাখলাম সমাজের কাছে....উত্তর কি দেবেন?
এভাবেই হৃদিরা হারিয়ে যায় সময়ের অতল গহব্বরে!!!!!! হয়না তাদের অপেক্ষার আর শেষ!!!!!!হৃদি কি পেরেছে তার পিতৃ-মাতৃ ঋণ,ভালোবাসার ঋণ শোধ করতে?...হ্যাঁ,হৃদি পেরেছে,হৃদিরা পারে পৃথিবীর সব ঋণ শোধ করে দিতে,মৃত্যু দিয়ে......"আজ মৃত্যু দিয়ে শেষ হলো এক স্বার্থপর মেয়ের আত্মকথা" "হৃদি আর রিদিত এখন জন্ম-জন্মান্তরের বন্ধনে আবদ্ধ,হয়তো নতুন জন্মের আশায় আবার শুরু হলো এক মায়ের স্বপ্ন পূরণ আর সন্তানকে ভালোবাসার পথযাত্রা!!!!"হৃদির কাহিনী একটি মেয়ের জীবনের সত্যিকারের ভাষ্য যদিও জানি আমি শেষ করতে পারিনি অন্য গল্পের মত সবাইকে মিলিয়ে দিয়ে!!থাক না হয় কিছু গল্প সত্যের ছায়াবৃত্তের আঁধারেই!

Leave a Comment