মুখে দাড়ি, পরনে আলখাল্লা, মুখে বিনয়ের হাসি।

  • জান্নাতুন নুর দিশা
  • জুন ৩, ২০১৯

আমি যখন বিসিএস কোচিং করতাম, সেই কোচিংয়ে বাংলাদেশ বিষয়াবলী পড়াতেন একজন স্যার ছিলেন। কোচিংয়ে আমাদের সাথে ক্লাস করতেন মাদ্রাসা শিক্ষিত এক ভাই। মুখে দাড়ি, পরনে জোব্বা। সেই স্যার প্রতিদিন ক্লাসে এসেই ভাইটিকে বলতেন, "কী হুজুর, বিসিএস কোচিং কেন করেন? এসব তো দুনিয়াবি কাজ। কেমন হুজুর আপনি?" তিনি নানাভাবে ঐ ভাইকে বিদ্রূপ করতেন। ক্লাসে সবাই হাসত। ঐ ভাইটিও হাসত। কোনোদিন প্রতিবাদ করতে দেখি নি।

একদিন সেই স্যার বললেন, "এই যে এই হুজুর ভাইটিকে আমি নিয়মিত বিদ্রূপ করি, আপনারা হাসেন, সাধারণ শিক্ষিত কেউ হলে দিনের পর দিন এসব সহ্য করত? একবার ভেবে দেখুন তো নিজেকে তার জায়গায় রেখে।" সকলেই সেদিন কিছুটা হতচকিয়ে গিয়েছিল। আসলেই তো, বিদ্রূপ হাসি মুখে মেনে নেয়া তো সহজ না। স্যার বললেন, "ওনাকে আমি বিদ্রূপ করতাম, কারণ একজন শিক্ষক হিসেবে আমার কর্তব্য হচ্ছে ওনাকে পরীক্ষার জন্য ছাত্রকে প্রস্তুত করা। আমাদের দেশে যারা মাদ্রাসা শিক্ষিত, যাদের মুখে দাড়ি, গায়ে আলখাল্লা, তারা জীবনের প্রতিটি ধাপে নানা বিদ্রূপ সয়ে আসে। হয়ত চাকরির ইন্টার্ভিউ বোর্ডেও ওনাকে নিয়ে বিদ্রূপ হবে, বলবে এ তো মাদ্রাসা ব্যাকগ্রাউন্ড। ইনি যে যোগ্যতা দিয়ে এতদূর এসেছে, তা নিমিষেই ভুলে যেতে পারে। ওনারা ভার্সিটি, জব বা জীবনের নানা ক্ষেত্রে এসব কটাক্ষ, বিদ্রূপ শুনে শুনে অভ্যস্ত। কিন্তু আমাদের হুজুরেরা যারা নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার সংগ্রাম করেন, দেখবেন ওনারা হাসি মুখেই এসব বিদ্রূপ নীরবে মেনে নেন, রিয়েক্ট করেন না। ওনাদের ধৈর্য আর বিনয়ই ওনাদের উত্তম চরিত্র প্রকাশ করে।"

এদেশের সো কলড অনেক উচ্চশিক্ষিতদের অনেকের মধ্যেই মাদ্রাসা শিক্ষিতদের ইনফেরিয়র ভাবার একটা মানসিকতা রয়েছে। কিছুদিন আগে একটি ছবি ভাইরাল হয়েছিল অপরাজেয় বাংলার সামনে দাঁড়িয়ে জোব্বা পরিহিত দুজন মাদ্রাসার ছাত্র সেলফি তুলছে। এই ছবি নিয়েও অনেক সো কলড মুক্তমনাকে হাসাহাসি করতে দেখেছি। অথচ এই ছবিটা কত সুন্দর একটা ছবি, দুজন ধর্মপরায়ণ কিশোরের দেশপ্রেমের অতুলনীয় বহিঃপ্রকাশ ছিল ছবিটি।

মাদ্রাসা শিক্ষিত মানেই তারা মেইন স্ট্রিমের বাইরের কেউ এমনটা ভাবার এই অদ্ভুত মানসিকতা পরিহার করা খুব প্রয়োজন। কারো গায়ে আলখাল্লা থাকলে তার হাতে কবিতা, উপন্যাসেরর বই দেখলে একদল লোক বিদ্রূপ করে। কেন ভাই? যিনি ধার্মিক, তিনি সাহিত্য ভালোবাসতে পারেন না? অনেক মাদ্রাসা শিক্ষিতরা অনেক উচ্চপদে আসীন আছেন নিজেদের যোগ্যতা বলে। অনেকেই সাহিত্য, বিজ্ঞান, রাজনীতি নিয়ে পড়াশোনা করেন। কোনো ধর্মই বলে নি দুনিয়াবি কাজ সব বাদ দিয়ে কেবল আধ্যাত্মিক জীবনযাপনে থাকতে, বরং জগত সংসারের মধ্যে থেকেই সৃষ্টিকর্তার আদেশ অনুসরণ করতে বলা হয়েছে।

যিনি ধর্মচর্চা করেন, তিনি চৌকস অফিসার হবার যোগ্যতা রাখেন না কিংবা তিনি গান ভালোবাসতে পারেন না কিংবা তিনি কবিতা পড়তে পারেন না কিংবা কোনো ধার্মিক ব্যক্তি এসব করলেই তাকে নিয়ে ব্যঙ্গ করতে হবে এসব ভাবাটা একদম অযৌক্তিক। খেয়াল করে দেখবেন আপনি যখন বিদ্রূপ করতে যাবেন, এই মুখে দাড়িওয়ালা, পরনে আলখাল্লা ভদ্রলোকগুলো বেশিরভাগই তার বিপরীতে মুখে একটা নির্ভেজাল হাসি টেনে উলটো আপনাকেই লজ্জায় ফেলে দেবেন।

টি/শা 

Leave a Comment