উদ্যোক্তা আনে সাফল্য, দূর করে বেকারত্ব

  • নূসরাত জাহান স্বর্ণা
  • জুলাই ২৩, ২০১৮

আচ্ছা আপনার বাসার পাশে যে লোকটা চায়ের টং কিংবা মুদি দোকান চালায়, কখনো কি মনে হয়েছে তিনি শুধু একজন দোকানদারই নন, উদ্যোক্তাও বটে? গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি শতকরা ৯৫ জনের উত্তরই না-বোধক হবে। অথচ সঠিক দিক নির্দেশনা এবং সাহায্য পেলে তিনিও হতে পারেন একজন উদ্যোক্তা কিংবা এন্টারপ্রেনার! যেকোন সফল শিল্প বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সাফল্যের পিছনে রয়েছে একজন সফল উদ্যোক্তার গল্প। অথচ আমাদের বেশিরভাগেরই উদ্যোক্তা কিংবা entrepreneur নিয়ে কোন ধারণাই নেই। সহজভাবে আমরা বলতে পারি উদ্যোক্তা হলেন তিনি, উদ্যোগ নিবেন যিনি। মূলত কোন কিছু করার লক্ষ্যে কোন কাজ করাকে উদ্যোগ বলে। যেকোন প্রতিষ্ঠান শুরুর আগে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হচ্ছে সঠিক শিল্প ধারণার সূত্রপাত করা, আর এই সঠিক ধারণা কিংবা “idea” যিনি দিবেন তিনিই হলেন মূলত উদ্যোক্তা। 

বাংলাদেশর প্রেক্ষাপটে উদ্যোক্তাঃ আশার ব্যাপার এই যে বিগত ৩-৪ বছর যাবৎ আমাদের দেশে entrepreneurship বা নিজ উদ্যোগে কিছু করার প্রবণতা বেশ বৃদ্ধি পেয়েছে। একটা সময় মনে করা হত যারা স্কুল-কলেজ ড্রপ আউট হয় কেবল তারাই হয়ত এই ব্যাপারটা নিয়ে আগায়; যদিও সময়ের সাথে এটি ভুল প্রমাণিত হয়েছে। এখন শুধু ড্রপ আউটরাই নয় বরং আমাদের দেশের শিক্ষিত যুবক সমাজের একটি বড় অংশ এর দিকে ঝুঁকেছে। তারা এখন স্বাবলম্বী হওয়ার জন্য লেখাপড়া শেষ করে অন্যের দ্বারে চাকুরী খোঁজার চেয়ে নিজে উদ্যোক্তা হওয়াটাকেই পছন্দ করছে।
কৃষি উদ্যোক্তাঃ কৃষিপ্রধান এদেশে কৃষি এবং ‘entrepreneurship-বাণিজ্যিকরণ’ বেশ ভালভাবেই জড়িত। কৃষিতে বাণিজ্যিকরণ এখনো পশুসম্পদ এবং কৃষিফলন বৃদ্ধিতেই সীমাবদ্ধ, যদিও এর সম্ভাবনার ক্ষেত্র অনেক বেশি! প্রত্যেকজন খামারি, কৃষক এক-একজন উদ্যোক্তা। বাংলাদেশ এখন খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ, এর অনেকখানি কৃতিত্ব এই উদ্যোক্তাদের। বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক, ১৯৭৩ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে এখন পর্যন্ত নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে এদেশের কৃষি উন্নয়নের জন্য। সে ধারাবাহিকতায় ক্ষুদ্র কিংবা মাঝারি খামারিদের জন্য রয়েছে বিভিন্ন স্বল্পমেয়াদী ও মধ্যমেয়াদী ঋণ প্রদানের ব্যবস্থা। নির্দিষ্ট শর্ত পূরণের মাধ্যমে যেকোন কৃষক কিংবা খামারি এখান থেকে তার প্রয়োজনমতো সাহায্য নিতে পারেন। 

এছাড়াও ক্ষুদ্র ঋণ প্রকল্পের মাধ্যমে বিভিন্ন ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীদের সহজ শর্তে ঋণ দিয়ে থাকে গ্রামীণ ব্যাংক, এছাড়াও রয়েছে পল্লী উন্নয়ন ব্যাংক, বাংলাদেশ কর্মসংস্থান ব্যাংক, আনসার-ভিডিপি উন্নয়ন ব্যাংক, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ব্রাক। কাজেই আপনি যদি একজন কৃষি উদ্যোক্তা হয়ে থাকেন ভোক্তা সম্পর্কে যথেষ্ট তথ্য পাবেন আপনি এই ব্যাংকগুলো থেকে। স্থানীয় বাজারে ব্যবসার জন্য টার্গেটিং কাস্টমার আপনি খুব সহজেই বের করতে পারবেন তাদের কার্যক্রমগুলো পর্যবেক্ষণ করে। 

তাছাড়া বর্তমানে বেশিরভাগ নতুন উদ্যোক্তাগণই আর্থিক টানাপোড়নে থাকেন। তাই তারা স্বল্প বিনিয়োগে ব্যবসায় লাভ আশা করেন আর এ জন্যই বেছে নেন ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পকে। আর একটি ব্যবসায় সফল হতে হলে সেই ব্যবসা সম্পর্কে এ টু জেড আপনাকে জানতে হবেই। উপরোল্লিখিত ব্যাংকগুলোর সকল কার্যক্রম ঘাঁটলে এই জানার কাজে আপনি অনেকটাই এগিয়ে যাবেন।

ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প-সম্ভাবনা ও সাফল্যঃ গত ১৯শে মার্চ ২০১৭ তে CPD কর্তৃক প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প(Small & Medium Enterprise-SME) কে বলা হয় “ An alternative driving force of economic growth”. এই একটি মাত্র বাক্য থেকেই বোঝা যায় ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তা এবং তাদের উদ্যোগ দেশের অর্থনীতিতে কতটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে সক্ষম।

বাংলাদেশ দেশ ব্যাংক এর সংজ্ঞানুযায়ী সে সকল ব্যবসায়ী যাদের প্রতিষ্ঠানে কর্মী সংখ্যা ২৫ থেকে ৫০ এর মধ্যে এবং যাদের ব্যবসায়ের মূলধন ৫০,০০০-৫০,০০,০০০ (ক্ষুদ্র) কিংবা ৫০,০০,০০০-১০,০০,০০,০০০ (মাঝারি) টাকা তাদেরকেই কেবল SME এর আওতাভুক্ত করা হবে।  আমাদের দেশে মূলত নারীরা এই ক্ষেত্রটিতে অনেক দূর পর্যন্ত এগিয়ে গেছেন, যদিওবা তাদের ক্ষেত্রে চলার পথটা মসৃণ এর চেয়ে বন্ধুরই বেশি। CPD এর ওই একই প্রতিবেদনে বলা হয় বাংলাদেশে নারী উদ্যোক্তাদের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে সঠিক অর্থায়ন। ওয়ার্ল্ড ব্যাংক গ্রুপের সদস্য প্রতিষ্ঠান International Finance Corporation (IFC) কর্তৃক ২০১৬ সালে পরিচালিত নারী উদ্যোক্তাদের জন্য ‘ম্যাপিং দ্য মার্কেট পটেনশিয়াল অ্যান্ড অ্যাক্সিলারিং ফাইন্যান্স' শীর্ষক একটি জরিপে বলা হয় বাংলাদেশে নারীদের দ্বারা পরিচালিত এসএমইগুলির মধ্যে ব্যাংক ও নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠান গুলোর মাধ্যমে মাত্র 40 শতাংশের ক্রেডিট চাহিদা পূরণ হয়েছে।

অর্থনীতিতে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের অবদান বোঝার জন্য গত ২৫শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ তারিখে The Daily Star পত্রিকায় এ সম্পর্কে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে চোখ বুলানো যায়, যার মূলভাব মোটামুটি এটাই যে “বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো’র ২0১৩ সালের জাতীয় অর্থনৈতিক পরিসংখ্যান এ দেখা যায় যে বাংলাদেশে মোট 7.81 মিলিয়ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এর মধ্যে প্রায় 88 শতাংশ অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান হচ্ছে কুটিরশিল্প, বাকি 11 শতাংশ এসএমই। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, প্রায় 99% বাংলাদেশি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এসএমই (ADB Institute, 2016)। তারা প্রায় 75 শতাংশ অ-কৃষি কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে এবং জাতীয় জিডিপিতে প্রায় ২৫ শতাংশ অবদান রাখে। এই 25 শতাংশ উৎপাদন শুধুমাত্র এসএমই দ্বারা অবদান করা হয়। যাইহোক, এই পরিমাণটি আসলে অনেক বেশি হতে পারে যদি পরিষেবা খাতের এসএমইগুলির অবদান গণনা করা যায়। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র তথ্য পাওয়া গেছে, যদিও এই ক্ষেত্রটি জিডিপির 56.34 শতাংশের অবদান রাখে, যার ফলে এটি বৃহত্তম অবদানকারী।“

নারী উদ্যোক্তা- সমস্যা ও সম্ভাবনাঃ পুরুষতান্ত্রিক আমাদের এই সমাজে নারীদের জন্য নতুন কোন স্বপ্ন দেখা কট্টা দুঃসাহস এর ব্যাআপার সবাইই জানি। এখানে একজন মেয়ে যদি একটা বুটিক শপ খুলে বসেন সমাজ তাকে চোখের দৃষ্টিতেই একঘরে করে দেয়, নাম হয় তার দোকানী। সে সমাজেই আবার কিছু মেয়ে স্বপ্ন আর সাহসকে বুকে নিয়ে এগিয়ে চলে। তারা নিজেদের পথ নিজেরাই তৈরি করে, পথ দেখায় আরো অনেককে।
নারী উদ্যোক্ত্যাদের পথ চলায় সবচেয়ে বড় বাঁধা হয় সঠিক দিকনির্দেশনার অভাব। তাছাড়া মূলধন এর অপ্রতুলতা আর আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ গ্রহণে অসহযোগী আচরণ তো আছেই। একজন স্বনির্ভর পুরুষ কিংবা প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ীর তুলনায় হুট করে গৃহিণী থেকে উদ্যোক্তা হতে চাওয়া মেয়ের জন্য স্বল্প সুদে ঋণ পাওয়া খুবই কষ্টকর। আর লিঙ্গবৈষম্য, সে আর নতুন কি!

এতো কিছুর পরেও নারীদের অংশগ্রহণ বাড়ছে। প্রযুক্তির এই যুগে অনলাইন শপ কিংবা অফলাইন, মেয়েরা পিছিয়ে নেই। বিভিন্ন বাটিক-বুটিক শপ থেকে অনলাইন এ বাহারি কসমেটিক্স, গয়না কিংবা শাড়ি কাপড়ের পেইজ, বেশীরভাআগই এখন তাদের দখলে। আর ক্ষুদ্র ও মাঝারী কুটির শিল্প তো অনেক দিন থেকেই মেয়েদের দখলেই আছে। প্রয়োজনীয় তথ্য-সহযোগিতা পেলে এই ক্ষেত্রটি এগিয়ে যাবে আরো অনেকদূর। গল্পটা যখন কেবলই সাফল্যেরঃ আসলেই কি উদ্যোক্তা হওয়া এতোটা লাভজনক পন্থা, প্রশ্ন জাগতেই পারে। চলুন বিগত কয়েক বছরে বিভিন্ন মাধ্যমে প্রকাশিত কয়েকজন উদ্যোক্তার ব্যাপারে জেনে আসি। তারপর নাহয় উত্তরটা ভেবে দেখা যাবে!

গত ২৫ শে নভেম্বর,২০১৭ তারিখে বহুল প্রচারিত জাতীয় দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকায় “কৃষি উদ্যোক্তা মাহফুজুরের গল্প” শিরোনামে ঝালকাঠির মাহফুজুর রহমান এর গল্প ছাপা হয়। যেখানে বলা হয় দেশে নতুন প্রজাতির ডোয়ার্ফ বা খাটো জাতের নারিকেলের সবচেয়ে বড় বাগান করেছেন তিনি। 

তার আগে ১১ই ডিসেম্বর, ২০১৬ তারিখে দৈনিক যায় যায় দিন পত্রিকায় প্রকাশিত হয় দেশের চার জেলার চার সফল কৃষি উদ্যোক্তার গল্প। উক্ত প্রতিব্রদনে বলা হয় লালমনিরহাটের উত্তমা রায়, ময়মনসিংহের ভালুকার.  বাবুল, গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জের জাকির হোসেন এবং দিনাজপুরের নবাবগঞ্জের সেলিম তারা নিজ উদ্যোগে তৈরি করেছেন যথাক্রমে কবুতর, গবাদিপশু, রাজহাঁস, মুরগি, ছাগল, মসলার বাগান, লাউ চাষ, মৎস্য চাষ ও বনজ ও ফলদ বাগান এবং গরুর খামার।

এছাড়াও ছাপার কাগজে এসেছে মাত্র ২০ হাজার টাকা মূলধন নিয়ে কাজ শুরু করে কোটিপতি হওয়া পাবনার ঈশ্বরদীর নুরুন্নাহার নামের একজন গৃহবধূর গল্প (২১শে এপ্রিল,২০১৭ ; The Dhaka Times Desk)। খুঁজলে এমন আরো অনেক সফলতার গল্প পাওয়া যাবে যেখানে আছেন পাঁচ হাজার টাকা মূলধনে বীজের ব্যবসায় নেমে দশ লাখ টাকায় রূপ দেওয়া পারভীন আজিজের গল্প, কোথাও বা আছে যশোরের অভাগী থেকে অন্যের কর্মদাতা হয়ে ওঠা আলেয়ার গল্প, কোথাও বা আছে ফুটপাতের হকার থেকে শিল্প উদ্যোক্তা হয়ে ওঠা শিবনাথ এর গল্প।
কষ্ট করে এতদূর না যেয়ে আপনার আশেপাশে চোখ বুলালেই হয়তো পেয়ে যাবেন এমন আরো অনেককেই, যারা নিজেদের কর্মসংস্থানের জন্য অন্যের দ্বারে না ঘুরে বরং ঘুরিয়ে দিয়েছেন নিজের ভাগ্য চাকাটাই। তারা নিজেরাও হয়তো জানেন না আমরা তাদেরকে বলি উদ্যোক্তা অথচ নিরবে-নিভৃত্তে নিজেদের কাজটা তারা করে চলেছেন সুনিপুণভাবে,অবদান রাখছেন দেশের অর্থনীতিতে, ঘুচিয়ে চলছেন বেকারত্বের হার। 

-লেখিকা:  শিক্ষার্থী, সিকৃবি। 


 

Leave a Comment