এক সাহসী মেয়ের ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প

  • কামরুন নাহার স্মৃতি
  • মার্চ ১২, ২০১৯

জীবনের অজস্র অলিগলি প্রতিনিয়ত একজন মানুষকে নিয়ে গিয়ে দাঁড় করায় কঠিন বাস্তবতায়। পনেরো বছর বয়সে যেখানে একটা মেয়ে স্কুলের গন্ডিতে স্বপ্ন বোনে খুব যতনে, সেখানেই সমাজ কিংবা বাবার জেদ আর ইচ্ছার কাছে অহরহ স্বপ্নের বলি দিতে হয় সুমির মতো কিশোরী মেয়েদের। সুমিকে জোর করে বন্দি করা হয় বিয়ে নামের খাঁচায়। সুমির বিয়ে দেয়া হয় তিনগুণ বেশি বয়সের দুই বউ মরা এক মধ্যবয়স্ক লোকের সাথে। সুমি কিংবা তার মায়ের কান্না টলাতে পারেনি সমাজ আর বাবা নামক পাষাণ হৃদয়কে। বিয়ের পর সুমিকে সহ্য করতে হয় অকথ্য অত্যাচার। কাজের সামান্য এদিকওদিক কিংবা স্বামী - শ্বশুর - শ্বাশুড়ির হুকুম তামিলে একটু হেরফের হলেই সুমির কপালে জুটতো লাথি - ঝ্যাঁটা - থাপ্পড়। 

বিয়ের পর একদিনের জন্যেও সুমির চোখেমুখে হাসি দেখেনি কেউ। যেই বয়সে স্কুলের পাঠ সামলানোর কথা, সেই বয়সে উনুন সামলাতে গিয়ে মুখ বুজে মেনে নিতে হয়েছে দু'চারখানা পোড়া দাগ। মেয়েদের অভিযোগ, অনুযোগ শোনার মতো কেউ থাকেনা বুঝতে শেখার পর থেকে আর নালিশ করেনি সুমি। বাবা, দাদি কিংবা মায়ের কাছে যখন শ্বশুরবাড়ির অত্যাচারের কথা বলেছে তখন সবাই খুব সহজেই বলেছে, 'সংসার করা মুখের কথা নয়। সংসারে এমন একটুআধটু লেগেই থাকে, এ আর এমন কি!' সুমি মাঝেমাঝেই আশ্চর্য হতো সবার কথা শুনে, এমন মানুষও হয়!

একবছরের মাথায় সুমি জানতে পারলো সে মা হতে চলেছে। সুমির চালচলন, চলাফেরা, বমি বমি ভাব সবটা দেখে শ্বাশুড়িই বলেছে এই কথাটা। সুমির এই বিষয়ে এতোটুকুও জ্ঞান নেই, জ্ঞান হবার আগেই তো তাকে বন্দি করা হয়েছে সংসার নামের জেলখানায়। ছোটবেলায় সুমি যখন পুতুল খেলতো, পুতুলের বিয়ে দিতো তখন হয়তো মনের ভুলেও বুঝতে পারেনি পুতুলের বিয়ে আর মানুষের বিয়ে আলাদা হয়। খেলা আর বাস্তবতায় বিশাল ফারাক হয়, বুঝলে হয়তো সেদিন পুতুল বিয়েতে প্রাণখুলে হাসতে পারতো না। শ্বশুর, শ্বাশুড়ি, স্বামী, পাড়াপড়শি সুমিকে অতিষ্ঠ করে তুলেছে ছেলে ছেলে করে, তাদের ছেলেই চাই। মেয়ে সন্তান চায়না তারা, বংশের প্রদীপ চায়। সুমির শ্বাশুড়ি স্পষ্টই জানিয়েছে ছেলে সন্তানের জন্ম না দিতে এ বাড়ির পাঠ তার চুকলো। সুমি ভেবেই পায়না এতে তার কি হাত আছে, তার হাতে কি আছে ছেলে বা মেয়ে!

সবার  আশায় ছাই দিয়ে জন্ম নেয় সুমির মেয়ে। সুমির শ্বশুরবাড়ির মানুষ কিংবা বাবার বাড়ির সবার মুখ কালো হলেও সুমির মুখে ফুঁটে উঠে এক চিলতে হাসি। শ্বশুরবাড়ি থেকে সুমিকে পাঠিয়ে দেয়া হয় বাবার বাড়ি, কয়েকমাস পরে আনবে বলেও আনতে যায়নি সুমির শ্বশুরবাড়ির কেউ। প্রতিনিয়ত বাবা মায়ের দীর্ঘশ্বাস আর হা-হুতাশ সুমিকে যেন ভেতরে ভেতরে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছিল। মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে সুমি নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখে। কিছু টাকা ধার নিয়ে কয়েকটা হাঁস মুরগি কিনে নেয় সুমি। বেশকিছুদিনের মধ্যেই সুমি নিজেই হাঁস- মুরগির খামার দেয়, ধার দেনা শোধ করেও বেশ টাকা হাতে থাকে। গরু কিনে ফেলে বাবার পরামর্শে। মেয়েকে স্কুলে পাঠিয়ে সারাদিন এদিকেই মন দেয় সুমি। সুমি এখন আর হতাশায় ভোগেনা কিংবা হা হুতাশে ভোগেনা তার বাবা মাও,সুমি সাহসিকতার সাথে সব কাজ করে যায়।  সুমির খামার এখন অনেকের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছে, সুমি বিশ্বাস করে কোন কাজই ছোট  অথবা অসম্ভব নয়। মনে বিশ্বাস রেখে চেষ্টা করলে সবকিছুই একসময় সম্ভব হয়।

সুমি তার মেয়েটাকে মানুষের মতো মানুষ করে গড়ে তুলতে চায়, প্রতিনিয়ত সমাজের নাকপাশে তিলে তিলে শেষ হয়ে যাক এটা চায় না সে কিংবা চায় না তার বাবা মায়ের মতো তার মেয়ের স্বপ্নগুলোকে অচিরে ভেঙ্গে চুরমার করে দিতে। সুমির মতো হাজারো মেয়ে তাদের লড়াই আর সাহসিকতা দিয়ে জানান দেয়,  'মেয়ে কোন ব্যাধি নয় বরং মেয়েই শক্তি।' 

 

Leave a Comment