মাতৃত্ব :- পর্ব (১)

  • সুদীপ্তা ভট্টাচার্য্য রুমকি
  • মার্চ ৮, ২০১৮

সন্তানের জন্ম দেয়াটা কোন সহজ ব্যাপার নয়। অনেক ধরনের শারীরিক, মানসিক চড়াই-উৎরাইয়ের মধ্যে দিয়ে একজন মা কে এই সময়টায় যেতে হয়।জন্ম পূর্ববর্তী শুধু না জন্ম পরবর্তী সময়েও একজন মায়ের পরিচর্যার প্রয়োজন হয় তাকে শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ রাখার জন্য।যারা এই সময়টায় পারিবারিক সহযোগিতা যেমন নিজের বাবা,মা ই শুধু নয়,শ্বশুর, শাশুড়ি,সঙ্গী সবাইকে পাশে পায় তখন তারা তুলনামূলক স্বচ্ছন্দ অনুভব করে।শারীরিক কষ্ট হয়তো এতে কমে না কিন্তু মানসিকভাবে কষ্টদায়ক সময়টি আনন্দের সাথেই অতিবাহিত করা সম্ভব হয়। বিশেষত যিনি হ্যাজবেন্ড তার পূর্ণ সমর্থন ও পুরো প্রক্রিয়ায় সক্রিয় অংশগগ্রহন এই জটিল অবস্থাকে কিছুটা হলেও সহজ করে তুলতে পারে। উন্নত দেশগুলোতে এই বিষয়টা যথেষ্ট গুরুত্বসহকারে বিবেচিত হলেও আমাদের মধ্যে সচেতনতা ও জ্ঞানের অভাবে তা সে রকম গুরুত্ব বহন করে না। এখনো এটি অত্যন্ত সহজ বিষয় হিসাবেই পরিগণিত হয় আর সন্তান নিয়ে সচেতনতা আখ্যায়িত হয় আদিখ্যেতা হিসাবে। 

সন্তান জন্মদানের ক্ষেত্রে যদি নরমাল ডেলিভারির পরিবর্তে সি-সেকশন এর প্রয়োজন হয় তখন নতুন মা টির নিজের কাজগুলো করার জন্যও একটু সহযোগিতার দরকার হয়।অধিকাংশ পরিবারের সেটি মাথায়ই থাকে না যে মেয়েটির একটি মেজর অপারেশন হয়েছে। প্রচুর রক্তক্ষরণও হয়েছে। তার পর্যাপ্ত বিশ্রাম এবং মানসিক প্রশান্তির প্রয়োজন ধকলটি কাটিয়ে উঠার জন্য। কিন্তু আমাদের কয়টা পরিবার সেই সুস্থ ও সুন্দর পরিবেশ একটা নতুন মা ও তার সদ্যোজাত শিশুকে দেয়ার মানসিকতা রাখে। সত্যি ভিষন ঘৃণা হয় যখন মানুষ সি-সেকশন এর মাধ্যমে বাচ্চার জন্ম দেয়াটা খুব সহজ মনে করে। অনেকে তো এও বলে সিজারের মাধ্যমে যারা বাচ্চার জন্ম দিয়েছে তাদের তো কোন যন্ত্রণা ভোগ করতে হয় না।এরা কি আর জানে বাচ্চার জন্মের কষ্ট!! মনে হয় নিজের তলপেট পুরো কেটে ফেলার মত শান্তি আর নাই।কত ধরনের অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয় একজন নব্য মা কে অপারেশনের পর সেটা সেই ভালো জানে।প্রচন্ড ব্যাথা নিয়েও বাচ্চার সব কিছুই করতে হয় যেখানে উঠা বসা করাটাই চূড়ান্ত কষ্টের। হাটা-চলা করা,হাচি -কাশি দেয়া,সিড়ি বেয়ে উঠানামা করা,নিচে বসা,যেকোন ধরনের ঝাঁকিতে যে কি অনুভুতি হয় ভুক্তভোগী ভিন্ন কেউ বলতে পারবে না।

এই কাজগুলো করতে অপারেশনের পরপরই শুধু নয় বিশ বছর আগেও যার অপারেশন হয়েছে সেও নিজের অজান্তেই চিরকালই হাতটা দিয়ে তলপেট চেপে ধরে।সি -সেকশন এর কষ্টটা যে আজীবন বয়ে বেড়াতে হয় সে সম্পর্কে কোন ধারনাই বোধ হয় এদের থাকে না। তাই সদ্য মা টির শারীরিক সমস্যা নিয়ে কটাক্ষ করতেও ছাড়ে না।সন্তান জন্মের পর হাসপাতালে ডাক্তার খুব সুন্দরভাবে কিছু নির্দেশনা দেন কিভাবে কি করতে হবে অর্থাৎ সন্তানের সাথে সাথে মায়ের নিজের বিষয়ে খেয়াল রাখা প্রসঙ্গে। কিছু মুখে বলে দেন আর কিছু নির্দেশনাপত্রে লিখেও দেন।এর মধ্যে কি কি ওষুধপত্র খেতে হবে, খাদ্য তালিকা কেমন হওয়া উচিত ও ফ্রি হ্যান্ড এক্সারসাইজ এর কথাও অনেক সময় বলে দেন যাতে সে ধীরে ধীরে পূর্বের অবস্থায় ফিতে যেতে পারে।আমাদের দেশের তথাকথিত আধুনিক পরিবারও সর্বদিকে আধুনিক হলেও বাড়ির বউ এর প্রতি অত্যন্ত সেকেলে মনোভাব পোষন করে। প্রসূতির প্রাত্যহিক নিজের জন্য না করলেই নয় সেই কাজগুলো করলেও যেখানে কটুক্তি,বিদ্রূপ এর স্বীকার হতে হয় সেখানে ব্যায়াম তো বিলাসিতার পর্যায়ে পড়ে। 

শারীরিকভাবে একটি মা সুস্থ কিনা সেটাই যেখানে বিবেচিত হয় না সেখানে মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে ভাবার অবকাশ আছে কয়জনের!!!! হরমোনাল চেঞ্জের কারনে এইসময় সবসময় মূডও একরকম থাকে না।সে মানসিকভাবে অনেকটাই দুর্বল থাকে।একটু মনোযোগ,কেয়ার আশা করে।কিন্তু সেখানে তার কাছে অপরপক্ষই যদি দায়িত্ব কর্তব্যে অবহেলা বা আমাদের জন্য কি করেছ তুমি এই ধরনের অভিযোগ নিয়ে উদয় হন সেখানে মানসিকভাবে আরও ভেঙ্গে পড়া ছাড়া আর কোন উপকারই হয় না।অনেকে আবার এও জানে না হরমোনাল চেঞ্জ বলে যে কোন শব্দ আছে।অথচ সন্তানের জন্মপরবর্তী সময়ে একজন মা খুব নাজুক মানসিক অবস্থার মধ্য দিয়ে যান। এটা সাধারনত হয় হরমোনাল পরিবর্তনের কারনে কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে মনে হয় হরমোনাল পরিবর্তন মায়ের না হয়ে পুরো পরিবারের সবার হয়ে যায়।একটা নতুন মায়ের যত্ন নেয়া দূরে থাক তাকে ক্রমাগত মানসিক ও শারীরিকভাবে নির্যাতন করার মত মানসিকতাসম্পন্ন পরিবারের মানুষ কোনভাবেই সুস্থ-স্বাভাবিক মানুষ হতে পারে না পক্ষান্তরে এদের দ্বারা সদ্যোজাত শিশুটিও যে নির্যাতনেরই স্বীকার হয় এটাও এদের বোধগম্য হয় না। এর মধ্যে নব্য মা টি যদি বাড়ির নতুন বউটি হয় তাহলে তো পোয়া বারো।

বউ এই করলো না,ওই পারলো না,এইভাবে হাসলো না,ওইভাবে হাটলো না। অথচ তারা একবার ভাবে না নতুন বউ আর নতুন মা এক কথা নয়। নতুন বউটিকে নতুন পরিবেশে এসে পরিবেশের পরিবর্তনের সাথেই শুধু নয় তার সামঞ্জস্য বিধানের প্রয়োজন হয় মা হওয়ার যাত্রা পথে নিজের নতুন শারীরিক পরিবর্তনের সাথেও।সর্বদিকে পরিবর্তনটা তারই হয়। লাইফ এবং কেরিয়ার কম্প্রোমাইজ বা সেক্রিফাইস সবই বউটিকে করতে হয় বা করতে বাধ্য করা হয়। দিনশেষে ঠিকই সে পরের বাড়ির মেয়েই থেকে যায়।তাই গেল গেল সব গেল, কি মেয়ে বিয়ে করিয়ে আনলাম বলে মুখে ফেনা তুলে ফেলতে বেশি সময় লাগে না শ্বশুর বাড়ির মানুষের।সবার আগে গলায় ঢোল বাঁধেন শাশুড়ি,বউ এর গুণকীর্তন করতে।এরপর একে একে সবাই তাকে সমর্থন দিতে এগিয়ে আসেন। পশ্চাৎপদ হিসাবে না থেকে পতিটিও সেই দলে যোগ দেন।যেসকল হাজব্যান্ড সন্তান জন্মদান ও লালনপালন কে স্ত্রীর একান্ত ব্যক্তিগত বিষয় মনে করেন সন্তানের জন্মের সূচনালগ্নে সর্বাজ্ঞে অবদান রেখেও স্ত্রীর হাতটুকু ছাড়ার উপযুক্ত সময় হিসাবে সন্তান জন্মদানের মুহূর্ত কে বেছে নেন,এক্ষেত্রে শ্বশুর বাড়ির সবচেয়ে বিশ্বাসঘাতক, দায়িত্বজ্ঞানহীন সদস্য হল পতিটি। কারন নিজের স্ত্রী ও সন্তান কে সুন্দর পারিবারিক পরিবেশ দেয়ার দায়িত্ব কিন্তু তার। সদ্য হওয়া বাবা হিসাবে নিজের স্ত্রী সন্তানের জন্য হিতকর কোন কাজ না করতে পারলেও তাদের জীবনটা কে আরও দুর্বিষহ করে তুলতে অনেক হাজব্যান্ড এর জুড়ি মেলা ভার। কোন মানুষের স্ত্রী ও সন্তানের প্রতি ন্যূনতম ভালবাসা থাকলে এই ধরনের কাজ নিজে করা বা কাউকে করতে দেওয়া সম্ভব নয়।

Leave a Comment