শহর থেকে দূরে (স্বাবলম্বী হওয়ার গল্প)

  • বৈতরণী হক
  • এপ্রিল ১১, ২০১৮

মাজহার সাহেব একজন সরকারী ব্যাংক কর্মকর্তা ছিলেন। তার স্ত্রী তাহেরা খাতুন গৃহিণী। এই দম্পতির তিন সন্তান। বড় ছেলে বিপু, তারপর মেয়ে শানু আর সবার ছোট ছেলে রিপু। মাজহার সাহেব চার মাস হলো অবসর গ্রহণ করেছেন চাকরি থেকে। বড় ছেলে একটা প্রাইভেট ব্যাংকে চাকরি করে, তার পোস্টিং চিটাগাং এ। বিপু চিটাগাং ইউনিভার্সিটি থেকে ইকনোমিক্সে মাস্টার্স করে দেড় বছর হলো জবে জয়েন করেছে। শানু জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনের একটি কলেজ থেকে ইতিহাসে সবেমাত্র মাস্টার্স পাস করলো। সে এখন চাকরি খুঁজছে। আর রিপু খুলনা ইউনিভার্সিটিতে জেনেটিক্স ডিপার্টমেন্টে ৩য় বর্ষের ছাত্র। রিপু ছাত্র হিসেবে খুব ভালো। ওর বাইরে সেটেল করার ইচ্ছা।

মাজহার সাহেব মানুষ টা খুব সৎ। সারাজীবন বৈধভাবে টাকা উপায় করেছেন। সন্তানদের বিলাসী জীবন দিতে পারেন নাই যেখানে তার অনেক কলিগরাই পেরেছে। এখন চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার পর হাজারোটা বিষয় তাদের সামনে আসছে আর তারা চিন্তা করছে ভবিষ্যত নিয়ে। স্বামীর বৈষয়িক বিষয়ে উদাসীনতা তাহেরাকে সবময় পীড়া দিয়েছে। তাদের ছেলেদের নিয়ে চিন্তা না থাকলেও শানুকে নিয়ে চিন্তা। শানু দেখতে শুনতে ভালোনা, লেখাপড়াতেও ভালো ছিলোনা তেমন, আজকালকার মেয়েদের মতো অতো স্মার্ট ও না। মাজহার সাহেবের পেনশনের টাকা অল্প কিছু জমানো টাকা দিয়ে ফ্ল্যাট কিনবেন না ছেলেমেয়ের বিয়ে দিবেন ভেবে পাচ্ছে না তাহেরা, সরকারি বাসাটা তো আর কয়েক মাস পর ছেড়ে দিতে হবে। 

এমন এক আলোচনার সময় মাজহার সাহেব বললেল: এতো ভাবছো কেন? বিপু চাকরি করে আর ব্যাংক লোন ও পাবে আমরা তিন বেড রুমের একটা ফ্ল্যাট কিনে চলে যাবো। আপাতত কিছুদিন ভাড়া থাকি।

তাহেরা: আচ্ছা দেখো বিপুর আর কত বা বয়স। এমন সময় ওকে লোনের বোঝা দেয়াটা আমাদের কি ঠিক? আমরা শুধু শানুর বিয়ে নিয়ে ভাবি বিপুর ও বিয়ের বয়স হয়েছে। সবাই তো আমাদের সন্তান। ওর যে আয় নিজের সংসার চালাবে নাকি আমাদের টানবে! আর রিপুটাও তো অনেক ছোট। আমি চাইনা ছেলেটাকে এতো চাপ দিতে। মাজহার সাহেব ও ব্যাপারটা বুঝে চুপ করে গেলেন।

এভাবেই চলে যাচ্ছিল তাদের দিনগুলো টানাটানির মধ্য দিয়ে। বাসা খুঁজছে তারা কারণ হাতে বেশি সময় নেই। এমন একদিনে খবরের কাগজে তাহেরা একটি অ্যাড দেখলো। ঢাকার বাইরে গাজীপুরে একটা বাংলোবাড়ী বিক্রি হবে সামনে অল্প জায়গা সহ আর একটা ছোট পুকুর সহ। বাড়ীর মালিক কানাডা প্রবাসী। জরুরি টাকা লাগবে বলে নামমাত্র দামে সব বিক্রি করতে চায়। তাহেরা মিলিয়ে দেখলো ঢাকা শহরে গলির ভিতরে তিন বেডের বাসা কিনতে যে টাকা লাগবে আর লোনের বোঝা আসবে কাঁধে তার থেকে এই বাড়ী কিনা ভালো। বাসার সবার সাথে আলাপ করলো। মাজহার সাহেব বরারবর এসব বিষয়ে উদাসীন তবে ছেলেমেয়েরা কেউ রাজি না। ঢাকাতে তাদের বাসা থাকবে না এ কেমন কথা! বিপু মনে মনে ভাবে তার প্রেমিকা সিলভীর বাবা তো কোনভাবেই রাজি হবেনা তাহলে তাদের বিয়েতে।

তাহেরা নাছোড়বান্দা সে যাবেই গাজীপুরে। রিপু একটু বেশি মা ভক্ত। তাই তাহেরা তাকে নিয়েই সব ফরমালিটিস সারলো। চটপটে স্মার্ট ছেলে রিপু, সব সামলে নিলো। তারপর একদিন তল্পিতল্পা গুটিয়ে তারা গাজীপুর আসলো। জায়গাটা আসলে সুন্দর ঢাকার বাইরে এই যা আর কি! অতঃপর ছেলেরা যার যার মতো চলে গেলো। মাজহার সাহেব নিজের মত করে বই পড়া আর টিভি দেখা নিয়েই ব্যস্ত। শানুর মন খারাপ বেশ, সবার থেকে দূরে আসতে হলো। কি করবে এখানে এসব ভেবেই মায়ের উপর খুব রাগ হচ্ছিল।

তাহেরার ছোট ভাই বেলায়েত। বয়স ৫০। বিপত্নীক আর নিঃসন্তান। আগে মাগুরার এক গ্রামে প্রাইমারি স্কুলের হেডমাস্টার ছিলো এখন কিছু করেনা, বাড়িতে থাকে আর টুকটাক চাষাবাদের কাজ করে। তাহেরা তাকে গাজীপুরে ডেকে পাঠালো। তাহেরা বেশি লেখাপড়া জানেনা কিন্তু বুদ্ধিমতী। সে বুঝে প্ল্যান করেই এখানে বাড়ি কিনেছে। তাহেরা আসার পর সকালে হাঁটতে যায়, আশেপাশের মানুষদের সাথে পরিচিত হতে থাকে। সে খেয়াল করে যে অনেক স্কুল কাছেপিঠেই। শানুকে জোর করে টিচার হিসেবে অ্যাপ্লাই করার জন্য। এরপর দুতিনটা স্কুলে ইন্টারভিউ দেয়ার পর একটা স্কুলে শানুর চাকরিও হয়ে যায়।

তাহেরা বেশ অবস্থাশালী পরিবারের মেয়ে ছিলো, বিয়ের সময় বেশ গয়না পেয়েছিলো বাপের বাড়ি থেকে। ছেলেমেয়েদের জন্য অনেকটা বিক্রি করেছে যা অল্প আছে তা রেখে দিয়েছে শানুর জন্য। কিন্তু না তাহেরা মত বদলেছে। বেলায়েতকে নিয়ে সে কাউকে না বলে গয়নাগুলো বিক্রি করে দিলো। সে টাকা দিয়ে দুইটা গরু, কয়েকটা হাঁসমুরগী কিনলো আর বাসার একটু দূরে সেগুলো লালন পালনের ব্যবস্থা করলো লোক দিয়ে, সামনের পুকুরে মাছ ছাড়লো, সামনের খালি জায়গায় কিছু সবজি আর ফলের গাছ লাগানো হলো। বেলায়েত সব তদারকি করছিলো আর তাহেরা শিখে নিচ্ছিলো। প্রথমদিকে বাসার সবাই রাগ করলেও যখন দেখলো বাজার খরচের টাকা উঠে আসছে, তখন সবাই ঠান্ডা হতে লাগলো। বিপু মাকে সংসারের জন্য যে টাকা দিতো তার কিছু অংশ রেখে বাকিটা জমাতো তাহেরা ছেলের বিয়ের খরচের জন্য।

স্কুলে পড়াতে গিয়ে শানুর আত্মবিশ্বাস বেড়েছে। ঢাকাতে এতো প্রতিযোগিতার মধ্যে সে ভয় পেতো, নিজেকে গুটিয়ে রাখতো। এখন ভালো লাগে বাচ্চাদের পড়াতে, সে আনন্দ পায়। আস্তে আস্তে কিছু কিছু বাচ্চা তার কাছে পড়তেও আসে বাসায়। শানু নিজের হাত খরচের টাকা রেখে বাকিটা মাকে দিয়ে দেয়। তাহেরা কিন্তু মেয়ের টাকা খরচ করে না খুব দরকার না হলে। শানুর টাকা ও জমছিলো ব্যাংকে। শানুর বিয়ে শানুর টাকাতেই হোক সেটা উনি চাইতেন। 

প্রথম কয়মাস লসে গেলেও আস্তে আস্তে তাহেরা খামার বাড়তে থাকে। তাহেরা পাশের গ্রামে মানুষদেরকে খামারের কাজের দায়িত্ব দিয়ে দেয় আর সে তদারকি করে। ভালোভাবে চলছিল তাহেরাদের জীবন। এদিকে শানুর ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা বাড়াতে আয় ও বাড়লো শানুর। 
এর মধ্যে কেটে আড়াই বছর। শানুর সাথে বেশ ভালো সম্পর্ক গড়ে উঠেছে তার ছাত্রীর চাচা মাহতাবের। মাহতাব টেক্সটাইল ইন্জিনিয়ার, গাজীপুরে একটা গার্মেন্টস ফ্যাক্টিরিতে চাকরি করে। শানুর সাথে বিয়ের কথা চলছে। শানুর বিয়ে দিয়ে বিপু বিয়ে করবে সবকিছু আরেকটু গুছিয়ে। ওদিকে রিপুর অনার্স শেষ সে ডেনমার্কে পড়তে যাওয়ার একটা সুযোগ পেয়েছে। বোনের বিয়ে হলেই সে চলে যাবে...

ঢাকা শহরের বুকে একটা ফ্ল্যাট কিনে লোনের বোঝা চাপাতে চায়নি তাহেরা ছেলেমেয়েদের উপর। সব বাচ্চারা বড়, স্কুল কলেজের ঝামেলা নেই শহর থেকে দূরে এসে উপার্জনের ব্যবস্থা করেছে তাহেরা তার বুদ্ধির জোড়ে। তার ছেলে বিপুকে উনি সুযোগ দিয়েছেন নিজের ভবিষ্যত গড়ার জন্য টাকা জমানোর, মেয়ে শানুকে করেছেন আত্মবিশ্বাসী। উনি মেয়ের টাকা দিয়েই মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন কারণ উনার কাছে উনার সব সন্তান সমান। শানু সুন্দরী না, লেখাপড়ায় ভালো না, স্মার্ট না উপহার নামক যৌতুক দিয়ে তাহেরা মেয়েকে পার করতে চায়নি, চেয়েছে স্বাবলম্বী করতে। শহর থেকে দূরে এসে তাদের জীবনযাত্রার মান নীচে নেমে গিয়েছে এমন কথা কম শোনেনি মানুষের কাছে। তাহেরা কারো কথা শুনে উনার সিদ্ধান্ত ত্যাগ করেননি। 

তাহেরা আত্মপ্রত্যয়ী, বুদ্ধিমতী মহিলা। সব সন্তানের প্রতি তার সমান ভালোবাসা। ছেলে বলে দায়িত্ব বেশি নিবে আর মেয়ে তার সুফল ভোগ করবে উনি সেই নীতিতে বিশ্বাসী না। তাহেরা একজন সংগ্রামী নারী যার মনোবল ার আত্মপ্রত্যয় বদলে দিয়েছে একটা পরিবারের চিত্র। হয়তো তাহেরার ঢাকার বুকে ফ্ল্যাট নাই, আয় করতে হয় খামার থেকে তাও যাতে অনেকের নাক সিঁটকে যায় কিন্তু তার কোন আফসোস নাই। তাহেরার কাছে সবথেকে বড় সুখ হলো তার সন্তানদের সুখ, তার সন্তানরা সবাই ভালো আছে একজন মা হিসেবে উনার এটা সবথেকে বড় সাফল্য।
 


 

Leave a Comment