মাতৃত্ব- পর্ব ৪

  • সুদীপ্তা ভট্টাচার্য্য রুমকি
  • মার্চ ২৪, ২০১৮

পরে অবশ্য উনারই ভাইয়ের বউ উনাকে পুত্রবধূর সামনেই বলেছিল,কি বল সেজদি আমার দুইটা ছেলেরই তো জন্মের পর জন্ডিস এত বেড়ে গিয়েছিল যে আমি দশ-বারো দিন হাসপাতাল থেকে ডিসচার্জ ই নিতে পারি নি,তুমি তো ছিলে,ভুলে গেছ? পুত্রবধূটি যা বোঝার তা বুঝল। একে নিজেই সিজারের পেশেন্ট,তার উপর খাওয়া নেই,ঘুম নেই,চুড়ান্ত মানসিকভাবে বিপর্যস্ত অবস্থায়ও সন্তানকে ব্রেস্টফিড করাতে বার বার যেত সন্তানের রুমে।ডাক্তার বলেছিলেন আপনি নিজেই সুস্থ নন।আপনি বেডে যান আমরা খাওয়ানোর সময় বেবি কে নিয়ে যাব আপনার কাছে। এক মিনিটের জন্য মাসি শাশুড়ি হাসপাতালে এসে বললেন তুমি তো সুস্থ, এখানে বসে আছো কেন? বাচ্চার রুমে গিয়ে খাওয়াও। তোমার জন্য তো আর রুম নেয়া হয় নি!!!

সদ্য মা টিই ডিউটি দিচ্ছে অথচ গলির মোড়ে হাসপাতাল হওয়া সত্ত্বেও কেউ আসা বা খাবার পাঠানোর প্রয়োজনও মনে করেনি!!শুধু যেদিন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল সেদিন রাতে শ্বশুরবাড়ি থেকে ওর খাওয়ার জন্য একবাক্স আধপচা মিষ্টি পাঠানো হয়েছিল। মানুষ কত ভয়াবহ মানুসিকতার হয় তা নিজের চোখে দেখার পরও বিশ্বাস করতে তার কষ্ট হচ্ছিল। দুই দিন পর কমে যাওয়ায় যেদিন বাসায় আসে সেদিন তারা সবাই মিলে আয়োজন করেছিল মেয়েটি কেন রিআ্যাক্ট করেছিল তাই তার সবার পায়ে ধরে মাফ চাওয়ার অনুষ্ঠানের।মেয়েটি শুধু নিজের হাজব্যান্ডের দিকে একবার তাকিয়ে ভাবছিল এই লজ্জা তোমার,আমার নয়।

মেয়েটি বাচ্চার আয়ার মত ঐ বাড়িতে ছিল। তার সন্তানের ব্যাপারে সে ছাড়া বাকী সবার মতামত,পছন্দ-অপছন্দেরই গুরুত্ব ছিল। ডায়পার পড়ানো ছাড়া কেউই বাচ্চা কে নিজেদের বিছানায় রাখতেন না,যার যখন খুশি পড়িয়ে দিতেন কিন্তু অন্তর্যামী হয়ে ও কেন সময়মত খুলল না এর জন্য বউটিকে তুলাধুনা প্রায়ই করতেন।বউটির বাচ্চাকে ওষুধ খাওয়ানো,জল এমনকি খাবার খাওয়ানো নিয়েও সন্দেহ প্রকাশ করা হত। অসুস্থ যাতে থাকে সেজন্য মা টি নাকি ইচ্ছা করেই ওষুধ খাওয়াতো না আর খাবার না খাইয়েই নাকি অন্যদের কাছে খাইয়েছি বলে বাচ্চাকে দিত যাতে রান্নাঘরে গেলেই বাচ্চা কাঁদে আর কোন কাজ করতে না হয়।আর এক মাসের বাচ্চাও নাকি পুরো মায়ের স্বভাবের,মায়ের কাজ করা সহ্য করতে পারে না। মা স্নান করালে কাঁদে না, অন্যের কাছে কাঁদে কেন? মায়ের কোলে এলেই ম্যাজিক এর মত কান্না থেমে যায় কেন? শুয়ে থাকলেও মায়ের সাথে লেপ্টে থাকে কেন? সব প্রশ্নের উত্তর আবার নিজেরাই দিত যে নিশ্চয় মা টোনা করেছে বাচ্চা কে। না হলে বাচ্চা মায়ের দিকে পাশ ফিরে থাকতে গিয়ে ঘাড় ত্যাড়া করবে কেন? কিন্তু মা টি জানতোই না What is the meaning of Tona? এই বিশ্লেষণধর্মী আলোচনায় তারা কেউই লজ্জিত বোধ করতো না,মেয়েটি যে শুনেছে বা তার কেমন লাগছে, সেটাও একজনও ভাবতো না?

সময় গময়ের বালাই ছিল না দুপুর ২.৩০,৩.৩০ টা এমনকি ৪ টার সময়ও এবং রাত ১২.০০ বা ১২.৩০ দিকে অর্থাৎ দৈনিক দুই বার শীতের মধ্যও সদ্যোজাত শিশুটিকে ঘানি ভাঙ্গা সরিষার তেল দিয়ে শরীর শুধু নয় মুখে পর্যন্ত ডলে দেয়া হত। বিশেষত যখন চোখে,নাকে,মুখে ম্যাসাজ দিত বাচ্চাটি কাঁদতে কাঁদতে অজ্ঞান হয়ে যেতে চাইতো ঝাঁঝের কারনে। সেটা বাচ্চার স্যুট করছে কি না,তাও বিচার্য ছিলনা।আরও আছেএক মাসের বাচ্চার যাতে কাশি না হয় এই কারনে এক টেবিল চামচ ঘানি ভাঙ্গা সরিষার তেলে রসুন দিয়ে তা বাচ্চা কে খাইয়ে দেয়ার বাসনা পোষন করেন শাশুড়ি। বাচ্চার পায়খানা ঠিকমত হচ্ছে না সেই সরিষার তেল তো আছেই তা পানের বোঁটায় লাগিয়ে টানা দেড় মাস খোঁচানো চলল তবু ডাক্তারের পরামর্শ নেয়া যাচ্ছিলনা।

জন্মের পর যখন বাচ্চা পর্যাপ্ত দুধ পেত তখন বউটিকে বলতেন তোমার তো বস্তির মেয়েদের অবস্থা,আমাদের বাবা এমন ছিলনা। চুড়ান্ত মানসিক নির্যাতনে বউটিরও বস্তির অবস্থা বেশি দিন স্থায়ী হয় নি।বাচ্চার শরীরও খারাপ হচ্ছিল দেখে মেয়েটি ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করে তাতে কারো মত না থাকলেও। ডাক্তার অমিডন ট্যাবলেট দেয় মা কে খাওয়ার জন্য এবং হাজব্যান্ড কে নিয়ে যেতে বলে কারন পরিস্থিতি উন্নয়নের জন্য সবার আগে উনাকে বোঝানো প্রয়োজন। তারা শোনার সাথে সাথেই বললেন বমির ওষুধ খেয়ে দুধ বাড়ানো বাপের জন্মে শুনি নাই আর খাওয়াইতে তো আর কম খাওয়াইলাম না তাতেও যদি তোমার বাচ্চা দুধ না পায় কি আর করা। আর হাজব্যান্ডের সাথে ডাক্তারের কথা বলানোর বায়না তো তোমার, সুস্থ একটা মানুষ, তবুও তুমি যেন চলতেই পারোনা।এদের পাগলামীতে বাচ্চার অসুস্থতা বাড়লো। ওকে শাসিয়ে নিয়ে যাওয়া হলো ডাক্তারের কাছে যেন কোনভাবেই না বলে দেড়মাস ধরে বাচ্চাটিকে খুঁচিয়ে চলেছেন তবু ডাক্তারের কাছে নিয়ে যান নি।ডাক্তার মা টিকে দেখেই হয়তো বুঝতে পেরেছিলেন সে অসম্ভব বিপর্যস্ত তাই প্রশ্ন করায় মেয়েটি শাশুড়ির সামনেই বলেছিল হ্যা আমি ঠিক নেই ডক্টর....শাশুড়ি বাসায় এসে গগনবিদারী চিৎকারের মাধ্যমে পুত্রবধূর গোষ্ঠী উদ্ধার করে নিজের হাজব্যান্ড ও পুত্র কে ফোন করলেন "যে অসভ্য,নবাবের মাইয়ার সাহস কত! ডাক্তাররে কয় অয় মানসিকভাবে ঠিক নাই,আরে তুই হইলি পাগল তুই কেমনে ঠিক থাকবি,কেমনে যে আমি সহ্য করছি কি কমু,তাড়াতাড়ি আয় বাপ... তোর বউরে আইয়া ঘর থাইক্কা বাইর কর।" 

যথারীতি শ্বশুর এবং পুত্রের আগমন এবং বউকে ঘর থেকে বের করে দেয়ার ইচ্ছা প্রকাশ। বাচ্চাটা যে অসুস্থ সেই খেয়ালটুকও নেই। আবার যখন হাসপাতালে ভর্তি করাতে হলো শরীরে রক্ত কম বলে তখন ল্যাবে, হাসপাতালে বার বার বলছিল মা কে সরিয়ে রাখুন,ছোট্ট বাচ্চা -মা সহ্য করতে পারছে না,উনিই কেন সব সময় বাচ্চার সাথে?আর কেউ নেই?খুব দূর্বল মনে হচ্ছে দেখে... কিন্ত মা টিকে স্বান্তনা দেয়ার পরিবর্তে তারা ছিঃ ছিঃ করেই যাচ্ছিলেন। অথচ যারা পায়ের নখ উল্টালেও দেশের বাইরে যায় চিকিৎসা করাতে দেশের চিকিৎসার উপর বিন্দুসম আস্থা নেই বলে সেই তারাই ঘরের কাছে হাসপাতালে বাচ্চাটিকে ফেলে রেখেছিল।গবেষণাগারের ইদুরের মত তার উপর গবেষণা চলছিল। কারো কোন মাথাব্যথা ছিলনা।সারাদিন বাচ্চা নিয়ে মা একাই থাকতো। হাসপাতালের খাওয়া পারলে খেত,ওয়াশরুম ও রুমের বাইরে, একটা মানুষও থাকতো না যার কাছে দিয়ে খাবে বা ওয়াশরুমে যাবে!!একদিন ডাক্তারের কাছে শাশুড়ি কমপ্লেইন করছিলেন মা টির দায়িত্ব কর্তব্যে অবহেলা সম্বন্ধে, ডাক্তার বলেছিলেন "আড়াই মাস আগে সিজার হয়েছে!মেয়েটির খাওয়া,ঘুম,রেস্ট কিছুই নেই,একটা প্রসূতির সাথে এই ব্যবহার করে যে পরিবারের মানুষ আশা করে বাচ্চা সুস্থ থাকবে তাদের কিইবা বলার থাকতে পারে, খাওয়ান খাওয়ান ফিডার খাওয়ান। দয়া করে কথায় কথায় বউ এর দোষ ধরাটা বন্ধ করেন।" তারা অপমানবোধ করলেন ডাক্তারের কথায় কিন্তু একবিন্দু লজ্জা অনুভব করলেন না নিজেদের আচরণে। এতেও তারা বউ এর দোষই খুঁজে পেলেন। 

অথচ তাদের অমানবিক,অমানুষিক আচরণে বউটি শুধু নয় শিশুটিও ভয়াবহ পরিস্থিতির শিকার হচ্ছে তা তারা বুঝেও বুঝতে পারছিলেন না। জন্মের পর যখন ডাক্তার বলে দিয়েছিলেন নুন্যতম আধঘণ্টা সকালের রোদটা বাচ্চার গায়ে লাগাতে তা করা হয়নি এবং পরবর্তীতে ফলোআপেও বাচ্চাটিকে রাখা হয় নি। ডাক্তারের কাছে কেবল তখনই নেয়া হত যখন আর না গেলেই নয়। শুধুমাত্র অসচেতনতা ও অজ্ঞানতার ফল ভোগ করেছিল সদ্যোজাত শিশু ও তার মা টি। শারীরিক ও মানসিক অযত্ন,অবহেলায় অবাঞ্ছিতের মত অমানবিক জীবন যাপন করতে করতে মেয়েটি একপর্যায়ে খুব অসুস্থ হয়ে পড়ে।তখন ছয় মাসের বাচ্চা কোলে দিয়ে অসুস্থ অবস্থায় তাকে বাসা থেকে বের করে দেয়া হয়। পুরো প্রক্রিয়ায় হাজব্যান্ড এর অবস্থান ছিল গৃহপালিত সন্তান,কাপুরুষ হাজব্যান্ড এবং অথর্ব পিতা হিসাবে।

একটা মেয়ে উচ্চশিক্ষিত হওয়ার পরও কেন এত অত্যাচার মেনে নিল?হয়তো সে মনে করেছিল তাদের মধ্যে যদি কখনো মনুষ্যত্ব জাগ্রত হয়!! কিন্তু যাদের চরিত্রই এমন, সেক্ষেত্রে আপনি যতই অত্যাচার সহ্য করুন না কেন তাদের অত্যাচারের মাত্রাটা কমবে না,বরং ততই বাড়বে। সেটা মেয়েটিও হয়তো সেদিন বুঝতে পেরেছিল যখন ঘর থেকে বের করে দিয়ে আর খোজ নেয়ার প্রয়োজন মনে না করলেও যেদিন নিজেদের ঘরের কাঠগড়া ছাড়িয়ে তাকে নিয়ে তুলেছিল আদালতের কাঠগড়ায়।কাঠগড়ায়ই থাকুক মাতৃত্ব আর দ্ব্যর্থহীন থাকুক পিতৃত্ব, সমাজের পৃষ্ঠপোষকতায়।

 

Leave a Comment