গল্প  : আনন্দ যাত্রা 

  • ফারজানা আক্তার 
  • জুলাই ১২, ২০২০

আমার শ্বাশুড়ি আর ননদ দুইজন দুইজনকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে আর আমি রুমের জানালার পাশে বসে, চুল কয়টা ছেড়ে দিয়ে বাহিরের হাওয়া খাচ্ছি আর হাসছি। হয়তো অবাক হয়ে আপনারা ভাবছেন আমি কত্ত খারাপ ছেলের বউ আর ভাবী! ননদ আর শ্বাশুড়ি কাঁদছে আর আমি রুমে বসে হাওয়া খাচ্ছি আর হাসছি। আমি খুশী। আরেহ! আমার নাম খুশী। বাবা মায়ের একমাত্র খুশী। আমার বাবা সবসময় বলতেন আমি নাকি যেখানে যাই সেখানে খুশীর বন্যা বয়ে যায়। শ্বশুরবাড়িতে এসে শুনলাম আমি যেখান দিয়ে যাই সেখানে নাকি অশুচি হয়ে যায়!

এই কথা শুনে কত রাত দিন কেঁদেছি। কিন্তু আমার কান্না কেউ শুনে নি। আমার পতিদেবতাকে ভালোবেসে বিয়ে করেছিলাম। যখন প্রেম করতাম তখন ঠিকই সে প্রেমিক ছিলো, কিন্তু বিয়ে করার পর না সে প্রেমিক থাকলো, আর না স্বামী হয়ে উঠতে পারলো। বিয়ের পর কেমন জানি মা, বোনদের হাতের পুতুল হয়ে গেলো। কোন এক অদ্ভুত কারণে আমার বাবা পিয়াসের পরিবারকে পছন্দ করে না। পিয়াস আর আমি একই গ্রামে বসবাস করি। বাবা পিয়াসের পরিবারে আমাকে কখনো পাঠাতে চায় নি। আমি আর মা জোর করে বাবাকে রাজি করিয়েছি। এখন আমি এই বাড়িতে খারাপ আছি এই কথা জানলে বাবা মা খুব কষ্ট পাবেন, আর বাবা আমার মায়ের সাথেও অশান্তি করবে তাই সব চেপে যাই। তবুও মা, বাবা কিছু কিছু টের পান। আমি যতটা ভালো আছি দেখাই, আসলে ততটা ভালো আমি নেই। 

সত্যি বলতে আমি একদম ভালো নেই। পিয়াসের তিন বোন আর পিয়াস একা। বড় দুই বোনের অনেক আগেই বিয়ে হয়ে গেছে, কিন্তু তারা স্বামী সন্তান নিয়ে এই বাড়িতেই থাকে। ছোট জনের কয়েকদিন আগে বিয়ে হলো, তবে এবার মনে হচ্ছে ছোটজনও এই বাড়িতে থাকবে!বিয়ের পরদিন সকালে কি হয়েছে জানেন? বিয়ের পরদিন সকালে আমাকে রুটি বানাতে দিলো। আমি রুটি বানাতে পারি নি। তার জন্য আমার  শ্বাশুড়ি, দুই ননাস আর ননদ যত কথা শুনালো, ততকথা ঝগড়া লাগলেও কেউ কাউকে বলে না। সেদিন সকালে বুঝে গিয়েছিলাম আমার বাবা কেন এই পরিবারে আমাকে পাঠাতে চান নি। 

আমার পরিবারে আমি, আমার মা আর বাবা ছিলাম। খুব আদর যত্নে মানুষ হয়েছি। কখনো বকা শুনি নাই । মা যদিও কখনো সখনো একটু বকা দিতো। বাবা এসে ঠিক আমার পক্ষ নিয়ে মাকে একগাঁদা কথা শুনিয়ে দিতো। মাছের মাথা আর মুরগির রান আমার খুবই পছন্দের খাবার। মাছের মাথা আর মুরগির রান ছাড়া প্লেটে হাতই দিতাম না। 

আমার মা প্রায় রেগে যেতেন আমার এই স্বভাবে। মা চিৎকার করে বলতেন, 'এক মাছের কয় মাথা হয় শুনি? এক মুরগির কয় রান হয়? প্রতিদিন প্রতিবেলা মাছের মাথা আর মুরগির রান কই পাবো আমি?' বাবা মাকে স্বান্ত্বনা দিয়ে বলতো, 'মেয়েটার সাথে এতো রাগারাগি করো কেন? একটু ভালো করে বুঝিয়ে শুনিয়ে কথা বলতে পারো না!'

মা বলতো, 'তোমার আস্কারা পেয়ে পেয়ে মেয়ে মাথায় উঠে গেছে। মেয়ে মানুষ! শ্বশুরবাড়িতে যাবে। এই বদ অভ্যাসের জন্য না জানি কত কথা শুনতে হয় মেয়েকে! '
সেদিন মায়ের সে কথা শুনে মুখ ভেংচি কেটে বলেছিলাম, 'আমার শ্বশুরবাড়ির লোকজন মোটেই কথা শুনাবে না। উল্টা তারা তাদের এই খুশী বউকে আদর করে প্লেটে নিয়ে খাওয়াবে। ' আমার কথা শুনে বাবা হাহাহাহা করে হেসেছিলেন আর মা রগে গজগজ করতেছিলেন। 

সেদিন মা ঠিক ছিলো আর আমি ভুল ছিলাম। আমার শ্বশুরবাড়ির লোকজন নিষ্ঠুর, প্রচন্ড রকমের নিষ্ঠুর।  এই বাড়িতে বউ হয়ে আসার পর মুরগির রান তো দূরে থাক আমার পাতে মুরগির গলা বা গিলা আর সাথে সামান্য ঝোল পড়ে। মাছের মাথা তো দূরে থাক ভাগ্য ভালো হলে কোনদিন মাছের একটা টুকরো ভাগে আসে, না হলে খালি ঝোল। 
আমার শশুরবাড়ির অবস্থা খুব খারাপ এমনটা নয়। তবে আমার শ্বাশুড়ি অনেক মেপে মেপে সব রান্না করেন। খাবারের সময় তিনি তার মেয়ে, মেয়ের জামাই, নাতি নাতনি, নিজের ছেলে আর স্বামীকে নিয়ে খেতে বসেন। আমি তখন নিজের রুমে বসে অপেক্ষা করি কখন তাদের খাওয়া শেষ হবে, কখন নিজে খেতে পারবো। 

বিয়ের আগে খেতে চাইতাম না। মা পিছন পিছন খাবার নিয়ে ঘুরতো। আর, এখন পেটের ক্ষুধায় যা পাই তাই খাই। বাড়তি কোন খাবার, ফল কিছুই কপালে জুটে না। 
মনে প্রশ্ন জাগছে না তারা কেন আমার সাথে এমন করে? আর, আমি কেনই বা এখানে পড়ে আছি?

বিয়ের কয়েকদিন পর আমার শ্বাশুড়ি সরাসরি আমাকে বলেছে আমার বাবার যা যা আছে সব তার ছেলের নাম লিখে দিতে। যেহেতু আমার কোন ভাই বোন নেই। বাবার সব তো আমিই পাবো। আর, আমার সবকিছু তো আমার স্বামীর হবে। তাই উনার কথা অনুযায়ী সবকিছু এখনই আমার স্বামীর নাম লিখে দিতে হবে। 

আমার শ্বাশুড়ির কথা যখন আমি আমার স্বামীকে বললাম। আমার স্বামী ঠান্ডা গলায় বললো, 'খারাপ কি বলেছে, মা?মায়ের কথামত সব করলেই পারে!'সেদিন মনে হয়েছিলো চিৎকার করে কাঁদি। মানুষ চিনতে এতো বড় ভুল কিভাবে করলাম আমি! আমার বাবা ঠিকই আঁচ করতে পেরেছিলেন এদের সম্পর্কে। আমিই ভুল ছিলাম। এখন না পারছি সইতে, না পারছি কইতে!

মানুষের উপর থেকে দেখে কোন জাজ করা যায় না। পিয়াসের মনের ভিতর এতো লোভ ঘাপটি মেরে ছিলো কখনো বুঝতে পারি নি। ওদের পরিবার সম্পর্কে বাহিরের লোকজনের ধারণাও খুব একটা খারাপ নয়। একই গ্রামে বসবাস করি। যদি আগে কখনো শুনতাম ওদের পরিবার এতো লোভী আর নিষ্ঠুর, কখনো কি এই পরিবারের ছেলেকে ভালোবাসি আর বিয়ে করি!

বাবা কেন ওদের পছন্দ করতো না সে কারণ তিনি কখনো বলেন নি। আমার মনে হয়েছিলো পিয়াসের বোনেরা এখানে থাকে বলে হয়তো বাবা আমাকে এখানে পাঠাতে চায় নি। কিন্তু সব কেমন জানি এলোমেলো হয়ে গেলো...

প্রকৃতি নাকি প্রতিটি মানুষকে তার কর্মফল ভোগ করায়। শুধুমাত্র প্রকৃতির বিচার দেখবো বলে অপেক্ষা করছিলাম। কিন্তু এতো তাড়াতাড়ি প্রকৃতি বিচার করবে ভাবতে পারি নি। পিয়াসের বড় দুই বোন এই বাড়িতেই থাকে। ছোট বোনের বিয়ে হলো, শ্বশুরবাড়িতে গেলো। আমার সাথে পিয়াসের পরিবার যা যা করেছে এবং করছে, পিয়াসের ছোট বোনের সাথে হুবুহু সেই ঘটনা ঘটেছে। 

আজকে আমার খুব আনন্দ হচ্ছে। বাহিরের বাতাসে আমার চুল শুকিয়ে গেছে। মা আর মেয়ে এখনো কাঁদছে। আমি ব্যাগ গুছাচ্ছি। এই বাড়ির কান্না শুনতে শুনতে আমি আজকে বাপের বাড়ির উদ্দেশ্য আনন্দ যাত্রা করবো। মুক্ত হবো এমন লোভী আর নিষ্ঠুর পরিবার থেকে। 

#গল্প 
#আনন্দ_যাত্রা 

লেখা : ফারজানা আক্তার 
ছবি : নাজমুল হাসান হিমেল 

Leave a Comment