যেমন শাশুড়ি তেমন বউ (পর্ব-০৭)

  • কামরুন নাহার স্মৃতি
  • অক্টোবর ২০, ২০২০

সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে রাত আর তার সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ব্যথার গল্প। আমি যেন সেখানে ডানা ভাঙ্গা কোন এক ব্যথাতুর প্রাণী। সময় কেমন মানুষকে পালটে দেয়, একসময় যেই মানুষগুলো ছাড়া নিজেকে একাকী, নিঃস্ব মনে হয় অথচ সময়ের ব্যবধানে তাদের ছাড়াই কেটে যায় সময়, নিঃসঙ্গতা। কি আশ্চর্য জীবন! কি আশ্চর্য অনুভূতি! রাহাতের মুখে যখন এই পরিবারের মানুষগুলোর গল্প শুনতাম তখন শুধুই মনে হত এই মানুষগুলোকে ছাড়া আমি একা। কারণেঅকারণে এইসব মানুষগুলোকে কাছে পেতে চাইতাম, মনে হত এই মানুষগুলো ছাড়া আমি অসম্পূর্ণ। কত স্বপ্ন আর কল্পনার জগত বানিয়েছিলাম এই মানুষগুলোকে নিয়ে অথচ বাস্তবতা কত কঠিন! সকাল হলেই আমাকে যেতে হবে সে রাহাতও জানে আর আমিও। রাহাতের প্রতি আমার কোন অভিযোগ নেই কিংবা এই পরিবারের কারো উপর! আজকের রাতটা যেন একটু বেশিই আঁধারে মুখ লুকিয়েছে, হয়তো এ আমার মনের ভুল। আমার মনের সমস্ত কালো দিয়ে রাতটা দেখছি তাই হয়তো চারপাশের সবকিছু কালো আর কালোয় ঢাকা, এতোটুকু আলোর দেখা নেই।আলো আর অন্ধকারের লড়াইয়ে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি কে জানে!
....
সকালবেলা ঘুমটা এমনিতেই ভেঙ্গে গেল। আজ কারো ডাকতে হলো না, চিৎকার - চেঁচামেচি করতে হলো না। বাহিরে মায়ের কর্কশ গলার আওয়াজও পাওয়া যাচ্ছে না। তাহলে কি কেউ বাড়িতে নেই না কি আজ কারো ঘুম ভাঙ্গে নি! আমি চোখ মলতে মলতে উঠলাম, বাহিরে বেরিয়ে দেখলাম সবাই বসার ঘরে কিন্তু না চিৎকার আছে আর না গল্পের আসর। আমি আরো আশ্চর্য হলাম শাশুড়ি'মাকে দেখে যার মুখে কথার খই ফুটতো আর সবাই ভয়ে ভয়ে তার কথা শুনতো তিনি কি না আজ চুপচাপ। তা যাই হোক হয়তো মেয়েটার কথা ভীষণ মনে পড়ছে। আমার শাশুড়ি'মা সকাল সকাল মুড়ি মাখা খেতে ভীষণ ভালোবাসে, ভাবির মুখে শুনেছি বেশ কয়েকবার। রান্নাঘরে ভাবিকে বললাম,
- মায়ের তো মন খারাপ, মুড়ি মাখলে কেমন হয় ভাবি? তুমি তো বলেছিলে মা খুব ভালোবাসে।
- হ্যা রে। তুই একটু হাতে হাতে করে দে না। 

আরো পড়ুনঃ গর্ভাবস্থায় খাবারের তালিকার সাধারণ ধারণা !

আমি মুড়ি মাখা নিয়ে বসার ঘরে গেলাম। শাশুড়ি'মা তখনও চুপচাপ, মুখে একটাও কথা নেই। বাবার কথায় আমিও গল্পে যোগ দিলাম। গল্প শেষে মা রাহাতকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
- রুমির বিয়ে তো শেষ, এবারও কি ওই মেয়েটা এই বাড়িতে থাকবে! এ বাড়িতে থাকার এসব নতুন ধান্ধা নাকি! নাকি আমার কথার আজকাল কারো কাছে মূল্য নেই।
বাবা রেগে বললেন,
- চাইলেই কি কাউকে যেতে বলা যায় নাকি! ওকে তোমার ছেলে বিয়ে করে নিয়ে এসেছে এখানে, ভুলে গেছ তুমি?
এই প্রথম বাবাকে রাগতে দেখলাম। আসছি থেকে তো চুপচাপই থাকতে দেখেছি।
- আপনারা নিজেদের মধ্যেকার সম্পর্ক নষ্ট করবেন না আমার জন্য, আমি এমনিতেও আজকে চলেই যেতাম। কেন জানেন মা? কারন আমিও মানুষ আর একটা মানুষ কখনোই ঘৃনা, অপমান কিংবা তিক্ত কথার জালে নিজেকে জড়াতে চাই না। ভালোবাসা না হোক সম্মানটা তো সবারই প্রাপ্য। অনেক স্বপ্ন নিয়ে এসেছিলাম কিন্তু সেগুলো যে দুঃস্বপ্নে পরিণত হবে একবারও ভাবিনি। আমি জানি আমি চলে যাওয়ার পরপরই হয়তো আপনারা রাহাতের আবার বিয়ে দেবেন, তাতেও আমার কোন আপত্তি নেই। কারন আমি শুধু রাহাতকে চাইনি, রাহাতের পরিবারও চেয়েছি। রাহাতের আবার যে বউ আসবে তাকে প্লিজ আমার মতো তিক্ততা উপহার দেবেন না, পারলে একটু ভালোবাসা আর সম্মান দিয়েন। একটা মেয়ে সবকিছু ছেড়ে, জন্মের পর থেকে বেড়ে উঠা আপন মানুষগুলোকে ছেড়ে নতুন পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে আসে কিন্তু তাকে একা ভেবে অন্যায়, অত্যাচার করা শাশুড়ি'র জন্যই বউরা একসময় আলাদা হয়ে যায় কিংবা সুযোগমত শাশুড়িকে ও হাতের পুতুল বানায়।
কথাগুলো বলে দ্রুত ঘরে চলে গেলাম। এভাবে আমি কখনো কাউকে বলিনি কিন্তু এই বাড়িতে আসার পর থেকে আমি খুব খারাপ ব্যবহার করতে শিখে গেছি। আর কিই বা করতাম আমি! স্বপ্ন ভাঙ্গার কষ্ট শুধু সেই জানে যার ভাঙ্গে, অন্য কারো বোঝার ক্ষমতা নেই। চলে যাবার জন্য আমি পুরোপুরি প্রস্তুত শুধু ডাইরিটা কোথাও খুঁজে পাচ্ছিনা। কিন্তু বিছানাতেই তো রেখেছিলাম, কই চলে যাবে! ডাইরির তো আর হাত পা নেই। খুঁজতে খুঁজতে রাহাতের টেবিলে পেলাম খোলা অবস্থায় হয়তো ওই পরেছে। একটা লেখায় চোখ আটকে গেল আমার, এ লেখা আমার খুব চেনা, এটা রাহাতের হাতের লেখা...
"ভালোবাসার সংজ্ঞা আমি জানিনা, সংজ্ঞা হয় কি না তাও জানি না কিন্তু তোমাকে ছাড়া বুকের ভেতর ভীষণ শূন্যতা অনুভব হয়, তোমাকে ছাড়া চারপাশটা ভীষণ শূন্য শূন্য লাগে! চারপাশে হাজারো মানুষের ভীড়ে নিঃসঙ্গতা ছুঁয়ে যায়। তোমাকে আমি ভীষণ রকম ভালোবাসি বলব না কারন যে ভালোবাসা আটকে রাখার ক্ষমতা থাকে না তাতে অধিকার ফলাতে নেই। তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচতে পারবো না তাও বলব না কারন কেউ কাউকে ছাড়া বাঁচতে পারেনা এটা মানতে পারিনি এখনো। খুব কাছের মানুষকে ছাড়াও বাঁচা যায় কিন্তু জীবন্ত মানুষ হয়ে নয়, জীবন্ত লাশ হয়ে। ভুল বুঝোনা, ভালো থেকে আর পারলে অন্য কারো রঙে নিজেকে রাঙিয়ে নিও, আমি তো তোমাকে শুধুই বেদনার রং দিয়েছি, পারলে না হয় মুছে ফেলো।"
সত্যিই কি ভালোবাসার রং মোছা যায়? যতোই হোক তা বেদনায় গাঢ় রং এ ঢাকা! আর একবার নিজেকে রাঙিয়ে নিলে আর কি সত্যিই রাঙানো যায়? জানিনা আমি, কিন্তু চলে যেতে হবে রংহীন তা আমি জানি। সবার ভাগ্যে রঙ থাকে না আর রঙে রাঙানোর মানুষ ও থাকেনা। অনেক চাওয়া কখনোই পাওয়া হয় না, সারাজীবন চাওয়াই রয়ে যায়।
.....
ঘর থেকে বেরিয়ে পড়লাম, চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে বারবার। অনেক চেষ্টা করছি নিজেকে বোঝাতে যে এদের আমি আপনই ছিলাম না আর আমি কাঁদব না, কাঁদব না আমি! নিজেকে নিজেই বারবার বললাম, আমি দূর্বল নই যে এইটুকু আঘাত সহ্য করতে পারব না, যা কখনো আমার ছিলোই তা ভেবে কেন কষ্ট পাচ্ছি আমি! কিন্তু মন তো আর কারো হুকুমের গোলাম নয় যে মালিকের কথামত ঠিকঠাক কাজ করবে। শাশুড়ি'মাকে বললাম,
- আমি চলে যাচ্ছি মা, ভালো থাকবেন। আর পারলে এই কয়েকটা দিন দুঃস্বপ্ন ভেবে ভুলে যাবেন। আর আমার খারাপ ব্যবহারের জন্য ক্ষমা করবেন। একটা আবদার শুধু। রাখবেন মা?
- কি, বলো?
- আমি রাহাতের সাথে এ বাড়িতে এসেছিলাম আর রাহাতের সাথেই এ বাড়ি থেকে যেতে চাই। প্লিজ মা....
- ঠিক আছে। 

আরো পড়ুনঃ গর্ভাবস্থায় খাওয়ার বিষয়ে কিছু সতর্কতা !

বাবা, ভাই, ভাবি সবার চোখ ছলছল করছিল কিন্তু আমি অপারগ ওদের সবার মুখে হাসি ফোটাতে। আসছি বলে বেরিয়ে পড়লাম, আর কিছু বলার বা শোনার ক্ষমতা নেই আমার। আমি হেরে গেছি। রাহাত বাইক নিয়ে বাহিরে অপেক্ষা করছে, আমি চুপচাপ বাইকে গিয়ে বসলাম। অবশ্য আমার এ কষ্টে রাহাতের তো কোন হাত নেই, ও তো আমাকে বলেছিল যে আমি পারবোনা। সত্যি বলেছিল ও, আর মিথ্যা ছিলাম আমি। আমি ভেবেছিলাম ভালোবাসা দিয়ে পৃথিবীর সবকিছু জয় করা যায় কিন্তু আমি কল্পনা আর স্বপ্নের ঘোরে ছিলাম। বাস্তবতা খুব কঠিন, যন্ত্রনার। কয়েকটা মাত্র দিনে কেমন সবকিছু ওলট পালট হয়ে গেছে। আজও বাইকে আমি আর রাহাত পাশাপাশি আর সেদিন ও ছিলাম কিন্তু সেদিন আমাদের সাথী ছিল একবুক স্বপ্ন, নতুন স্বপ্ন জয়ের প্রবল ইচ্ছা কিন্তু আজ মনজুড়ে শুধুই বিষাদ, কষ্ট আর স্বপ্ন ভাঙার যন্ত্রনা। আমি হেরে গেছি, হেরে গেছি আমি!
- রাহাত?
- হুম
- তোমার নতুন বিয়ে হলে আমাকে জানাবে না? জানিয়ো যেতে না পারি তবুও গিফট পাঠাবো।
- আমার আর বিয়ে হবে না, তুমি বরং নিজেকে সাজিয়ে গুছিয়ে নিও।
- হুম, নেব তো। তোমার যতটুকু রঙ আমার কাছে আছে ততটুক দিয়ে ঠিক সাজিয়ে নেব।
- থেকে গেলে হয় না।
- না রাহাত, তা আর হয়না। সব চাওয়া পূর্ন হয় না, অপূর্নও রয়ে যায়। ভালো থেকো।
- তুমি ভালো থাকবে?
- কেন থাকব না রাহাত? খুব ভালো থাকবো! পারলে আমায় ভুলে যেও।
- তুমি পারবে?
- হয়তো কখনওই না, মন কি আর আমার হুকুম মানে!
- রুমি কিন্তু বাড়িতে আসলে খুব কষ্ট পাবে তোমার জন্য।
- তুমি পাবে না?
প্রশ্নটার কোন উত্তর হয়তো রাহাত খুঁজেই পেল না, তাই দীর্ঘশ্বাস দিয়ে তা ঢেকে দিল। নয়তো এই প্রশ্নের কোন উত্তরই হয় না, আর কিই বা দু'জন দু'জনাকে মনে রেখে কিন্তু তবুও মনে রয়ে যায়। আমার চিরচেনা সেই বাড়িটার সামনে দু'জনে, কিন্তু দু'জনের মাঝে যোজন যোজন দূরত্ব, দু'জনার মাঝখানে অভেদ্য দেয়াল। রাহাত ভেতরে এলো না, কয়েকপলক চেয়ে চলে গেল নিজের ঠিকানায়। সবকিছু ঠিক আগেরই মতো আছে শুধুই আমিই পালটে গেছি! বাবা - মা ঘরে ঢুকে প্রশ্ন করতে শুরু করলো
- নিজেকে একবারও দেখেছো, চোখ মুখ কেমন শুকিয়ে গেছে। ওখানে নিশ্চয় অশান্তি হয়েছে, নিষেধ করেছিলাম তুমি তো শুনলেই না আর রাহাতই বা ভেতরে আসল না কেন? কি হয়েছে বলো?
- এখন আমাকে একা থাকতে দাও প্লিজ, পরে সব বলব।
বাবা - মা আর প্রশ্ন করেনি।
যতো সময় পেরিয়ে যাচ্ছে ততোই ব্যথার পাহাড় যেন আমার মাথার উপর চেপে বসতে চাইছে। আমি তো ভালোবেসেছিলাম রাহাতকে আর ওর সাথে জড়িয়ে থাকা সবাইকে কিন্তু...
হয়তো রাহাতেরও এমন হচ্ছে, বুকের ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে শেষ হয়ে যেতে চাচ্ছে। কিন্তু কিছু করার উপায় নেই কারোর।
দেখতে দেখতে ৫দিন কেটে গেল। রাহাত হয়তো এর মধ্যে অনেকবার ফোন করেছে আমাকে কিন্তু ফোন বন্ধ ছিল বলেই কথা হয়নি। যত সময় যাচ্ছে ততোই নিজের কষ্টগুলো নিজেকেই উপহাস করছে। হয়তো আমাদের সম্পর্কটার এখানেই ইতি, সারাজীবন বুকের ভেতরের এই ক্ষতটা যত্নেই থাকবে। ভালোবাসার রঙে রাঙানো মানুষগুলো বুকের ভেতরে ঠিক ততোটাই যত্নে থাকবে। সত্যিই হয়তো আর পাবোনা বুকের ভেতরের সেই মানুষটাকে..সত্যিই হয়তো সংসার, স্বামী আর শ্বশুরবাড়ি সবার কপালে থাকে না ; আমার কপালেও নেই। 

আরো পড়ুনঃ ঋতু পরিবর্তনের সাথে সাথে রোগব্যাধি বাড়ার কারণ !

(চলবে....)

এ সম্পর্কিত আরও পোস্ট

Leave a Comment