নীতি কথা বইয়ে মানায়!

  • কামরুন নাহার স্মৃতি
  • মার্চ ১৭, ২০১৮

আমি তখন ক্লাস ফাইভে পড়ি, বয়স আর কত হবে! হবে হয়তো ১১-১২বছর। প্রতিদিন স্কুলে যেতে খুব ভালো লাগতো আমার, সহপাঠীদের সাথে আড্ডা দিতেও ভালো লাগে আর স্যারদের সাথেও। স্কুলে প্রতিবছর প্রথম স্থান অধিকার করায় স্যারদের সাথে একটু বেশিই আলাপ করার সুযোগ হয়েছে, স্যারদের খুব কাছে আসার সুযোগ পেয়েছি। স্কুলের ইকবাল স্যার আমাদের সবার প্রিয়, স্কুলের পাশেই স্যারের বাড়ি ; সবাই সম্মান করে স্যারকে। স্যার আমাদের প্রতিদিন একটা করে নীতিকথা শেখাতেন । আজ ও মনে আছে সেসব.... 
স্যার শেখাতেন __ 

"যৌতুক নেয়া ও যৌতুক দেয়া সমান অপরাধ। " 

"স্ত্রী মানে দাসী নয়, অর্ধাঙ্গিনী |" 

"স্বামী মানে প্রভু নয় , অর্ধাঙ্গ |" 

"অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে 

তব ঘৃণা যেন তারে তৃণ সম দহে |" 
"সবার ওপরে মানুষ সত্য , তাহার উপর নাই |" 

"মিথ্যা বলা মহাপাপ |" 
কথাগুলো ছোট্ট মনে গেঁথে নিয়েছিলাম | অথচ দেখলাম নিজের ছেলের বিয়েতে স্যার যৌতুক হিসেবে নিলেন ৪লাখ টাকা , ২ভরি সোনা | কারন তার ছেলে এম.বি.বি.এস ডাক্তার | আশ্চর্য হয়ে স্যারকে জিজ্ঞেস করেছিলাম _ স্যার আপনি তো শিখিয়েছেন যৌতুক নেয়া ও দেয়া সমান অপরাধ | তাহলে 
-- তুই বুঝবি না , তুই তো ছোট , বড় হলে বুঝবি |তাই আর কিছু বলা হয় নি |  ইকবাল স্যারের বউ আমাদের প্রায়ই বাড়িতে আসতে বলতেন , ভালো - মন্দ রান্না করে খাওয়াতেন | একদিন বিকেল বেলা কাউকে কিছু না বলে সবাই মিলে স্যারের বউকে চমকে দেবো বলে যখন স্যারের বাড়ি পৌছালাম তখন দেখলাম স্যার তার বউয়ের সাথে বাজে ভাবে কথা বলছেন যা দাসীর চেয়ে নিকৃষ্ট ব্যবহার | প্রচন্ড মারধর করছেন | স্যার স্যার বলে ডাক দেওয়ায় স্যার হকচকিয়ে বাহিরে এসে বললেন -- কি রে , তোরা এখানে? 
আমার দিকে তাকিয়ে বললেন -- কি? কিছু বলবি? 
-- হ্যা স্যার | 
-- বল ……… 
-- আপনি যা শিখিয়েছেন তা কি সব মিথ্যা ……! স্যার? স্ত্রী মানে তো দাসী নয় আর স্বামী মানে তো প্রভু নয় , তাইনা স্যার? 
-- হুম | কিন্তু নীতি কথা বইয়ে মানায় ,নীতি কথায় জীবন চলে না | তুই বুঝবি না , যা এখন বাড়ি যা …… 
আমি আর কোন কথা না বলে বাড়ি চলে আসি , ছোট বলে কিছু বলা হয়নি সেদিনও | 


কয়েকদিন পর স্কুল যাবার পথে দেখলাম এক লোক তার বাড়ির কাজের মেয়েটাকে বেত দিয়ে পেটাচ্ছে আর আমাদের সবার প্রিয় ইকবাল স্যার দূরে দাঁড়িয়ে সমস্তটাই দেখছেন কিন্তু মুখে কোন কথা নেই , যেন কেউ মুখে তালা লেগে দিয়েছে | আমি সামনের দিকে গেলাম | বললাম স্যার __ 
"অন্যায় করা এবং অন্যায় সহ্য করা সমান অপরাধ" তাইনা স্যার? 
স্যার বললেন -- তুই জানিস এই লোকটা কে? 
-- না স্যার | 
-- ওই লোকটা এই গ্রামের মাতব্বর | 
-- তাতে কি হয়েছে স্যার …?
-- ওরে বুদ্ধু , সবার সাথে লড়াই করা যায় না; বুঝবি না তুমি | যা এখন স্কুলে যা … আমি সেদিনও কথায় বাড়াইনি , চুপ করে স্কুলের পথে পা বাড়িয়েছিলাম | 

দেখতে দেখতে প্রথম সাময়িক , দ্বিতীয় সাময়িক পরীক্ষা শেষ হয়ে গেল , এবারে আমার রেজাল্ট ভালো | ইকবাল স্যারের ক্লাস করছিলাম , হঠাৎ চারপাশে চিৎকার চেচামেচির আওয়াজে স্যারের আগেই আমরা সবাই বাহিরে আসি , ছোট একটা ছেলেকে আর্তনাদ করতে দেখি মাটিতে পড়ে | বয়স কত হবে? ১০-১২হয়তো বা তার কম ,আবার বেশিও হতে পারে! সে নাকি চেয়ারম্যানের বাড়ির বাগান থেকে অনেকগুলো পেয়ারা চুরি করেছে , চেয়ারম্যান পশুর মতো এতোটাই মেরেছে যে হাতে পায়ে জখম হয়ে গেছে ছেলেটার | স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে সেই দাগগুলো | চেয়ারম্যান স্যারের কাছে এগিয়ে কি সব বলল , কিছুই বুঝতে পারলাম না | তবে কিছু একটা বলতেই হবে এমন ইঙ্গিত করল এটা বুঝলাম ।

ছেলেটার অনেকটা দূর থেকে লক্ষী সোনা , মানিক আমার , যাদু আমার এসব বলে পাগলিনীর মতোই ছুটে এসে ধুলোয় গড়াগড়ি খাওয়া ছেলেটাকে কোলে তুলে বুকে জরিয়ে নিল | চোখ বড় বড় করে চেয়ারম্যানের দিকে এমনভাবে তাকালো যেন কোন দৈবশক্তি থাকলে এখনই পুরে ছাই করে দেবে কিন্তু না তার কোন দৈবশক্তি নেই! চেয়ারম্যান আমতা আমতা করে বলল __ আমি কিছু করিনি তোমার ছেলেকে , গাছ থেকে পড়ে জখম হয়েছে | আমি তো দুই একটা চড় মেরেছি মাত্র! আমি আশ্চর্য হয়ে শুনছিলাম চেয়ারম্যানের সাজানো মিথ্যা |  আমার কথা বিশ্বাস না হয় ইকবাল মাষ্টারকে জিজ্ঞেস করো - চেয়ারম্যানের কন্ঠে কত শীতলতা!  ইকবাল স্যার ঘাড় নেরে সায় দিলেন যে চেয়ারম্যান সত্য বলছে | স্যারকে সবাই খুব সম্মান করে তাই কেউ কোন অভিযোগ করেনি | চুপচাপ আহত ছেলেকে নিয়ে সবাই চলে গেল |

 কিন্তু আমি নির্বাক দাঁড়িয়ে রইলাম | 
-- কি রে , দাঁড়িয়ে থাকবি , ক্লাসে যা | 
স্যার কত শান্ত গলায় কথা বলছেন যেন কিছুই হয়নি! 
-- স্যার , আপনি যে শিখিয়েছিলেন … 
"সবার ওপরে মানুষ সত্য তাহার উপর নাই |" তাহলে আজ কেন ক্ষমতার কাছে মানুষে মানুষে ভেদাভেদ? … 
-- পাগলি মেয়ে , বই লেখকের কল্পনায় আঁকা ছবি | বইয়ের কথাগুলো আবেগে লেখে লেখকেরা কিন্তু তারা নিজেরা তার ব্যবহার জীবনে করতে পারেনা | আর আমরা তো ক্ষুদ্র মানব ।
-- কিন্তু স্যার ……… ক্ষুদ্র বলে আর কত চুপ থাকবো আমরা ………?
-- বল …… 
-- "মিথ্যা বলা মহাপাপ |" এটা মানা তো খুব কঠিন নয় স্যার তাহলে কেন শিখিয়েছেন এসব …?আপনি নিজেই তো মানুষে মানুষে ভেদাভেদ করলেন তাহলে এসব শিখে কি লাভ স্যার? 
-- খুব পাকামি শিখেছিস না! মন দিয়ে শোন বইয়ের শেখানো কথায় বাস্তবতা চলে না | বাস্তব খুব কঠিন , কষ্টকর , যন্ত্রণার | বুঝবি না তুই | 
-- আমায় ক্ষমা করবেন | বইয়ের শেখানো কথা যদি জীবনে কাজেই না আসে তাহলে আমি সেই বই পড়তে চাই না | ক্ষুধার্তের মতো আমি বইয়ের পাতা মুখস্থ করে আমি আমি শিক্ষিত হতে চাইনা স্যার | আমি বুঝতে চাই না ………… 
বলেই চলে এসেছিলাম সেদিন স্কুল থেকে | বাবা আমায় বুঝেছিলো , বাবার কাছেই পড়তে শুরু করি | 
একমাস পর ইকবাল স্যার আমাদের বাড়ি এসেছিলেন __ আমি যেন বার্ষিক পরীক্ষা দেই তা জানাতে | 
বাবা বলেছিলেন _ আমার মেয়ের সার্টিফিকেটের কোন প্রয়োজন নেই , যে বইয়ের শেখানো মূল্যবোধ কোন কাজে আসেনা ;সে বই গিলে কি লাভ মাষ্টার? আমার মেয়েকে আমি দীক্ষা দেব , মুল্যবোধ আর নীতি কথার | তোমাদের দীক্ষা চাইনা আমার মেয়ের , যদি কখনো পারো ছাত্রদের যে কথা শিখিয়েছো নিজে কাজে লাগিয়ো …… ক্ষমা করো | আর হ্যাঁ ভালো থেকো | সেদিন থেকেই আমার সার্টিফিকেটের আর শিক্ষিত হওয়ার দীক্ষা থেমে গেছে, কি হবে সার্টিফিকেট এর জন্য বইয়ের পাতা গিলে যদি তা জীবনে কাজেই না আসে।

Leave a Comment