শুভ জন্মদিন, প্রিয় রুমী। 

  • ইউসুফ আহমেদ শুভ্র 
  • মার্চ ২৯, ২০১৮

শাফী ইমাম রুমী ! বাংলার এক রাজপুত্র !! ১৯৫২ সালে আজকের এই দিনে শরীফ ইমাম আর  জাহানারা ইমামের ঘর আলো করেন পৃথিবীতে আসেন এই রাজপুত্র। প্রিয় কবি জালালুদ্দিন রুমীর নামানুসারে তার ডাকনাম রাখা হয় রুমী! ঢাকার আজিমপুরের একটি কিন্ডারগার্টেনে তার লেখাপড়া শুরু, ১৯৬৮ সালে আদমজী ক্যান্টনমেন্ট স্কুল এন্ড কলেজ থেকে পাকিস্তান শিক্ষাবোর্ডে তৃতীয় স্থান অধীকার করে তিনি ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেন। আই এস সি পাসের পর ১৯৭১ সালের মার্চে রুমী ভর্তি হন ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে (বর্তমান বুয়েট), এছাড়া বিশেষ অনুমতি নিয়ে ঢাকা ভার্সিটির অর্থনীতি বিভাগে ক্লাস করতেন এই তুখোড় বিতার্কিক।

এরপর আমেরিকার ইলিনয় ইন্সটিটিউট অব টেকনোলজিতে সুযোগ পেলেও আসহায় মাতৃভূমি কে রেখে নিশ্চিত সুখের স্বর্গে যেতে মন সায় দেয় নি আমাদের রাজপুত্রের।অসম্ভব প্রাণচঞ্চল রুমী দেশের মুক্তি চেয়েছেন, ব্যক্তিগত সুখ না। তুখোড় বিতার্কিক রুমী যুদ্ধের শুরুর থেকেই যুদ্ধে যাওয়ার ব্যাপারে মায়ের অনুমতি নেওয়ার জন্য নানান যুক্তি দেখান আর মা ও এড়িয়ে যান বিভিন্ন অজুহাতে। "আম্মা, দেশের এ রকম অবস্থায় তুমি যদি আমাকে জোর করে আমেরিকায় পাঠিয়ে দাও, আমি হয়তো যাবো শেষ পর্যন্ত। কিন্তু তাহলে আমার বিবেক চিরকালের মতো অপরাধী করে রাখবে আমাকে। আমেরিকা থেকে হয়তো বড় ডিগ্রী নিয়ে এসে বড় ইঞ্জিনিয়ার হবো কিন্তু বিবেকের ভ্রুকুটির সামনে কোন দিনও মাথা উচু করে দাঁড়াতে পারবো না। তুমি কী তাই চাও,আম্মা? " রুমীর এই আবেগী কথায় মা আর না বলতে পারেন নি! " যা, তোকে দেশের জন্য কোরবানি করে দিলাম" বলে বিদায় দেন তিনি! ১৯৭১ এর ১৯ এপ্রিল মাকে রাজি করিয়ে ২ মে সীমান্ত অতিক্রম করার চেষ্টা করেন। প্রথম চেষ্টা তে ব্যর্থ হয়ে পরবর্তী চেষ্টা তে ভারতে প্রবেশ করেন।

খালেদ মোশাররফ ও রশিদ হায়দারের সেক্টর-২ এর অধীনে মেলাঘরের প্রশিক্ষণ নিয়ে ছেলেটি ঢাকায় ফিরে এসে ক্র্যাক প্লাটুনে যোগ দেয়। এরপরেই শুরু হয় তার আসল খেলা;পাকিদের রক্ত নিয়ে খেলা! তার দলের ঢাকায় আসার অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য ছিল সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন হামলা করা এবং তারা তা সফলভাবে শেষও করে। ক্র্যাক প্লাটুন হল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে গেরিলা আক্রমণ পরিচালনাকারী একটি সংগঠন। রুমী ও তার দলের ঢাকায় আসার অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য ছিল সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন হামলা করা। এ সময় তাকে ঝুঁকিপূর্ণ আক্রমণ পরিচালনা করতে হয় যার মধ্যে ধানমণ্ডি রোডের একটি আক্রমণ ছিল উল্লেখযোগ্য। সেখানে একটি পাকিস্তানী সেনা জিপ তাদের বহনকারী গাড়ির পিছু নিলে তিনি গাড়ির পেছনের গ্লাস ভেংগে "'লুক লুক, এ জিপ ইজ ফলোয়িং আস "' বলে স্টেন গান ব্রাশফায়ার করেন। তার গুলিতে পাকিস্তানি জিপের ড্রাইভার নিহত হয় এবং গাড়ি ল্যাম্পপোস্টে যেয়ে ধাক্কা খায়। বেশ কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা তার গুলিতে মারা যায়। ধানমণ্ডি রোডের অপারেশনের পর রুমী তার সহকর্মীদের মাঝে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। 

১৯৭১ সালের ২৯ আগস্ট তিনি তাঁর নিজের বাড়িতে কাটান, এবং এই রাতেই বেশকিছু গেরিলা যোদ্ধার সাথে পাক বাহিনীর হাতে ধরা পড়েন। পাকিস্তান হানাদার বাহিনী একটি অজ্ঞাত উৎস থেকে তথ্য নিয়ে বেশ কিছুসংখ্যক যোদ্ধাকে গ্রেফতার করেন যার মধ্যে ছিলেন আলতাফ মাহমুদ, আবুল বারাক, আজাদ ও জুয়েল। রুমীর সাথে তার বাবা শরীফ এবং ভাই জামীকেও ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। জিজ্ঞাসাবাদের স্থানে রুমীকে ভাই ও বাবাসহ একঘরে আনলে রুমী সবাইকে তার যুদ্ধে জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করতে বলেন। তিনি ব্যাখ্যা করে বলেন যে, পাক বাহিনী তার কর্মকাণ্ড সম্পর্কে সচেতন এবং এর সব দায়-দায়িত্ব তিনি নিজেই নিতে চান। ৩০ আগস্টের পর রুমী ও তার সহযোদ্ধা বদী এবং চুল্লুকে আর দেখা যায়নি।

ইয়াহিয়া খান ৫ সেপ্টেম্বর ১৯৭১ সালে সাধারণ ক্ষমার ঘোষণা দিলেও তার মা জাহানারা ইমাম এবং বাবা শরীফ ইমাম পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর কাছে নিজের সন্তানের ইজ্জত ছোট করেনি; বীরদের কারো মাথা নোয়াতে নেই যে। আহ্নিক গতি,বার্ষিক গতির পরিবর্তন হবে, শীত গ্রীষ্ম কিংবা বর্ষা আসবে বারংবার কিন্তু ৪৮ বছর বয়সী বাংলাদেশ নামক ক্ষুদ্র একটা রাষ্ট্রে বসে আমরা আর একজন রূমী হওয়ার স্বপ্ন দেখবো না।মুক্তিযুদ্ধ ধারণ করে কেউ বেড়ে উঠবে না,প্রতিটি বাংলাদেশী তরুণ বলে উঠবে না,আই আই ওয়ান্ট টু বি অ্যা রুমী।আমার বোনেরা সবুজের বুকে রক্তাক্ত হয়ে পরে থাকবে লাশ হয়ে আমরা নির্বিকার হয়ে আর্জেন্টিনা- ব্রাজিল নিয়ে পরে থাকবো। প্রশ্ন ফাঁসের এই রমরমা সময়ে আমাদের আলোচনা বহুবিধ ও ভিন্নমুখী। আমরা এইসব রাজপুত্রদের প্রাণের বিনিময়ে পাওয়া দেশটাকে তাঁদের স্বপ্নের কাছাকাছিও নিয়ে যেতে পারি নি। ক্ষমা করবেন, রাজপুত্র। দূর আকশের তারা হয়ে এই ব্যর্থ হতে চলা প্রজন্মের জন্য প্রার্থনা করবেন আর জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানবেন। 

শুভ জন্মদিন, প্রিয় রুমী।

Leave a Comment