নব্বই দশকের সেই দিনগুলি!

  • নাজিয়া হক 
  • নভেম্বর ৩, ২০১৮

নব্বই এর ঘরে জন্মেছি বলে নিজেকে কিছুটা হলেও ভাগ্যবতী মনে হয়। না ছিলো ফেইসবুক,না কোনো সোশ্যাল মিডিয়া। আমার বাসা থেকে আমার স্কুলটা দেখা যেতো। বিশাল এক মাঠের এক পাশে ছিলো স্কুল,আরেক পাশে আমাদের বিল্ডিং। প্রথম যেদিন আব্বু আম্মুর হাত ধরে স্কুলে যাই, চোখে ছিলো রাজ্যের সব কল্পনা। কত আন্দদের দিন ছিলো। জীবনের প্রথম বন্ধুত্বের শুরু আর শুরু নতুন একটা জগতের। প্রতিদিন স্কুলে যাওয়ার সময় আব্বু যখন '২টাকার' একটা নোট দিতো,মনে হতো কোটি টাকা দিয়েও সেই আনন্দ কেনা যাবেনা। 

ওই সময়ের খুব বিখ্যাত দুইটা খাবার ছিলো 'ওয়েফার' আর মিমি, ক্লাস শেষে বাসায় আসার সময় আম্মু যদি একদিন অয়েফার আর মিমি চকলেট না কিনে দিতো,মনে হতো আমার চেয়ে দুঃখী কেউ নেই এ দুনিয়ায়। আর একটু বড় হয়ে যখন স্কুল পালটালাম, একদিন ক্লাসের ফাকে গার্ডিয়ান রুমে এসে আম্মুকে না পেয়ে এমন কান্না জুড়ে দিলাম আর প্রতিটা আন্টিকে বলছিলাম 'আমার আম্মু কই', যা ভাবলে আজো হাসি পায়।ওই সময়ের অন্যতম পছন্দের খাবার ছিলো টুকটুকির ডিম নামে একটা চকলেট আর বার্মিজ আচার। 

বার্মিজ আচার নব্বই এর প্রতিটা ছেলে মেয়ের পছন্দের তালিকায় এক নাম্বারে ছিলো। মাগরিব আযান এর সাথে সাথে পড়তে বসাটাই যেনো ছিলো একটা কঠোরতাপূর্ন আনন্দের রুটিন। পড়ার মাঝে অপেক্ষায় থাকতাম কখন ১ঘন্টার জন্য কারেন্ট যাবে,কখন কারেন্ট গেলেই পড়া থেকে ছুটে যাবো উপড় তলায় খালামনির বাসায়। মোমবাতি আর হারিকেন এর আলোয় পড়ার সময় হারিকেন এর সামনে কাগজ দিয়ে খেলা করার মত মজা নব্বই এর ছেলেমেয়েরাই মনে হয় শেষ পেয়েছিলো। রাত ১০টার মধ্যেই খেয়েদেয়ে ঘুম,এক মিনিটও দেরি করা যেতোনা,একদিকে বিটিভিতে ইংলিশ সংবাদ শুরু হতো,অন্যদিকে আম্মুর দমকের সাথে সাথে মশারির ভেতর। 

আর সেই সময় এক ধরনের চার্জলাইট পাওয়া যেতো যেই চার্জলাইট এ রেডিও ছিলো,আবার চার কোনা ছোটো ক্যাসেট দিয়ে গানও শোনা যেত। ছুটির দিন গুলাতে আব্বু আব্বাসউদ্দিন এর গান শুনতো সেইটা দিয়ে,আর আম্মু,আম্মু শুনতো বাংলা সব ক্লাসিক গান। ইত্যাদিতে ওই সময় খুব জনপ্রিয় একটা গান ছিলো 'এক দেশে এক শহর ছিলো' সেইটা ছিলো আম্মুর সবচেয়ে পছন্দের গান(এখন আমারো গানটা অনেক পছন্দ)। আমার জন্মদিনে ভাইয়া একটা ছড়ার ক্যাসেট এনে দেয়,আজো খুঁজি সেই ক্যাসেট টা,কোথাও পাই না খুঁজে।ইত্যাদি ছিলো যেনো আরেক ঈদ এর আনন্দ। সবাই মিলে বসে ইত্যাদি কত আয়োজন করে দেখতাম। আজ রবিবার নাটক এর কথা মনে হলে আজো ভাবী কই সেই কংকা ভাইয়া,তিতলী ভাইয়া। 

ছোটোবেলার ঈদ গুলি ছিলো একেকটা রূপকথার দিন। ঈদ এর ড্রেস কিনে লুকিয়ে রাখাই ছিলো বেশি আনন্দের। ঈদ এর দিন সকাল সকাল সাজুগুজু করে সালামীর জন্যে বের হয়ে যাওয়া। একবার তো এক রিলেটিভ এর বাসায় গিয়ে সালামী না পেয়ে আর কোনোদিন যাবোনা ডিসিশন নিয়েছিল।যেদিন বাসায় প্রথম কম্পিউটার আনলো,সে কি যত্ন কম্পিউটার এর। সারাদিন পড়াশোনা করার পর ঘড়ি ধরে এক ঘন্টা কম্পিউটার চালানোর সুযোগ পেতাম। সেই একই রোড রেইস কতবার যে খেলতাম। চেইন দিয়ে পাশের বাইকটাকে ফেলে দিতে পারলে নিজেকে হিরো হিরো মনে হতো। 

বই পড়ার নেশা ছিলো ভয়াবহ আমার। রাত-দিন এক করে তিন গোয়েন্দা পড়ার জন্যে কত যে বকা খেয়েছি আম্মুর কাছে।নতুন নতুন হুমায়ুন আহমেদ এর বই এর সাথে পরিচয় আর পরিচয় ফ্যান্টাসি এক জগতের। মাঝে মাঝে নিজেকে নীরা,কখনো রুপা ভাবতে ভাবতে কোথায় যে হারায় যেতাম। আম্মুর ভয়ে ওয়াশরুমে যেয়ে লুকিয়ে গল্পের বই পড়াতাম।সময়ের স্রোতে পরিবর্তন স্বাভাবিক নিয়ম। কিন্তু সময়ের স্রোতে সব জেনো আসতে আসতে মিলিয়ে গেলো। কই সেই ছোটোবেলার পাইপ আইস্ক্রিম কই সেই বার্মিজ আচার এর স্বাদ। টাইম মেশিন যদি সত্যি বানানো যেতো তাহলে হয়তো প্রত্যেকটা মানুষ খুব করে চাইতো একবারের জন্য হলেও সেই ছোট্টোবেলায় ঘুড়ে আসতে।

Leave a Comment