সব স্বামীই শুধু স্বামীই হয় না, কিছু স্বামী বন্ধু এবং সহযোগীও হয়!

  • ফারজানা আক্তার 
  • এপ্রিল ২৫, ২০১৮

প্রতিটা মেয়ের কাছে সংসার হচ্ছে স্বপ্নের মতো। সবাই তার নিজের মতো করে একটা সংসার চায়। নিজের হাতে নিজের সংসার সাজিয়ে নিতে চায়। স্বামীকে তার সহযোগী হিসেবে পেতে চায়!! কিন্তু বেশিরভাগ স্বামীগুলো না হয় বন্ধু, না হয় সহযোগী, তারা সবসময় স্বামীই হয়ে থাকে। স্বামী মানেই যে খারাপ কিছু, স্বামী মানেই যে অত্যাচারী সেটা কিন্তু নয়। আমাদের সমাজ, সমাজের মানুষজন স্বামী নামের মানুষটিকে একটু অন্য জায়গায় স্থান দিয়ে রেখেছে। তারা ধরেই নিয়েছে স্বামী মানেই পায়ের উপর পা তুলে পেপার পড়া, স্বামী মানেই তার পিছনে স্ত্রীকে ২৪/৭ সেবা যত্ন নিয়ে লেগে থাকা, স্বামী মানেই স্ত্রীকে একের পর এক হুমুক করা, স্বামী মানেই তার মন যখন যা চাইবে স্ত্রীর উপর এপলাই করা ইত্যাদি এবং আরো নানান কিছু। সব স্বামীই কিন্তু স্বামী হয় না, কিছু কিছু স্বামী বন্ধু এবং সহযোগীও হয়।

রিয়া (ছদ্মনাম) তেমনি একজন স্বামী পেয়েছে। রিয়ার স্বামী রাসেল (ছদ্মনাম) খুবই ভালো মানুষ। রিয়া আর রাসেল সুন্দর জুটি এবং সুখীও বটে। কিছু কিছু মানুষের কপালে সুখ জুটে কিন্তু স্থায়ী হয় না। রিয়ার কপালও তেমনই একটি কপাল। ভালো স্বামী পেয়েছে কিন্তু শশুরবাড়ি পেয়েছে ঠিক স্বামীর উল্টোটা। অনেকে বলে স্বামী ভালো হইলেই হয়, অন্যকিছু দেখতে হয় না। কিন্তু আসলে কি এই কথাটা সবসময় ঠিক? আগেই বলেছি রিয়ার স্বামী রাসেল খুব ভালো মানুষ। রাসেল শুধু ভালো স্বামীই না, একজন ভালো সন্তান, ভালো ভাই এবং ভালো দেবরও। একটি মানুষ কখনোই সবার মন যুগিয়ে চলতে পারে না। রাসেল সবার ক্ষেত্রে নিজের সর্বোচ্চটা দিতে চায় কিন্তু ভিন্ন ভিন্ন চিন্তা ভাবনার মানুষের ক্ষেত্রে এটা কি আদৌ সম্ভব হয়?

রিয়া একজন শিক্ষিত মেয়ে। বিয়ের আগে থেকেই চাকরি করতো। বিয়ের আগে রিয়া বলেছিলো সে তার চাকরি চালিয়ে নিয়ে যেতে চায়। রাসেলের পরিবার সম্মতি দিয়েছিলো। কিন্তু বিয়ের পর সবকিছু হঠাৎ করে কেমন বদলে গেলো! রাসেলরা ৩ভাই, ২বোন। ভাইদের মধ্যে রাসেল ছোট আর দুইটি বোন সবার ছোট। বড় দুই ভাইয়ের আগেই বিয়ে হয়ে গেছে। দুই ভাই চাকরি করে আর তাদের বউয়েরা সারাদিন সিরিয়াল নিয়ে ব্যস্ত থাকে। ছোট বোনদের একজন ক্লাস ৯ এবং অন্যজন ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারে পড়ে। দুই বোন সারাদিন ফোন নিয়ে ব্যস্ত থাকে। রাসেলের মা ব্যস্ত থাকে আশেপাশের ভাবীদের নিয়ে। রাসেলের পুরো পরিবারই রিয়ার কাছে কেমন এলেমেলো লাগছিলো। এই পরিবারে শুধু রাসেলের বাবাকে রিয়ার একটু অন্যরকম মনে হলো। সম্প্রতি তিনি রিট্রায়েড করেছেন। সারাদিন বই আর ছাদের নিজের ছোট্ট বাগানে সময় কাটান।

রিয়া ধরে নিয়েছিলো প্রথম প্রথম সবার সাথে মানিয়ে নিতে একটু কষ্ট হবে। ধীরে ধীরে ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু আসল সমস্যা দেখা দিলো বিয়ের পর যেদিন প্রথম শশুরবাড়ি থেকে অফিসে গিয়েছিলো সেদিন। সকালে ঘুম থেকে উঠে তাড়াহুড়া করে সবাইকে চা দিলো রিয়া। তারপর শাশুড়ি আর শশুরকে বললো তার আজকে ছুটি শেষ। আজকে থেকে অফিসে যাবে। শশুর অনুমতি দিলো কিন্তু শাশুড়ি মুখ গোমড়া করে বসে থাকলো। কিছুই বললো না। রিয়া যখন রেডি হয়ে নাস্তার টেবিলে বসলো তখন তা জা'য়েরা বললো, রিয়া অফিসে গেলে রিয়ার ভাগের কাজ কে করবে? বাসায় যেহেতু তিনজন বউ তাই ঘরের কাজ তিন বউকে মিলেই করতে হবে। একজন চাকরি করে পায়ের উপর পা তুলে খাবে সেটা হবে না।

রিয়া অবাক হয়ে সবার দিকে তাকিয়ে ছিলো, কিন্তু কেউ কিছু বললো না। রিয়া সবথেকে বেশি অবাক হয়ে রাসেলের দিকে তাকিয়ে ছিলো। রাসেল চুপচাপ নাস্তা খেয়ে যাচ্ছিলো। রিয়া খাবার টেবিল থেকে উঠে নিজের ঘরে চলে গেলো। রাসেল নিজের নাস্তা শেষ করে ঘরে আসলো। রিয়া জানতে চাইলো কেন রাসেল কিছু বললো না! রাসেল বললো তার ভাবিরা কম শিক্ষিত কিছু বুঝে না। তাই কি বলতে কি বলে ফেলেছে, ঐসব নিয়ে যেনো রিয়া মন খারাপ না করে! রিয়া অবাক হয়ে গেলো এই কথায়! যারা কম শিক্ষিত তারা কিছু বুঝে না! আর কম শিক্ষিত মানুষদের কথায় কিছু মনে করা যাবে না! রিয়ার শাশুড়িও যে অফিস নিয়ে কিছু বলে নি সে কথাও রাসেলকে বললো রিয়া। রাসেল তখনও বললো মা'র বয়স হয়েছে। তার কোনো কথা বা ব্যবহারে কিছু মনে কইরো না।

রিয়া সেদিনের মতো অফিসে গেলো। বিয়ের পর প্রথম অফিসে আসা। অফিসের সব কলিগরা নানা রকম মজা করছে কিন্তু রিয়াকে সেসব মজা স্পর্শ করছে না। কেমন যেন এক অজানা আতংকে বারবার মন কেঁপে উঠছে। অফিস থেকে ফেরার পথে রিয়া সবার জন্য টুকিটাকি কিছু খাবারদাবার নিয়ে বাসায় আসলো। খাবার দেখে বাসার সবাই খুশি হলো। সকালের কালো মেঘটা রিয়ার মন থেকে চলে গেলো। সবার হাসিখুশি মুখ থেকে রিয়ারও অনেকটা হালকা লাগছিলো। পাশ থেকে রিয়ার বড় জা বললো দুপুরে আর সকালে তারা দুইজন রান্না করেছে। রিয়া যেহেতু অফিস করে তাই রাতের রান্নাটা রিয়ায় করবে। সকালে আর দুপুরে রিয়াকে রান্না ঘরে যেতে হবে না। রিয়ার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়লো! বিয়ের পর আজকে প্রথম অফিস তাই আজকে সন্ধ্যার পর পর চলে এসেছে। ম্যাক্সিমাম সময় ৮টার আগে অফিস থেকে বের হতেই পারবে না, এর মধ্যে ঢাকার বিখ্যাত জ্যাম তো রয়েছেই। তারপর এতো মানুষের রান্না!!!

এই বাড়ির কেউ চায় না রিয়া চাকরি করুক। সবাই চায় তারা যেমন রিয়াও যেন তাদের মতো হয়। কিন্তু মাস শেষে বেতনের টাকা হাতে পাওয়ার সাথে সাথে সবার আবদার শুরু হয়ে যায়। রিয়া যেহেতু চাকরি করে তাই তার পোশাক, চলাফেরায় কিছুটা ভিন্নতা রয়েছে। এই নিয়েও জা'য়েদের হিংসার টিপ্পনীর শেষ নেই। রিয়া এই বাড়ির সবার মনের কথা বুঝতে পেরেছে কিন্তু এক রাসেল কি চায় সেটাই বুঝতে পারে নি। রাতের রান্নার ভার রিয়ার কাঁধে! রাসেল শুনে বলেছে , "চাকরি করো, সংসারও তো করতে হবে। সংসারের কাজের ভাগ না নিলে চলবে?" রিয়া নিজের টাকায় একজন কাজের মেয়ে নিলো যেন তার ভাগের সকল কাজ ওই মেয়েটাই করে দেয়। কিন্তু কথায় আছে না, "ঘোড়া দেখলে খোঁড়া রোগ হয়!" এই বাড়ির সবার হয়েছে সেই অবস্থা! কাজের মেয়ে আসার পর থেকে সবাই যার যেভাবে ইচ্ছে তাকে সেভাবেই খাঁটিয়ে নিচ্ছে। রিয়ার ভাগের কাজ আলাদা করে নেওয়ার সুযোগই সেই মেয়ে পায় না।

কি ভাবছেন? রিয়া এই সংসার থেকে চলে যাবে বা স্বামীকে নিয়ে আলাদা হয়ে যাবে?না! কোনো মেয়েই তার সংসার ভাঙ্গতে চায় না, অনেক মেয়েই আলাদা থাকতে চায় না কিন্তু প্রতিটা মেয়েই সহযোগিতা চায়। তার নিজের কাজের সাপোর্ট চায়, অনুপ্রেরণা চায়। কোন মেয়েই চায় না তার স্বামীকে অন্যের কাছে খারাপ হোক, কিন্তু প্রতিটা মেয়ে চায় তার স্বামী তার প্রতি হওয়া অন্যায়ের প্রতিবাদ করুক। বেশিরভাগ মেয়েই চায় না তার স্বামী তার শশুর শাশুড়ি থেকে আলাদা হয়ে যাক, কিন্তু প্রতিটা মেয়েই চায় তার স্বামী তার পাশে এসে দাঁড়াক। স্বামী তো শুধু একজন স্বামী নয়, স্বামীর পাশাপাশি তিনি একজন বন্ধু, সহযোগী, অনুপ্রেরণা এবং একজন বউয়ের সবথেকে শক্তিশালী খুঁটি।

সবার কাছে ভালো থাকতে যেয়ে কোনো একজনের জীবন একেবারে বিষিয়ে দিবেন না। বরং সবাইকে ভালো রাখতে চাইলে অন্যায়ের প্রতিবাদ করুন। অন্যায়কারী যেই হোক , হোক সে আপনার মা কিংবা আপনার বউ! অন্যায়ের প্রতিবাদ করেন আর যার পাশে সত্যি সত্যি দাঁড়ানো দরকার তার পাশেই দাঁড়ান। সত্যিকারের সুখ তখনই সংসারে আসবে। বউকে সবসময় ভিলেন ভাবার কারণ নেই কারণ সব বউরা সংসার ভাঙ্গে না। কিছু কিছু বউ নিজের হাতের সবাইকে নিয়ে নিজের সংসার গড়েও তুলে।

 

Leave a Comment