শেষ ডুব

  • শাইরা জাহান সৌধ
  • এপ্রিল ২৬, ২০১৮

দক্ষিণের ঘরটা থেকে পুকুরঘাট টা কিছুটা আবছা দেখা যায়। খোলা জানালা দিয়ে অরুনিমা একঠাঁয় তাকিয়ে আছে বাড়ির পেছন দিকটায়। কি যেন খুঁজছে...হয়তো ছোটবেলার  কোন টুকরো গল্প আছে এখানটায়। এইতো এই বাড়ি,,এই উঠোন,, এই পুকুরঘাট,, এই লেবু বাগানে কতশত ছবি আঁকা আছে! চোখ বুজলেই এসে ধরা দেয় যেন! দুপুরবেলা ভাতঘুম ফাঁকি দিয়ে পাশের শিঊলীদের বাড়িতেই তো যেতো ও খেলতে। ধরা পড়ে কতো বকুনিই না খেতো দুজনে মিলে। এই পাড়ার জাম,কানাই কাকার বাগানের জলপাই-বড়ই, তেতুলে ভরা ছিল সেই বেণী দুলিয়ে দাপিয়ে বেড়ানো দুপুরগুলো.. মাস্টারমশাই 'র হাত থেকে বাঁচবার অজুহাত তও ছিল প্রায় আওড়ানো বুলি.. আজ পেটে কামড়ায় তো কাল মাথার ব্যামো! 

হঠাৎ যেন ছোটবেলা পেয়ে বসে অরুকে.......তবে ছোট্ট দীর্ঘশ্বাসে ভর করে এই নিস্তব্ধ সন্ধ্যায় ফেরত আসতে বেশি সময় নেয় না ও। হয়তো এখন শিউলি নিজেই দু-চারটে বসিয়ে দেয় ওর মেয়েকে এই একই ঘটনারজন্য.....। কাল অরুনিমা'র বিয়ে। বাবা মা চলে যাবার পর কাকা কাকী'র অন্ন ধ্বংস করা ছাড়া তেমন আর কোন কাজ নেই ওর। তাই সেদিন যখন কাকী মা এসে বলছিলেন.."নে বাপু এবার বিয়ে করে বিদেয় হ দেখি! তোর কাকা তো আর। ধর্মশালা খুলে বসেনি! আর কতকাল বসে বসে পেটপূজো করবি! আর হ্যাঁ শোন বাড়ির দলিলটা তে সই করে দিস দেখি একখানা,,,তোকে ঘাড় থেকে নামাতে কম খরচা তো আর হলো না!! " কিচ্ছু বলেনি অরু.... শুধু দলিলটাতে সই করার সময়ে কোথা থেকে যেন কয়েক ফোঁটা বেয়াড়া জল এসে লেখাগুলোকে এবড়োথেবড়ো বানিয়ে দিচ্ছিলো। বিয়েতে দ্বিমত করেনি অরু।তার চিন্তা শুধু এক অগোছালো মানুষকে নিয়ে... কিছু কথা বলে যাওয়া প্রয়োজন মানুষটা কে।

এইযে,
শুনছেন। আজ শেষবারের মতো আপনাকে তুমি করে বলার অধিকার টা কি একটু দেয়া যায়? থাক নাই বা দিলেন.  কি আর হবে? আমার না পাওয়ার খাতায় আরো কিছু যোগ হলো নাহয়....। এর আগেও আপনাকে কিছু বলবো বলে আয়োজন করে বেশ ক' বার খাতা কলম নিয়ে বসেছিলাম বটে। কিন্তু তাদের আপনি পর্যন্ত পৌঁছানো হয়ে উঠেনি আর। সবগুলো নৌকা হয়ে জলে ভেসেছে যে! মনে নেই গত পূজোয় আপনি মিলে নৌকা ভাসিয়েছিলাম! নিষ্প্রান চিঠিগুলো আপনার ছোঁয়া পেয়েছিল ঠিক ই তবে নিজেকে মেলে ধরতে পারেনি.

কোন এক কলার ভেলায় ধাক্কা খেয়ে খেই হারিয়ে ফেলেছিল। আচ্ছা সত্যি করে একটা কথা বলবেন আমায়? কখনোই কি আমার চোখের জল দেখেননি আপনি অরুণ দা! নাকি শুধু নির্দিষ্ট কিছু অংশ থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছিলেন সন্তর্পণে? বিশ্বাস করুন...আমার চাওয়ার ফর্দ টা খুব বেশি লম্বা ছিলোনা! চেয়েছিলাম একটা ঝাঁকড়া চুলের লম্বামতন ছায়ার আড়ালে নিজেকে খানিকটা লুকিয়ে রাখতে। ধুলোমাখা রাস্তাটা আমাদের নি:শব্দ লুকোচুরির সাক্ষী হোক। এলোচুল গুলো উড়ে উড়ে শুধু আপনার মুখেই সযত্নে আছড়ে পড়ুক। আপনার দেয়া ফুলে চুল আটকাবো বলে খুলে রেখেছি কতকাল ধরে...।

আচ্ছা কেন এত জ্বালাতন আপনার? শুধু শুধু আপনার এই নিষ্পাপ সরল মুখটা চোখের সামনে কেন ভাসতে থাকে অনবরত? সেই কবে হেসে দু'একটা কথা বলেছিলেন আমায় তা কেন আনমনে আওড়াতে থাকবো আমি সারাটাক্ষণ! পুকুরের জলের মতন স্বচ্ছ চোখগুলো শুধু কি এক আদুরে ভঙ্গিমায় তাকিয়ে থাকে যেন আমার দিকে.. ঘুমোতে দেয়না এক ফোঁটাও! সারারাত শুধু কড়িকাঠের দিকে তাকিয়ে বড় পেট মোটা টিকটিকিটার আড়িপেতে পেটপূজো দেখতে দেখতেই কেটে যায়। কেন আমাকে এই দমবন্ধকর পরিবেশে আটকে থাকতে হবে বলতে পারেন? এই ভারী হয়ে যাওয়া নিশ্বাস,, দাঁত কামড়ে আটকে রাখা কষ্ট নিয়ে ও আমাকে হাসি হাসি মুখ করে থাকতে হয় জানেন? ভাগ্যিস চোখ দিয়ে যা আসে তা জল হয়েই ঝরে.. রক্ত হয়ে নয়। নয়তো কবেই রক্তশূন্য হয়ে যেতাম...। বিরক্ত হচ্ছেন? নাকমুখ কুঁচকে ঘন ভ্রু জোড়া প্রায় এক করে ভাবছেন বুঝি"এই পুচকে বোকার হদ্দটা কি আবোল তাবোল বকছে এসব! "আমি আর পুচকি অরু নেই.. যাকে আপনি মাকড়শা দেখিয়ে ভয় পাইয়ে দেবেন... মোটে তো বছর সাতেক'র বড় হবেন এই যা! অনেক বকবক তো হলো.. ভালো থাকবেন আপনি।চশমা আর হাতের ঘড়িটা বদলে ফেলুন এবার। আলমারিতে দিয়ে এসেছি সেদিন আর কিছু বড়া বানিয়ে পুটির মা'র কাছে দিয়ে এসেছি খেতে ইচ্ছে হলে বলবেন ও রেঁধে দেবে। আর.....!.... থাক না.. যা বলা হয়নি। কিছু অবাধ্য চোখের জলে লেখার অস্পষ্টতার জন্য ক্ষমা চাইছি।
ইতি,
জানেন বোধহয়

অনেকটা সময় পেরিয়ে গেল। তাড়াহুড়োয় মায়ের শাড়িটা পরতে গিয়ে মনে হলো আগে বাবা প্রায় বলতেন "''''কই গো অরু মা.... তোর মায়ের বিয়ের বেনারসি টা পরে সন্ধ্যে দে দেখি কেমন পারিস!"হুটোপুটি করতে গিয়ে কিশোরী অরু দুমদাম পড়ে যেত মাঝেমধ্যে। সাজ বলতে কাজল আর সিঁথিতে সিঁদুর ছোয়া। দু'বছর আগে দূর্গাপূজোয় গ্রামের মেলা থেকে চুপিচুপি আনিয়ে রেখেছিলো কাকাত বোন কে দিয়ে কৌটো টা। হাঁটছে অরুণিমা। চাঁদের আলোয় শুধু নিজের ছায়াকে সঙ্গী করে।

বাতাসে বাতাসে কেমন ফিসফাস শব্দ।অনেকদিন পর বাবা - মাকে দেখবে আজ অরু।মায়ের আঁচল তলায় লুকিয়ে থাকবে চুপটি করে।যেমনটা করতো ছোটবেলায় ভয় পেলে। শাণ বাধানো পুকুরঘাটে মন খারাপ করা হু হু হাওয়া।ধীরপায়ে এগোতে থাকে সর্বহারা এক মেয়ে। "এই অরু যাচ্ছিস কোথায়? পুটির মা'র রান্না আর মুখে রোচে না।রান্না বান্না সেরে সাজিয়ে গুছিয়ে রাখবিনা আমায়? ফুলগুলো যে অপেক্ষায় আছে তোর খোপায় জড়াবে বলে" গলা পানিতে এসে ঠান্ডা জলের স্পর্শে হঠাৎ সম্বিত ফিরে পায় অরু। পানির হালকা স্রোতে চাঁদটা যেন কাঁথার মতন ভাঁজ হয়ে আছে। কি সব ভাবছে সে! শেষ মূহুর্তে এসেও বুঝি মানুষ স্বপ্ন দেখে।চিরদিন মানুষটার গন্ধ বুকে নিয়ে ঘুমাবার স্বপ্ন। মা মা গন্ধ আসছে।আর একটু হলেই পৌঁছে যাবে ও। শেষবারের মত ভারী হয়ে যাওয়া শ্বাস নিয়ে ডুব দেয় সে।বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় সমস্ত যোগাযোগ। হিসেব নিকেশ। চিরদূখিনী এলোকেশী এবার নাহয় একটু শান্তিতে ঘুমোক। সব নিস্তব্ধ। থমথমে। অন্যকোন দিন হলে রিনরিনে গলায় কেউ গাইতো _"চাঁদের আলো বাঁধ ভেঙেছে.. উপচে পড়ে আলো ও রজনীগন্ধা তোমার গন্ধসুধা ঢালো । 

আর / এস 

Leave a Comment