কিছু নারীর গল্পকথা 

  • ইল্লিনা হক বৈতরণী 
  • মার্চ ৩০, ২০১৮

ঘটনা ১: 

রাহেলার বয়স ১৮ কি ১৯। নিম্ন মধ্যবিত্ত ঘরের সন্তান সে। ছয় ভাইবোনের মাঝে সে সবার বড়। ইন্টারমিডিয়েটে ভর্তি হয়েছে এবার। কিন্তু তার বাবার সামর্থ্য বা ইচ্ছার কোনটাই নাই রাহেলার পড়া চালানোর। রাহেলার জন্য একটি বিত্তশালী পরিবার থেকে বিয়ের প্রস্তাব এসেছে। ছেলের বয়স ৩৪ তবে তার আগে একবার বিয়ে হয়েছিল। বাচ্চা হতে গিয়ে মেয়েটি মারা যায় আর সাথে তার গর্ভের সন্তানটিও। অনেক বছর হলো সে আর বিয়ে করেনি কিন্তু এবার তার মা পণ করেছে ছেলেকে বিয়ে করিয়েই ছাড়বে। অভাবী ঘরের সুন্দরী মেয়ে রাহেলা আসলো এই সংসারে বউ হয়ে। বিয়ের পর রাহেলা বুঝলো তার স্বামী নেশাগ্রস্ত। আর রাহেলাকে আনা হয়েছে তাকে সুস্হ জীবনে ফিরিয়ে আনার জন্য। রাহেলা সাধ্যমত চেষ্টা করলো এবং কিছুটা সফল ও হলো। সংসারে তার স্বামীর মন আসলো বেশ, টুকটাক ব্যবসা বানিজ্য ও করে। চার বছরের মধ্যে তাদের দুইটা ছেলে হলো। তবে রাহেলার ভাগ্য আর বেশিদিন সুপ্রসন্ন থাকলোনা লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত হয়ে মারা গেলো রাহেলার স্বামী বিয়ের সাড়ে পাচ বছরের মাথায়। রাহেলাকে শর্ত জুড়ে দিলো তার ভাসুর যদি সে ছেলেদের নিয়ে তার বাবার বাসায় চলে যায় তবে তার ছেলেরা কোন ভরণপোষণ আর সম্পত্তি পাবেনা, তার কথায় সায় দিলো রাহেলার শাশুড়ি আর পরিবারের বাকিরা। ছেলেদের কদর থাকলেও রাহেলার সাথে তাদের আচরণ বাড়ির সাহায্যকারীর মত । রাহেলার বাবা গরীব তাকে তার ছেলে সহ পালন করা সম্ভব না অগত্যা এই জীবন মেনে নিলো সে। তবে বাধ সাধলো সে যখন বুঝতে পারলো তার ভাসুরের কুনজর তার দিকে। 

গভীর রাতে ভাতিজাদের খবর নিতে আসার ছলে সে রাহেলাকে স্পর্শ করতে চাইতো রাহেলা বহু কষ্টে নিজের আভ্রু বজায় রাখার চেষ্টা করতো। বড় ভাইয়ের এমন কুমতলব বুঝতে পেরেছিলো রাহেলার ননাস তবে সে সেটা চেপে গিয়েছিল। রাহেলার শাশুড়ি, জা কাউকে বলে নি পাছে তার ভাই তার সুযোগ সুবিধা, বাচ্চাদের দামি গিফট দেয়া বন্ধ করে দেয়। রাহেলা তার মা-বাবাকে ব্যাপারটা জানালে তার রাহেলাকে ছেলেদের সহ নিয়ে আসতে চায় কিন্তু রাহেলার ভাসুর কানাকড়ি দিবেনা বলে জানায়। রাহেলা তার শাশুড়িকে তার ভাসুরের কীর্তি সম্পর্কে বলায় বিশ্বাস তো করেই নাই বরং তাকে বাসা থেকে বের করে দেয়া তারা। অগত্যা রাহেলার বাবা কঠোর সিদ্ধান্তে যান। রাহেলাকে এক ডিভোর্সী নিঃসন্তান লোকের সাথে বিয়ে দেন। অনেক চেষ্টার পর রাহেলা তার সন্তানদের আনতে পারেনি শাশুড়ির কাছ থেকে অবশ্য এটা সত্য বৃদ্ধা তার মৃত ছেলের সন্তানদের যক্ষের ধনের মত আগলে রেখেছেন। জীবন থেমে থাকেনি রাহেলার সুন্দর করে আবার সংসার শুরু করেছে, ভালো আছে খুব। একটাই কষ্ট ছেলেগুলো তার কাছে নেই। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ভাবে তাদের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করে সে। 

ঘটনা ২: 

মুন্নী গ্রামের মেয়ে। তার রাহেলার মত অবস্হা। রাহেলার বাবার মতো মুন্নির বাবাও না পড়িয়ে বিয়ে দিয়ে দেয়। মুন্নির স্বামী ঢাকাতে একটা ভালো চাকরি করে বিয়ের পর ঢাকা নিয়ে যায় মুন্নিকে। ছোট্ট একটা ফ্ল্যাটে তাদের সংসার। ঘরে আসে দুইটি মেয়ে। তারপর একদিন মুন্নির কপালে আসে চরম কষ্ট। তার স্বামী অফিস থেকে আসার পথে বাসের সাথে এক্সিডেন্ট করে মারা যায়। অফিস থেকে তেমন কোন টাকা পেলোনা মুন্নি। তার মেয়ে দুটি খুব ভালো ছাত্রী, ভালো স্কুলে পড়ে। কি করবে মুন্নি? তার বাবার অবস্থা ভালোনা চাকরি করে চলার মতো বিদ্যা নাই তার, ব্যবসা করার পুঁজি নাই। মফস্বলে তার শ্বশুড় বাড়ির বিশাল অবস্হা। শাশুড়িকে ফোন দিয়ে সাহায্য চাইতে উনি বলে উঠলেন দরকার নাই মেয়েদের এতো পড়ানোর, বাড়িতে গিয়ে তাদের সাথে থাকতে বললেন আরো বললেন কয়েক বছর পর ভালো দেখে মুন্নির মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দিবেন। সহজ কথায় মুন্নি কিছু পাবেনা। মেয়েদের পড়া কোনোভাবেই বন্ধ হতে দিবেনা সে। অগত্যা তাকে নিতে হলো কঠিন পথ। ষাটোর্ধ এক বিত্তবান বিপত্নীক ভদ্রলোকের বান্ধবী হলো সে, লোক তাকে অর্থ-বিত্ত সব দিয়েছে শুধু বিয়ে করেনি কারণ সমাজ আছে তার ছেলেমেয়েদের সংসার আছে বিয়ে করে প্রশ্নবিদ্ধ হবেনা লোক। মেয়েদের জীবনে কোন আাঁচ আসতে দেয়নি মুন্নি। মুন্নির মেয়েরা আজ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী। 
ঘটনা 

ঘটনা ৩: 

ইডেন কলেজ থেকে সমাজকল্যাণে মাস্টার্স করেছে জারা। মা-বাবা দেখে শুনে প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ীর সাথে বিয়ে দিয়েছে তার। এক ছেলে আর এক মেয়ে আছে তাদের। হঠাত্ একদিন জানতে পারলো তার স্বামীর প্রাইভেট সেক্রেটারির গর্ভে তার স্বামীর সন্তান, সেই মেয়ে অবিবাহিত, আত্মহত্যার হুমকি দিচ্ছে। তাই জারার স্বামী উপায় না দেখে সেই মেয়েকে বিয়ে করলো। জারা ফিরে আসলো মা-বাবার কাছে দুই সন্তান নিয়ে। ভালো একটি চাকরি যোগাড় করে নিয়েছে সে। সন্তান আর মা-বাবা নিয়ে ভালো আছে সে। শোনা যায় তার থেকে অল্প বয়সী এক যুবকের সাথে  অ্যাফেয়ার চলছে, ছেলেটি অবিবাহিত। জারা ছেলেমেয়ের কথা ভেবে বিয়েতে অনাগ্রহ দেখায়। মা-বাবার সাপোর্ট আর চাকরি নিয়ে সে তো ভালো আছে আর কিছু ভাবতে চায় না জারা এই মুহূর্তে। 

উপরের তিনটি ঘটনাই কাল্পনিক চরিত্র দিয়ে সাজানো। যদিও তারা সবাই আমার কল্পনাপ্রসূত তবে ামাদের সমাজে এইসব ঘটনা অহরহ ঘটছে। এটা সত্য যে পুরুষ শাসিত সমাজে মেয়েদের অবদমিত হওয়াটা এক চিরন্তন সত্য সে বিষয়ে আমি আজ আর যাবোনা। আমি ব্যাপারগুলোকে একটু অন্যভাবে ানতে চাই। রাহেলা, মুন্নি, জারা তারা সবাই হলো আমাদের সমাজে গল্পের খোরাক। সুযোগ পেলেও তাদের জীবনের অস্ত্রোপচার করে দেই আমরা। রাহেলা কি করে পারলো পেটের ছেলেদের রেখে আরেক জায়গায় বিয়ে করতে; মুন্নির মুখ দেখলেই ঘৃণা আসে রক্ষিতা একটা, ছিঃ জারা বিয়ে না করে পরপুরুষের সাথে ঘুরে বেড়ায়। সমালোচনা গুলো ভুল না, আমাদের মুখ আছে আমরা বলবো। আর এইসব কথা বলে বেশি সময় নষ্ট করে রাহেলা, মুন্নি আর জারার কাছের মানুষ আর নারী আত্মীয়রাই।  ভেবে দেখুন তো রাহেলার ননাস নিজের তুচ্ছ স্বার্থের কথা ভুলে নিজের মৃত ভাইয়ের বিধবা বউকে যদি সাপোর্ট করত, মাকে বলে একটা সম্মানজনক জীবন দিতে চেষ্টা করতো রাহেলা হয়তো ছেলেদের চোখের আড়াল করতো না। কি হতো মুন্নির শাশুড়ির তার মৃত সন্তানের মেয়েদের সুন্দর ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে কিছুটা সাহায্য করলে, তবে কি মুন্নি পারতো এই অনৈতিক সম্পর্কে যেতে আর প্রতিনিয়ত নিজের বিবেকের সাথে যুদ্ধ করতে? সেই প্রাইভেট সেক্রেটারি মেয়ে বসের কুনজর জেনে চাকরি ছাড়লে পারতো বা জারাকে জানাতে পারতো, সে সেটা করেনি কারণ উপরে উঠার সিঁড়ি তো সে পেয়েই গিয়েছে। 

কয়টা মানুষ, কয়টা নারী আত্মীয় এগিয়ে এসেছে এই তিন জনের পাশে। আর্থিক না পারুক মানসিক ভাবে সাপোর্ট ও দেয়নি তারা। উল্টো সুযোগ পেলে তাদের জীবন নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণে নেমে পড়ে কি হয়নি আর কি হলে ভালো হতো। কথাগুলো াসলে সত্য। মানুষের কথা কি বলবো আমি সংগ পেলে যে মানুষের ব্যক্তিগত সংকটাপন্ন জীবন নিয়ে মুখরোচক াড্ডা  দেইনি তা নয়। তবে আজকাল অনুশোচনা হয় এই ভেবে যে কেনো বুঝতে পারিনি মানুষের অন্তর্নিহিত কথা, তাদের মনের গহীনের ব্যথা। মানুষের জীবনের অসংগতি তো এমনিতে আসেনা। কেউ ইচ্ছা করে বিতর্কিত জীবন বেছে নেয়না, পরিস্থিতি তাকে বাধ্য করে।  কেউ জানে না ভবিতব্যে কি আছে। রাহেলা, মুন্নি ার জারার জায়গায় নিজেদের স্হলাভিষিক্ত করে নিবিড় ভাবে ভাবলে বোঝা যাবে তাদের জীবনযুদ্ধের কথা, তাদের অমসৃণ পথে হেঁটে যাওয়ার কথা! জানি কারো মনের গহীনে গিয়ে তার বেদনার কথা জানা অত সহজ নয় তবে চেষ্টা করতে তো দোষ নেই।  ছোটবেলায় পড়ছিলাম শরত্চন্দ্র অনিলা দেবী নাম নিয়ে লিখতেন। নারী নাম নিয়ে তার লেখার উদ্দেশ্য ছিলো বাংলার শ্বাশত নারীদের সাহিত্য পড়তে উদ্ভুদ্ধ করা। সারাদিনের খাটুনির পর বাংলার বধূরা ভাতঘুম না দিয়ে অনীলা দেবীর লিখা পড়বে। শরত্ বাবু ব্যর্থ ছিলেননা। আমার আম্মা যার বলার মতো কোন ডিগ্রি ছিলনা অথচ রবীন্দ্রনাথ, বংকিমচন্দ্র, শরত্চন্দ্র, কাজী নজরুল ইসলাম, ডেল কার্নেগী, ম্যাক্সিম গোর্কী প্রমুখের লেখনীর সাথে ছিলো সুপরিচিত, অনর্গল বলতে পারতো সুকান্ত ভট্টাচার্যের কবিতা। আমি তার ডিগ্রিধারী মেয়ে এসবের কিছুই জানি না আর জানলেও সেটা যত্সামান্য। আর তাই দুই কলম লিখতে গেলে মনে মনে ঘাম ঝড়াই। আমার মতো চুনোপুটির অভাব নাই কিন্তু কই পাই নাতো সুফিয়া কামাল, রাবেয়া খাতুন, নীলিম ইব্রাহিমের মত কাউকে। 

দায়ী করা যায় প্রযুক্তিকে। আমরা মেয়েরা খুব বেশি বাহ্যিক বিষয়াবলী নিয়ে ব্যস্ত এখন। কে কিভাবে সাজবে, কার কাপড়ের কত দাম, কাকে বেশি সুন্দর লাগছে, কোথায় জুয়েলারির এক্সিবিশন, সিরিয়ালে কোন নায়িকা কি পরছে আর অনলাইনে তা পাওয়া যায় নাকি এসব ঠুনকো বিষয় আলোচনাতে স্হান বেশি পায় সাথে তো আছে উপরিল্লিখিত সমস্যাগুলোর কাঁটাছেড়া। কিন্তু এই অসংগতিপূর্ণ সমাজে কাম, ক্ষমতা আর অর্থের স্বার্থ থেকে বেরিয়ে এসে একজন নারী পারে আরেকজন নারীর মনের শক্তির ঢাল হতে কখনো মা স্হানীয় হয়ে, কখনো বোন আমার কখনো প্রানপ্রিয় বান্ধবী হয়ে। ঘরে ঘরে এখন আমাদের মাস্টার্স পাস মেয়েদের অভাব নাই তবে অভাব াছে অনীলা দেবীর মতো মানুষদের ভক্তের। লোপ পাচ্ছে আমাদের মানবীয় গুণাবলী, চিন্তা করার ইচ্ছাশক্তি, বড় বেশি সমালোচনামূলক আমরা। অথচ আমাদের সবার আছে সুন্দর মন আর অনু্ভূতি বোঝার ক্ষমতা সেইটা আমরা ভুলে গিয়েছি। আমরা নারীরা চাইলেই হতে পারি নারীদের সত্যিকার শুভাকাংক্ষী।

 

Leave a Comment