প্রিয় মানুষটির হঠাৎ বদলে যাওয়া!
- কামরুন নাহার স্মৃতি
- মার্চ ২৮, ২০১৯
রুম্পা নামের সমবয়সী মেয়ের সাথে বেশকিছু সময় কথার পর জানলাম তার হতাশার কারন। মেয়েটা বললো, একসময় ঝগড়া হলেই রাহাত আমার নাম্বারটা ব্লাকলিস্টে রেখে দিত। আমিও নিজেকে ছোট করতে চাইনি ওর কাছে, তাই নিজে থেকে ফোন দিতাম না। কিন্তু ঘন্টার পর ঘন্টা, মিনিটের পর মিনিট শুধু ফোনের দিকে তাকিয়ে থাকতাম আর মনে মনে চাইতাম রাহাত নিজে থেকে আমাকে ফোন দিক, অন্তত একবার। চার - পাঁচদিন আমার ফোন নাম্বারটা ওইভাবেই পড়ে থাকতো ব্লাকলিস্টের বন্ধ ঘরে।
সবসময় আগে আমিই ফোন দিতাম ওকে। আমি দশবার ফোন দিলে ও দিত একবার। ওর এই ছাড়া ছাড়া ভাব আমার বেঁচে থাকা মুশকিল করে দিয়েছিল। আমি বুঝতে পারতাম ও নতুন কোন সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ছে প্রতিনিয়ত, তাই আমাদের সম্পর্কটা ওর কাছে একঘেয়েমিতে লাগছে। কিন্তু আমি মেনে নিতে পারিনি। খেতে বিরক্ত লাগতো, পড়ায় মন বসতো না, এমনিতেই চোখ ছলছল করে উঠত, রাতে কখনো ঘুমাতে পারতাম না। ওকে অনলাইনে দেখে আশায় বসে থাকতাম এই হয়তো ও ম্যাসেজ টাইপ করছে, এই হয়তো আমার কথা ভাবছে কিন্তু না ও ম্যাসেজ টাইপ করেনি। আমিই আগ বাড়িয়ে ওর খোঁজ নিতাম আর ও রিপ্লে দেওয়ার মতো অবসর পায় না ভেবে নিজেকে সান্ত্বনা দিতাম। রাত হলেই বালিশ ভিজে যেত ভালোবাসার বিনিময়ে পাওয়া অবহেলায়। আমি বুঝতে পারতাম ওর জীবনে নতুন মেয়ে এসেছে, আমার জায়গাটা দখল করে নিয়েছে সে।
রাত ২টা, ৩টা পর্যন্ত অনলাইনে একটিভ থাকার পরও আমার ম্যাসেজ সিন করার সময় পেত না ও, ওর পোষ্টে আমি কমেন্ট করলে ও যেন লজ্জায় মাটিতে মিশে যেত। কখনো কখনো তো ডিলেট করে দিত আমার করা কমেন্ট, আবার এ নিয়ে কথা শোনাতো। এতোরাত পর্যন্ত অনলাইন কেন, ম্যাসেজ সিন হয় না কেন কিংবা সিন হলেও রিপ্লে আসেনা কেন? জানতে চাইলেই আমার সন্দেহ রোগ আছে, বিশ্বাস শব্দটা আমার ডায়েরিতে নেই, অবিশ্বাসের বেড়াজালে আমি ভালোবাসাটাকে বেঁধে ফেলেছি আর তাই সন্দেহ আর ভালোবাসা এক সাথে কখনোই থাকতে পারে না বলে নিজের মতোই ফোন কেটে দিত। আমি বুঝতে পারতাম না এতো কিছু যখন ও বুঝতে পারে তখন এটুকু বুঝতে পারে না আমি ওকে কত্তো ভালোবাসি, ওকে হারানোর ভয় আমাকে সন্দেহপ্রবন করে তুলেছে।
শেষবারও আমাদের ঝগড়া হয়েছিল একটা মেয়ের জন্যে। একটা মেয়ের সাথে রিকশায় দেখে যখন ফোন দিয়ে জানতে চাইলাম কে মেয়েটা আর কিই বা সম্পর্ক ওদের মধ্যে...? তখন ও বান্ধবী বলে আমার প্রশ্ন এড়িয়ে গিয়েছিল আর আমার মন মানসিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিল, আমি কি মানুষ? এটা জানতেও ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল। যখন প্রতিদিন মাঝরাতে ফোন দিয়ে ওয়েটিং দেখতাম তখন ও কলেজ, বন্ধু, ফ্যামিলি বলে এড়িয়ে যেত আর তার সাথে বেড়ে যেত আমাদের দূরত্ব।যখন ইনবক্সে কেউ এসে কেন বিরক্ত করি প্রশ্নে আমাকে শাসিয়ে যেত রাহাতের হবু বউ বলে, রাহাতের জান বলে তখন হাসতে হাসতে আমার কান্না পেয়ে যেত। আচ্ছা হাসির মাঝে কান্না লুকিয়ে থাকে কেন...? আমি জানিনা কেন..!
এরপর দুইবছর কেটে গেছে। দিনের পর দিন রাহাতের অবহেলা আমাকে নতুন এক আমি করে গড়ে তুলেছে। আজ আমি আর কাঁদিনা কাউকে ভেবে, আজ আর রাত জাগিনা কারো ম্যাসেজ আসবে ভেবে, আজ আর বালিশে মুখ গুজে পড়ে থাকিনা, আজ আর অনলাইনে কাউকে খুঁজে মরি না, আজ আর কারো একটিভ থাকাটা কষ্ট দেয়না, আজ আমি বদলে গেছি। চার বছরের সম্পর্ক ভেঙ্গে রাহাত আমাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিল, চুরমার করে ভেঙ্গে দিয়েছিল আমার মনকে, আমাকে আর সাথে আমার স্বপ্নগুলোকেও। আমি খুব কষ্টে সেই ভাঙ্গা টুকরোগুলো আস্তে আস্তে যত্ন করে জোড়া লাগিয়েছি। দাগটা যদিও আজ আছে তবুও ভালো আছি, নিজের জন্যই ভালো আছি। এখন আর কললিস্টে প্রথমদিকে রাহাতের নাম্বারটা থাকে না, ম্যাসেজ লিস্টেও না, ফোনবুক থেকে ডিলিট করে দিয়েছি রাহাতের ফোন নাম্বারটা। ওর সব ছবি ডিলিট করে দিয়েছি হয়তো ওকেও। ফেসবুকেও ব্লক দিয়ে দিয়েছি যাতে চাইলে ওর বিরক্তির কারন হতে না পারি। কি লাভ মায়া বাড়িয়ে?
কি লাভ যা পাওয়া হবে না তা আঁকড়ে ধরে? যা পাওয়ার নয় তা ছেড়ে দেওয়াই ভালো। আজকাল আমি ঘুম থেকে উঠেই কারো ম্যাসেজের আশায় ফোনের দিকে হাত বাড়াই না। কারো জন্য মনের আকাশে প্রজাপতির মেলা বসে না। কারো জন্য দুচোখ আর ভিজে যায়না। আমি বদলে ফেলেছি নিজেকে পুরোপুরিভাবে।
রাত ১১.২০। হঠাৎ অচেনা নাম্বার থেকে ম্যাসেজ...
" খুব জানতে ইচ্ছে করে..
তুমি কি সেই আগের মতোই আছো,
নাকি অনেকখানি বদলে গেছ?"
নাম্বারটা ভালো করে চেক করে বুঝলাম এটা রাহাতের নাম্বার। নাম্বারটা ভুলে গেলেও স্মৃতি থেকে মুছে যায়নি। ম্যাসেজের উত্তর দেবার প্রয়োজন বোধ করলাম না। কারন ওরও বোঝা উচিত কাউকে গুরুত্ব দিয়ে তার থেকে অবহেলা পেলে কতোটা কষ্ট হয়! অপেক্ষা কতটা যন্ত্রণার ওরও জানা উচিত। রাহাত একের পর এক ফোন দিয়েই যাচ্ছে.... যখন আমাদের সম্পর্ক শুরুই হয়নি তখন ও ঠিক এভাবেই আমাকে ফোন দিত, প্রতি মুহূর্তে ম্যাসেজ দিত। অগত্যা ফোনটা ধরলাম।
- কে বলছেন? কাকে চাই?
- আমাকে চিনতে পারছো না তুমি?
- না পারছি না।
- সত্যি পারছো না!
- অচেনা কাউকে মিথ্যে বলার কোন প্রয়োজন দেখছি না।
যার কন্ঠের শুরু থেকে শেষটা চিনি তার কন্ঠ নাকি চিনতে ভুল করবো...! ভাবতেই হাসি পায়।
- একবার চেনার চেষ্টা করো..আমি রাহাত। এতো তাড়াতাড়ি ভুলে গেলে।
- মনে রাখার কথা ছিল বুঝি! আমার তো জানা নেই। আপনার হবু বউ, প্রেমিকা, জান আছে তো! আমি কেন মনে রাখতে যাবো আপনাকে!
- তুমি অনেক বদলে গেছ।
- ভুল করলেন। অনেক না পুরোপুরি।
- আমাকে মনে পড়ে না আর?
- না..
আমার বিয়ে হয়ে গেছে। স্বামী, সংসার নিয়ে বেশ ভালো আছি। আমার স্বামী পাশেই ঘুমায়, আমি চাইনা সে অন্য কারো জন্য আমাকে সন্দেহ করুক। আমি ভালো আছি, আমাকে বিরক্ত না করলে খুশি হবো। বলেই ফোনটা রেখে দিয়েছিলাম। কি আর বলতাম আমি! রাহাত সেদিনও আমাকে বোঝে নি আর আজও বুঝলো না। ওর ফোনের জন্য, ম্যাসেজের জন্য আমি কতোটা অপেক্ষা করেছি সে শুধু আমি জানি কিন্তু আজ আর করিনা। রাহাত আজও বুঝলোনা আমি মিথ্যে বললাম, আমি তো মনে মনে ওকেই বিয়ে করেছিলাম। ও আমাকে বউ ডাকতো একসময়, সব ভুলে গেছে ও। আমিও ভুলে গেছি কিন্তু স্মৃতি? সে কি ভোলা যায়!
একসপ্তাহ পর রাহাতের ম্যাসেজ এলো...ওর বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। আমাকে আমার স্বামী সহ দাওয়াত করেছে। দেখেই হাসি পেল। হাসতে ইচ্ছা করছে, চিৎকার করে হাসতে ইচ্ছে করছে। ছেলেরা কতো সহজে পালটে যায়, পালটে ফেলে নিজেকে।টেবিল গোছাতে গিয়ে চোখে পড়ল খুব যত্নে রাখা রাহাতের ডায়েরিটা.. আমার জন্য কতো কবিতা লিখেছিল তাতে। ডায়েরিটা জড়িয়ে আমি একসময় খুব কেঁদেছি কিন্তু আজ আর কাঁদিনা।
সেই মানুষটার জন্য আপনি কেন কাঁদবেন যেই মানুষটা আপনাকে কখনো ভালোই বাসেনি। নিজেকে ভালোবাসতে শিখুন, নিজেকে সময় দিন। হতাশায় না ডুবিয়ে হাসি খুশি থাকুন। আপনার প্রিয় মানুষটির বদলে যাওয়ার কারন হতে পারে তার জীবনে নতুন কারো আগমন। তার জন্য আপনি কেন নিজেকে তিলে তিলে নিঃশেষ করা বন্ধ করুন।