ফেব্রুয়ারির গোলাপ

  • মারুফ ইমন
  • ফেব্রুয়ারি ২৪, ২০১৯

স্বামী কে আদর করে স্ত্রী কত নামেই তো ডাকে, বিশেষ করে নববিবাহিতদের মধ্যে এ রকমটা বেশি দেখা যায়। তাই বলে 'কালা’? এটা কোন নাম হল? পিউ এখন সজল কে 'কালা’ বলেই ডাকে। আর তা শুনে গা জ্বলে সজলের। আবার ভালও লাগে, সজল ভেতরের ভাল লাগাটা বলে না, মিছে রাগের ভান করে। সে পিউ কে অনেক ভালবাসে। পিউ তা খুব ভালভাবে জানে। তাই হয়তো এই সুযোগটা নেয়। নামটা পিউ কিন্তু দেয় নি, এটা সজলের সেই ছোটবেলার নানীর দেয়া নাম। ফোনে কালরাতে শাশুড়ির সাথে কথা বলছিল পিউ, তার মনে কত সংকোচ, কত ভয়। সজলের মা দিলারা বুঝতে পেরে বললেন, ‘দেখো মা, আমি তোমার অবস্থাটা বুঝি। তোমার ধর্ম নিয়ে আমার কোন সমস্যা নাই, কিন্তু সজলের বাবার তো মহল্লায় একটা নাম আছে। আর নামাজী মানুষ, তিনি মানতে পারছেন না। চিন্তা করোনা, আমি যতটা পারি ফোন করব। আর কালাকে একটু জোর করে খাওয়াবে, ও কিন্তু কাজে ঢুকে গেলে আর খেতে চায় না।’ পিউ ফিক করে হেসে দেয়, দিলারা টের পেলেন। নতুন বউয়ের কাছে এই নাম বলা ঠিক হয় নি, মুখ ফসকে বের হয়ে গেছে। দিলারা আবার বলেন, ‘ও ছোটবেলা আরো কালো ছিল তো, তাই আমার মা ওকে কালা ডাকতো।’ এই শুনে পিউ কাল রাত থেকে সজলকে কালা নামেই ডাকছে উঠতে বসতে খেতে। সজল রাগের ভান করে হয় কথা বলেনা, নয়তো খেতে চায় না, আবার বাচ্চাদের মত শুতেও চায় না। তাই বলে কি সে পার পায়? একদমই না। পিউ যে তাকে তার নিজের চেয়েও ভালবাসে বেশি। এটাও সজল জানে। 

পুরান ঢাকায় ছোট্ট একটা বাসা নিয়েছে দুজন। ভালবাসা দিবসেই বিয়ে করেছে, তাই এক সপ্তাহ হল একুশে ফেব্রুয়ারিতে। সজল মুসলিম আর পিউ খ্রিস্টান। তাই সজলের বাবা তাদের মেনে নেন নি। তবে পিউয়ের দিক থেকে এ নিয়ে কোন ঝামেলাই হয় নি। হবে কিভাবে? তার যে বাবা মা নেই কেউ। বড় হয়েছে আশ্রমে। চার্চের ফাদার আর আশ্রমের সিস্টার, রুমমেটদের মাঝেই তো পরিবার খুঁজে পেয়েছে। আর এখনতো সজলই তার সব। সজল তাকে কথা দিয়েছে, তাকে একটা পরিবার দেবে। এখন হয়তো বাবা মেনে নেয় নি, আস্তে আস্তে সব ঠিক হয়ে যাবে। পিউ চুপ করে সজলের কথা শুনে তার বুকে মাথা গুজে থাকে। হয়তো কয়েক ফোটা জলও পড়ে চোখ বেয়ে। হয়তো বাবা মা ভাগ্য নিয়ে সে জন্মায়ই নি। সিস্টার প্রিয়াঙ্কা প্রায়ই বলতেন, ‘তুমি এত সুন্দর, তোমাকে ঈশ্বর নিজেই দেখে রাখবেন বাবা মায়ের মত।’ পিউ শুনে হাসতো আর মনে মনে ভাবতো কেউ তাকে যদি অমন আগলে রাখতো তাহলে তাকেও অনেক ভালবাসবে পিউ। সজল তার সে ভালবাসা হয়েই এসেছে। নইলে সব জেনেও কেন সে হাতটা বাড়িয়ে দেবে?

সকাল সকাল 'কালা’ কে নিয়ে পিউ খুব মজা করলো। অফিসে যাবার সময় সজল মনে মনে ফন্দি এঁটে নিলো পিউকে সে জব্দ করবেই। নইলে এই মেয়ে এটা নিয়ে মজা করবেই। পিউ তো এখনো বাচ্চাটাই রয়ে গেছে। রিক্সায় বসে সজল ভাবে আর হাসে। এইতো ক'দিন আগেও মেয়েটা তার একদম অচেনা ছিল। আর আজ ঘরের বউ। কত হুট করে হয়ে গেল সব। এখনো সজল ভাবতে পারছে না, তার মত ভীতু মানুষ এত বড় সাহসের কাজ করে ফেলবে। 

প্রথম দেখার দিনটা সজল বারবার মনে করে আর হাসে। সে আর তার কলিগ সীমান্ত গিয়েছে বাংলাদেশে পোপ আসবে তার সাক্ষাৎকার নিতে, তেজগাঁও চার্চে। কিন্তু এত্ত নিরাপত্তা ছিল আর তার সাথে দেখা হয় নি সেদিন। তবে পোপের কয়েকটা ছবি অবশ্যই তুলতে হবে। কি করা যায় ভাবতেই সজলের মাথায় খেলে  যায় বুদ্ধি। পোপকে ফুল দিয়ে যে সুন্দরী মেয়েগুলো বরণ করে নেবে তাদের দূর থেকে দেখতে পেল সে। সীমান্তকে বুদ্ধিটা বলতেই সে বলল, ‘বাপ রে, পারেনও আপনি। যান না নিজেই, দেখি।’ সজলের জেদ চেপে গেল। মেয়েদের একজনের কাছে গিয়ে বলল, ‘দিদি, একটা উপকার করতে পারেন?’

মেয়েটা সজলের দিকে তাকালোও না। সজল আবার বলে, ‘শুনছেন? ইয়ে মানে।’

মেয়েটি না তাকিয়েই বলল, ‘শুনছি, বলে যান। তবে ফ্ল্যার্ট করবেন না প্লিজ।’

এবার সজল একটু ভড়কে গেল। তারপর বলল, ‘দেখুন, আপনার সাথে ফ্ল্যার্ট করার ইচ্ছা...’ সজল কথা শেষ করতে পারলোনা, মেয়েটি তার দিকে তাকাতেই সে নিরব কবিদের মত হয়ে গেল। আয়তাকার কাজল দেয়া এই চোখদুটোই যেন এতদিন খুজঁছে সে, শুধু সে নয় মুনী ঋষিরাও হয়তো এ চোখের চাহনিতে আর কথার সুরেলা আওয়াজে ভঙ্গ করতেন ধ্যান। সেখানে সজল কোন ছাড়। তাই হয়তো মনের খুব ভেতরের কথাটা কত সহজে বলে ফেলল সে, ‘আপনাকে ভাল লেগেছে।’

মেয়েটির মুখখানি নিমিষেই লাল হয়ে গেল, যেন কেউ যুবকের তাজা রক্তে দুধ ঢেলে একেছে কোন কালজয়ী মোনালিসার ছবি। ‘জানতাম এসবই বলবেন, ছেলেদের আর বলার কি আছে। প্লিজ যান তো এখান থেকে।’ মেয়েটি রেগে বলল। ‘ছেলেদের আরো কিছু বলার থাকে, সেটা শুনতে কি কোন মেয়ে একটু সময় দেবে?’ সজল একদৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল। মেয়েটি কিছু না বলে তার হাতের ফুলের বুকেটা আরেকজনের কাছে দিয়ে ভেতরে চলে গেল। সজলের চোখ তবু এত ভীড়েও তাকে খুজঁতে লাগলো পাগলের মত। সেদিন আর দেখা হয় নি। তবে জানা হয়েছিল কিছু। মেয়েটি হয়তো কাউকে গিয়ে বলেছে, তাকে একটা বাজে ছেলে বিরক্ত করছে, তাই সিকিউরিটি তাকে ঠেলে সরিয়ে দেয় দূরে। চলে যাবার ঠিক আগে তার সাথে দাড়িয়ে থাকা আরেকজনের সাথে দেখা। 

সজল অনেক জোরাজুরি করে তার কাছ থেকে জানলো, মেয়েটি আশ্রমের, নাম পিউ। দিনের সব কাজ এক নিমিষে অকাজ হয়ে গেল সেদিন থেকেই। আশ্রম থেকে গির্জা আর গীর্জা থেকে আশ্রম হয়ে গেল তার নিত্য নৈমিত্তিক যাতায়াতের জায়গা। অনেক দূর থেকে একবার দেখা যায় পিউকে আর তারপর আবার অপেক্ষা। চোখ এড়ায় নি সেদিন সিস্টার প্রিয়াঙ্কার। তারপর সজলকে ডেকে প্রথমে মানা করলেন। কাজ হল না। তারপর পিউ একদিন দেখা করে বলল কোন সম্পর্কে যেতে চায় না সে। সজল তাকে ছাড়া ভাবতেই পারে না একটা দিনও। পিউ মনে মনে তাকে চাইতো, কিন্তু সে জানে অনেকগুলো দেয়াল তার আর সজলের মাঝে। কিন্তু সজলের চোখে কোন মিথ্যে নেই, আছে নিষ্পাপ মায়া। তাতে বাধা পড়ে গেল পিউ। লাল গোলাপ সেদিন সাক্ষী হয়ে ছিল দুজনের একসাথে চলতে কথা দেয়ার।

অফিসে এসেই সজল ফোন দিলো সিস্টারকে। ওপাশ থেকে নারীকন্ঠ বলল, ‘গুড আফটারনুন সজল, কেমন আছো? পিউ কেমন আছে?’
সজল হেসে বলল, ‘খুব ভালো, সিস্টার আপনি কেমন আছেন?’

‘আমি ভালোই, একটু ঠান্ডা। তোমাদের কেমন চলছে? বাবা মা আর কিছু জানিয়েছে?’

‘মা পিউয়ের সাথে কথা বলে, মা জানে আমি কোন অপরাধ করিনি। বিয়ে করেছি, হয়তো সে আমার ধর্মের না, তাতে কি। আমাদের মনের মিল তো এটা আমাদের মনেই রাখতে দেয় না।’

‘তা ভাল, আমি সবসময় ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করি তোমরা ভাল থাকো। তা তোমার বাবা মা কে ওই ব্যাপার টা জানিয়েছো তো? ’
সজল কিছুটা বিমর্ষ হয়ে বলল, ‘না সিস্টার। আমি এখন ওসব টানতে চাই না। পিউ খুশি থাকলেই আমি খুশি।’

'ক্রিসমাসের দাওয়াত রইলো, পিউকে নিয়ে চলে এসো। গড ব্লেস ইউ।' বলে সিস্টার ফোন রাখতে যাবে এমন সময় সজল আবার বলল, ‘আচ্ছা সিস্টার, পিউকে ওখানে অন্য কোন নামে ডাকতেন আপনি?’

সিস্টার হেসে দিলেন, ‘আমি একা কেন? আমরা সবাই তো আদর করে ওকে কিটি ডাকতাম।’ সজলও হো হো করে হেসে দিল। পিউ তাহলে 'কিটি’ও ছিল।

সজল বাসায় এসে দরজা বাইরে থেকে খোলাই পেল, ঘরটা অন্ধকার। সে কয়েকবার 'পিউ, পিউ’ করে ডাকলেও কোন সাড়া পেল না। বেডরুমে ঢোকার আগেই রান্নাঘরে ট্যাপ থেকে টুপটুপ করে পানি পড়ার শব্দ পেল সে। আর একটা বিড়াল কিছু একটা ফেলে 'মেউ' শব্দ করে জানালা দিয়ে বের হয়ে গেল।সজলের কেমন একটা ভয় লাগলো। সে বেশি প্রেসার নিতে পারে না, পিউ তা জানে। তাহলে এমন কেন করছে। বেডরুমে যেতেই আলোগুলো জ্বলে উঠলো আর পেছন থেকে পিউ জড়িয়ে ধরে বলল, ‘কেমন দিলাম? হা হা’

আশপাশে তাকিয়ে সে অবাক। ঘরটাকে সুন্দর করে সাজিয়েছে পিউ, সে নিজেও সেজেছে লালপাড় সবুজ শাড়িটা পরে। তাকে যে অপ্সরীর মত লাগছে তা কি সে জানে। সজল তাকে জড়িয়ে বুকে টেনে নিলো। পিউ অল্প হেসে ছাড়িয়ে নিতে চেয়েও পারলো না। তারপর কি মনে করে আবার সজলের বুকে মুখ চেপে ধরলো। তার কাজল লেপ্টে যাচ্ছে সে খবর নেই।

‘কি হল পিউ?’ সজল কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল।
‘কিছুনা।’ পিউ বলল
‘বল'
‘জানো, এই প্রথম আমি আশ্রমের বাইরে এতদিন থাকছি।’
‘জানি, কারন এটা তোমার আরেকটা জীবন।’
‘হুম। তুমি আমাকে এভাবেই ধরে রাখবে তো সবসময়?’ 
‘রাখবো বলেই তো ধরেছি পিউ।’
‘আমার কিন্তু কেউ নেই। বাবা মা স্বজন কেউ।’
‘আমার মা কিন্তু তোমাকে এসব ভাবতে মানা করেছে।’  
পিউ কিছুক্ষণ চুপ থেকে মুখ তুলে বলল, ‘মা কে জানিয়েছো কথাটা?’
সজল একটা মৃদু শ্বাস ছেড়ে বলল, ‘না।’
‘কেন? পরে যদি সমস্যা হয়?’

‘দেখো পিউ, এটা একটা দুর্ঘটনা যাতে তোমার কোন হাত নেই। সিড়ি থেকে পড়ে মানুষ আরো মারাত্নক আঘাতও পায়। তুমি হয়তো কোনদিন মা হতে পারবে না, তাতে আমার ভালবাসা এতটুকু কমবে না এ আমি বলতে পারি। আর এটা নিয়ে কেউ তোমাকে কিছু বলুক তা আমার ভাল লাগবে না।' পিউয়ের চোখ বেয়ে জল নামছে। সে সজলের শার্টের বোতামগুলোতে আচঁড়ে বলল, ‘আমাদের কি তাহলে কোন ফ্যামিলি হবে না?’
সজল পিউয়ের জল মুছে দিয়ে মুচকি হেসে বলল,’অবশ্যই হবে। আমরা না হয় আশ্রম থেকে একটা বাচ্চা কিটি কে নিয়ে আসবো আমাদের জন্যে।’

পিউ হেসে বলল, ‘তোমাকে এই নাম বলেছে? সিস্টার, তাই না?’ সজল মাথা নাড়লো। আর পিউ পরম মমতায় আবার তার গালে সজলের হাত দুটো ধরে রাখলো। ফাগুনের অল্প শীতে ওর হাত ঠান্ডা লাগছে খুব।

Leave a Comment