সুন্দর জুড়ি কিন্তু সুখী নয়!

  • রোমানা আক্তার 
  • মার্চ ১২, ২০১৮

বিবাহের সময় আমার যোগ্যতা ছিল রূপ, গুণ, সামাজিক স্ট্যাটাস। শ্রাবণের যোগ্যতা ছিল বেশ ভাল চাকরী। আমাদের মন মানসিকতা মিললো কিনা সেটা যাচাই করা হয়নি একবারের জন্যেও। বুঝানো হয়েছিল, একসাথে চলতে চলতে মন মানসিকতা মিলে যাবে। আমাদের নিজেদের মনমানসিকতার হিসাব না মিললেও পারিবারিক হিসাব মতে দুয়ে দুয়ে চার মিলে গেল। বেশ ঘটা করে আমাদের বিয়ে হল। বাবার গর্ব, শিক্ষিত চাকরিজীবী জামাই। শ্বশুরের গর্ব, বিত্তশালী বাবার রূপবতী মেয়ে তার ছেলের বউ। এক কথায়, "সোনায়-সোহাগা"।

আমাদের বাসর হল। একদম মনের টানে নয়, পুরোটাই শারীরিক টান। প্রবল উত্তেজনা শেষ আমরা যে যার মত ঘুমিয়ে গেলাম। ভোর হল। নতুন পরিবারে আমার পদচারণ শুরু। আমি কিন্তু আমার বাবার ধন সম্পদ সাথে করে নিয়ে আসিনি। নিয়ে এসেছি আমার মন মানসিকতা, রূপ, গুণ। তেমনি আমার বর শ্রাবণ সে কিন্তু নিজ গৃহে কোন কর্মকর্তা নয়, নিতান্তই একটা ছেলে। সময় গড়িয়ে যায়, বদলে যায় জৈবিক চাহিদা। বাসর রাতের মত এখন আর শরীর জাগে না। মন জাগতে চায় সবার আগে। নতুন বউয়ের ন্যাকামো আর ভালোলাগে না। এবার মেয়ে হতে ইচ্ছে করছে। স্বরূপ প্রকাশের ইচ্ছে হচ্ছে। নিজের ভালো লাগা, মন্দ লাগা গুলো প্রকাশের জন্য বুকের ভেতরটা খাঁ খাঁ করছে। এবং আমি নিজের মত করে একে একে সেসবের প্রকাশ ঘটাতে শুরু করলাম। শ্রাবণেরো একি অবস্থা। সমস্ত আবেগ মাখা মিথ্যে ছলচাতুরী, আমাকে খুশি করার ভণিতা এসব আর আগের মত জমছে না। সেও তার ইচ্ছা অনিচ্ছাকে গুরুত্ব দিতে শুরু করল। আমরা দুজন নতুন বর-বউ থেকে সবসময়ের আমরা হয়ে গেলাম।

শুরু হল আমাদের মতের অমিল। বিবাহের শুরুতে আমরা ঠিক এই জিনিসটা নিয়েই ভয় পেয়েছিলাম। "মনমানসিকতা" না মিললে এক সাথে থাকা যায় না। সেক্রিফাইজ, কম্প্রোমাইজ করা যায় কিন্তু তারো একটা নির্দিষ্টতা আছে। মানিয়ে নেয়া আর মানিয়ে যাওয়ার মাঝে একটা বিরাট পার্থক্য আছে। ভালোবাসার টান আর মায়ার বাঁধনে অমিল আছে। মনের টানে কাছে থাকা আর শরীরের টানে কাছে থাকায় একটা শুন্যতা আছে। আমাদের স্বাভাবিক আচরণ প্রকাশের সাথে সাথে আমরা এই বিষয়গুলো একে একে টের পেতে থাকলাম। আমরা দেখলাম, আমাদের ভেতরে ক্রমশ মানসিক দুরত্ব বেড়ে চলছে। আমাদের ভালোবাসার রূপ বদলে যাচ্ছে। প্রেমের অর্থ আমার কাছে দাঁড়াল দামি গহনা, গাড়ি, বাড়ি, পোশাক উপহার। শ্রাবণ বুঝে নিল আমার বাবার দেয়া ফ্লাট, চাকরীর পদমর্যাদা। দুই পরিবারের কাছে আমরা তখনো সুখি দম্পতি। আমার বাবা কিংবা শ্রাবণের বাবা পৃথিবীর সুখি দুই বেয়াই।

আমরা দুজন দুজনের সাথে মানিয়ে নিচ্ছি। ভালোবাসা আর প্রেমের গভীরতা প্রকাশে দামি উপহারের পালা শেষ হল। আলমারি ভর্তি গয়না। এসব আর ভালো লাগেনা। আমার বাবার বিত্ত, ক্ষমতা আর শ্রাবণের মেধা এই দুই মিলিয়ে আমাদের নিজস্ব বাড়ি হল, গাড়ি হল। নিজেদের একটা অবস্থান হল। আমি আমার মত চলছি, শ্রাবণ ওর মত চলছে। সেদিন খুব ইচ্ছে হল, বাসর রাতের মত একটি অস্থির রাত কাটাই। দুজন দুজনের খুব কাছে। অথচ কোথায় যেন আমাদের দূরত্ব। জৈবিক চাহিদাও হার মেনেছে মানসিক শূন্যতার কাছে। এতোটা বছর শুধু মানিয়ে নিয়েছি, মায়া করেছি। বিনিময়ে হারিয়েছি নিজের দুর্দান্ত প্রেমিকা হবার ক্ষমতা। হারিয়েছি স্বার্থহীন ভালোবাসা।

তিন বছর পর আজ আমরা কোর্টে দাঁড়িয়ে। ডিভোর্স  পেপার হাতে এসেছে। আমাদের বাবারা দাঁড়িয়ে আছেন। ডায়মন্ডের গহনা, দামি শাড়ি পরে অশ্রুসিক্ত হয়ে বাবার দিকে তাকিয়ে বললাম, "আমাকে খুব সুখি মনে হচ্ছেনা বাবা?" শ্রাবণ ওর বাবার দিকে তাকিয়ে বলল, "তোমার ছেলে আজ সমাজে প্রতিষ্ঠিত"। আমাদের বাবারা নির্বাক তাকিয়ে। আমরা ডিভোর্স পেপারে সাইন করে দিলাম। গায়ের গহনা গুলো খুলে নিজেকে হালকা করলাম। শ্রাবণকে দেখলাম, ব্লেজার টাই খুলে ফেলল। হয়ে গেল প্রথম দিনের সেই সাদামাটা শ্রাবণ। ভাল চাকরী, সামাজিক স্ট্যাটাস, রূপ, গুণ এই সবকিছু মিলিয়ে আমাদের সংসারের স্থায়িত্ব হল তিন বছর। অথচ সেদিন যদি আমাদের মনমানসিকতা বিচার করা হত তবে এই সংসারটিই টিকে থাকত আমৃত্যু। ডিভোর্সি না হয়ে হতে পারতাম স্বামী স্ত্রীর রোল মডেল।

আমাদের বাবারা বুঝতে চাননা, বিবাহিত জীবনে অর্থবিত্তের চাইতেও শারীরিক, মানসিক, পারস্পরিক নির্ভরশীলতা গড়ে ওঠা জরুরি। যাতে সময়ের সাথে সাথে যখন মানুষের শারীরিক আকর্ষণ কিছুটা কমে আসে তখন যেন মানসিক এবং নির্ভশীলতা সম্পর্কের  দৃঢ়তা বাড়ায়। আর সম্পত্তি?? খেতে বসলে কেউ খোঁটা দিলে দুইদিন অনায়াসে না খেয়ে থকতেও কিন্তু কষ্ট হয়না। একবেলা পেটের শান্তির জন্য মনের শান্তি জলাঞ্জলি দিতে খুব গায়ে লাগে। তাই না খেয়ে থাকাই শ্রেয়। এটাই মানসিক শান্তি। শুধুমাত্র অর্থ বিত্ত আর শারীরিক সম্পর্কের উপর ভিত্তি করে কোন সম্পর্কই বেশী দূর আগাতে পারে না। হোক তা আইনত বৈধ বিয়ে।

Leave a Comment