মাতৃত্ব : পর্ব-৬

  • সুদীপ্তা ভট্টাচার্য্য রুমকি
  • মার্চ ৩১, ২০১৮

সম্প্রতি একজন চিত্রনায়ক কে দেখলাম ডিভোর্সের যুক্তিসঙ্গত কারন হিসাবে স্ত্রীর বিরুদ্ধে বিভিন্ন উদ্ভট অভিযোগের সাথে গুরুতর অভিযোগ এনেছেন তার মাতৃত্ব ও সন্তানের প্রতি দায়িত্বপালনে অবহেলা নিয়ে। প্রশ্ন টা নিয়ে আমার হয়তো তেমন কিছুই বলার ছিল না যদি তা সন্তানের প্রতি নিবেদিত প্রাণ কোন প্রকৃত বাবা করতো।কিন্তু যে নিজে থেকে পিতা হিসাবে একটা দায়িত্ব পালন করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করা দুরে থাক ইনিয়ে বিনিয়ে বাচ্চার জন্মের বৈধতা নিয়েও প্রশ্ন তুলতে ছাড়েনি,সে যখন তার সেই মুখে কোন মায়ের দায়িত্ববোধ নিয়ে প্রশ্ন তোলে,তখন খুব বেশি একপেশে আর নোংরা লাগে সমাজব্যবস্থাটা। অথচ এই মহামানব তা কোনদিনও করতে পারতো না যদি পরিবার,সমাজ সর্বোপরি আইন তাকে অসহযোগিতা করতো। ঘরে যদি চোর ডাকাত ঢুকে সন্তানের দিকে অস্ত্র তাক করে কষ্টার্জিত ধনসম্পদ চায় এবং চেঁচামেচি না করে তা দিতে বলে তখন মানুষ সেই চোর ডাকাতের চাহিদা পূরণে সচেষ্ট হয়,হাতে-পায়ে ধরে যেন এগুলোর বিনিময়ে হলেও সন্তানের কোন ক্ষতি না করে।

তেমনি একজন মা এর চোখের সামনে যখন সন্তানের ভবিষ্যৎ এর দিকে অনিশ্চয়তা তাক করে তার জীবনের যাবতীয় কষ্টার্জিত অর্জন,স্বপ্ন সাধ,পড়াশোনা,চাক রি,আত্মসম্মান সবকিছুর বলি চায় এবং টু শব্দ না করে তা দিতে বলে তখন একটা মাও সেই হাজব্যান্ড,শ্বশুর বাড়ির চাহিদা পুরনে সচেষ্ট হয়,হাতে-পায়ে ধরে যেন এগুলোর বিনিময়ে হলেও তারা তার সন্তানের ভবিষ্যৎ জীবনের কোন ক্ষতি না করে।সন্তান কে জিম্মি করা চোর ডাকাতকে যেমন মানুষ শ্রদ্ধা থেকে হাতে-পায়ে ধরেনা, ধরে অসহায় হয়ে ঠিক তেমনি এধরনের পরিবারের মানুষের কাছেও মানুষ শ্রদ্ধা থেকে মাথা নোয়ায় না,নোয়ায় অসহায় হয়ে । ছোট থেকে বাসায় যখন যে কাজের মাসি কাজ করতো তাদের বেশিরভাগেরই দেখতাম সংসার খরচ চালানো,বাচ্চাকাচ্চা মানুষ করাসহ যাবতীয় দায়িত্ব তাদেরই।এ নিয়ে তাদের হ্যাজবেন্ডের কোন মাথাব্যথা নেই।তারা ইচ্ছা হলে সংসারে দায়-দায়িত্বহীনভাবে থাকতো,না হলে অন্যকোথাও,অন্যভাবে, অন্য যে কারো সাথে নব আনন্দে জেগে উঠতে দ্বিধাবোধ করতো না।

কিন্তু যদি সাথে থাকতো দিনশেষে এই অকর্মার ঢেকির হাতে প্রায়ই মার খেয়ে পরের দিন সকালে আসত কাজ করতে।কেউ কেউ আবার স্ত্রী চাহিবা মাত্র সকল জিনিসের যোগান দিতে ব্যর্থ হলে মেরেধরে চলে যেত।কোন জবাবদিহিতা নেই,পিছুটান নেই।একটা ধারনা হয়ে গিয়েছিল নিম্নবিত্ত বলেই হয়তো এরা এমন।এখন বুঝি,যারা মনুষ্যত্বহীন তারা সমাজের যে স্তরেই থাকুক না কেন তারা এমনই হয়।আর প্রতিটা স্তরেই প্রশ্নের মুখোমুখি হয় মা। মনে আছে কলেজে পড়ার সময় একজন কাজের মাসিকে বলেছিলাম,সন্তান কি তোমার একার? ঐ লোকের কোন দায় নেই?দাও সন্তানকে ঐ লোকের কাছে,পালুক তখন বুঝবে কত ধানে কত চাল!!!আমার মা তখন আমাকে বলেছিল,না রে মা একটা মা কখনোই তার সন্তান কে দিয়ে দিতে বা ছেড়ে থাকতে পারবে না।

একটা বাবা পারে!জন্ম দিতে হয়না বলেই হয়তো পারে!তবে এত পাষন্ড কোন সভ্য মানুষ হয় না।তখন মায়ের কথায় বলেছিলাম তাহলে আর কি ঐ বদ লোক টা নোংরামি করে বেড়াক আর সে বাচ্চাকে নিয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে শেষ হয়ে যাক। অথচ এই আমিই এখন উপলব্ধি করতে পারছি আমার মায়ের কথাটা কতটা সত্যি যখন আমি নিজে একজন মা।মা হওয়ার আগে আসলেই বোঝা যায় না সন্তান কি জিনিস।এখন রাস্তায় একটা ভিক্ষুককেও যখন দেখি কাঁধে বাচ্চা চাপিয়ে ভিক্ষা করছে তখন আর অন্যদের মত মুখ দিয়ে বেড়োয় না কাঁধে বাচ্চা নিয়ে ভিক্ষা করছে সিমপ্যাথি আদায়ের জন্য।মনে হয় কতটা অসহায় হলে এভাবে পথে নেমেছে।তবুও তো সন্তানকে অবহেলা করেনি।একটা মায়ের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা তার সন্তান।মানুষ যেমন শখের বসে নিজের শরীর থেকে কোন অঙ্গ বাদ দেয়ার কথা কল্পনাও করতে পারে না তেমনি একটা মা ও তার জীবন থেকে তার সন্তান কে বাদ দেয়ার কথা ভাবতে পারে না। সে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকই হোক আর গৃহকর্মীই হোক।বিধাতা সকল প্রাণীর ক্ষেত্রে মাতৃত্ব বন্টনে অসমতা করেননি।কিন্তু পিতৃত্বটা মনুষ্যত্বের উপর ছেড়ে দিয়েছেন। 

একটা বিড়াল,কুকুরও যখন মা হয় সন্তান কে ছেড়ে যেতে পারে না। সেও পরম যত্নে সন্তান কে আগলে রাখে।অথচ সন্তানের প্রতি তার পুরুষ সঙ্গীর কিন্তু একবিন্দু দায়ও থাকে না।নারী পশুটি যখন নিজেকে আর সন্তানকে টিকিয়ে রাখতে প্রানপন লড়াই করে পুরুষটি তখন বিনোদনের আশায় নতুন নতুন সঙ্গী অনুসন্ধানে ব্যস্ত থাকে।তেমনি কিছু পুরুষ, নামে হয়তো মানুষ কিন্তু আচরণে তাদের সাথে পশুর আচরণের একটা দিকেও পার্থক্য খুঁজে বের করতে পারিনা।অবশ্য পশু কে তো বিধাতা সেই বোধশক্তি দেন নি,যেই বোধশক্তি মানুষ কে দিয়েছেন।কিন্তু সেই বোধ থাকার পরও যারা পশুর মত আচরন করে তাদের পশু বললে তো পক্ষান্তরে পশু কে অপমান করা হয়।প্রকৃত অর্থে এরা তো পশুর চেয়েও অধম।এরা হয়তো ভালবাসে, সজ্ঞানে বিয়ে করেই ক্ষ্যান্ত দেয় না, সাথে সাথে এদের সন্তানও চাই,সেটা ভালবাসার বাণী শুনিয়ে হোক আর জবরদস্তিতেই হোক।আমাদের দেশে সন্তান ধারনের ক্ষেত্রে সচেতন আর অচেতন উভয় প্রকার নারীর মতামতের মূল্য খুব একটা থাকে না যতই ইউটেরাসটা তার হোক।

সম্পর্কের প্রতি কোন প্রকার শ্রদ্ধা,ভালবাসা, মায়া না থাকলেও মাতৃত্বকে একটা মেয়ের জীবনে শুধুমাত্র প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির জন্য এরা ব্যবহার করে। পানিশমেন্ট স্বরূপ বিবেচনা করে বলেই সেচ্ছায় নিজের সকল প্রকার দায়-দায়িত্ব ত্যাগ করতে কুন্ঠাবোধ করেনা।পশুর মত নতুন বিনোদন লাভে সচেষ্ট হয়। তার মুহূর্তের এনজয়মেন্ট হয়তো, তার জীবনে মুহূর্তেই শেষ হয়ে যায় কিন্তু এর ফলটাকেই যখন কোন মেয়ে নিজের জীবনের সর্বোচ্চ ত্যাগের বিনিময়েও এচিভমেন্ট ভেবে নিয়ে বাঁচে তখন এধরনের স্বার্থপর পুরুষের হিসাব মিলে না।তখন তারা সেই মা টিকেই হেয় করতে উঠেপড়ে লাগে। পরিবার,সমাজ,আইনের যথেচ্ছ প্রয়োগ ঘটিয়ে তাকে টেনেহিচড়ে একের পর এক কাঠগড়ায় দাড় করায়। অথচ স্ত্রী,সন্তান কেউ তার জীবনে তার অজ্ঞানে উড়ে এসে জুড়ে বসেতে চায় নি,তার সজ্ঞানে তাদের আসার পিছনে তার নিজস্ব অবদানের ফলে এসেছে।অবদান মনে করতে না পারলেও এর পিছনে তার দায়টা অবশ্যই তাকে মনে করিয়ে দেয়া দরকার।কিন্তু কোথাও তো চোখে পড়েনা অবিসংবাদী পিতৃত্বের জবাবদিহিতা। দেখি জবাবদিহিতা শুধু মায়ের, দায়বদ্ধতাও শুধু তার একার মাতৃত্বের।পরিবার,সমাজ,আইন চোখে ঠুলি পড়ে জিতিয়ে দিক এধরনের পিতৃত্ব কে আর হেনস্থা করুক মাতৃত্ব কে। মাঝে মাঝে মনে হয়--
পশুর চেয়ে অধম হওয়া যদি জিতে যাওয়া হয়,
তবে হেরে যাও মেয়ে পাশবিকতার কাছে,
জিতে যাক মনুষ্যত্ব তোমার মানবিকতার ছাঁচে।

 

Leave a Comment