ম্যারি কুরি: বিশ্বে প্রথম এবং একাধিকবার নোবেল বিজয়ী নারীর কথা

  • ওমেন্সকর্নার ডেস্ক 
  • জানুয়ারি ৫, ২০১৯

প্রথম নোবেল বিজয়ী নারী, এবং পৃথিবীর বুকে একমাত্র নারী যিনি একাধিকবার নোবেল পুরষ্কার জিতেছেন, তাও আবার দুটি ভিন্ন বিষয়ে। এই পোলীয় ও ফরাসি বিজ্ঞানী ১৯০৩ সালে তেজস্ক্রিয়তার উপর গবেষণার জন্য তার স্বামী পিয়ের ক্যুরি এবং তেজস্ক্রিয়তার আবিষ্কারক অঁরি বেকেরেলের সাথে যৌথভাবে নোবেল পুরস্কার পান। সেই ছিলো প্রথম মহিলা বিজ্ঞানী যে বিজ্ঞানের দুইটি ভিন্ন শাখায় দুইবার নোবেল পুরস্কার জেতেন। সে প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়েরও প্রথম মহিলা অধ্যাপক ছিলেন।

১৮৬৭ সালে পোল্যান্ডে জন্ম নেওয়া ম্যারি কুরি ছোটবেলা থেকেই অসম্ভব প্রতিভার পরিচয় দিয়ে এসেছেন। স্কুলে বরাবর প্রথম হওয়া এই মেয়েটি প্রথম ধাক্কা খায় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে গিয়ে, যখন জানতে পারে তাঁর এলাকার বিশ্ববিদ্যালয়টি কেবল “পুরুষ”দের জন্য উন্মুক্ত এবং সেখানে তাঁর কোন প্রবেশাধিকার নেই! এ কথা শুনে ভীষণ জেদ চেপে গেল কুরির, ছেলেবেলায় মা হারানো মেয়েটি সিদ্ধান্ত নিলো বিজ্ঞান চর্চার অভিযান চলবেই!

যেই ভাবা সেই কাজ, শহরের এক কোণে “ভাসমান বিদ্যালয়” নামে একটি জায়গা ছিল, যেখানে গোপনে কুরির মত অনেক জ্ঞানপিপাসু মেয়ে পড়ালেখার সুযোগ পেত। কিন্তু এ সুযোগও বেশিদিন টিকলো না। অর্থের অভাবে বন্ধ হয়ে গেল বিদ্যালয়টি, কুরিও পড়লেন জীবনযুদ্ধের নানা বিড়ম্বনায়। বহু বছর শিক্ষকতা আর গভর্নেসের কাজ করে সংসারের খরচ যোগাতেন তিনি। অবসর সময়ে পদার্থ, রসায়ন ইত্যাদি বিষয় নিয়ে বুভুক্ষের মত পড়াশোনা করতেন। কিন্তু এভাবে আর কতদিন? অবশেষে বহু বছরের যা কিছু সম্বল সব নিয়ে পাড়ি জমালেন তিনি প্যারিসে, ভর্তি হলেন বিখ্যাত সরবোন বিশ্ববিদ্যালয়ে।

বিজ্ঞানের বিচিত্র সব বিষয় নিয়ে নাওয়া-খাওয়া ভুলে গবেষণা করতে লাগলেন কুরি, কিন্তু রোজগার? রোজগার করতে গেলে গবেষণার সময় কমে যাবে, তাই জ্ঞানপিপাসু কুরি কোনমতে আধবেলা একবেলা খেয়ে সারাদিন পড়ে থাকতেন গবেষণাগারে। স্বাস্থ্যের প্রতি নিদারুণ অযত্নের ছাপ পড়তে শুরু করলো শরীরে, চোখমুখ বসে গেল মানুষটার, তারুণ্যের উচ্ছ্বল সৌন্দর্য্যে ভর করলো ক্লান্তির ছাপ, কিন্তু কুরির চোখের দিকে তাকালে তা বুঝবার উপায় নেই!

এই গবেষণাগারেই পরিচয় হলো তার এক ফরাসী পদার্থ বিজ্ঞানীর সাথে, নাম তার পিয়েরে কুরি। বিজ্ঞান সাধনায় দুজনেরই অসীম আগ্রহ, পরিচয় তাই পরিণয়ে রূপ নিতে বেশিদিন লাগলো না। দুজন মিলে পদার্থ, রসায়ন, গণিত সহ বিজ্ঞানের নানান শাখায় গবেষণায় কাটাতে লাগলেন দিনরাত।

বিজ্ঞানী যুগলের এই গবেষণা বিফলে গেল না, বিয়ের মাত্র আট বছরের মাথায় পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল জিতলেন দুজন একসাথে। পুরষ্কারের অর্থ প্রায় পুরোটাই খরচ করলেন গবেষণার কাজে, সংসার আলো করে এলো কুরি দম্পতির প্রথম সন্তান, কিন্তু এমন সময় একটি বিপর্যয় এলোমেলো করে দিলো মেরি কুরির জগৎ। সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেলেন প্রিয়তম স্বামী, বিজ্ঞান চর্চায় সহকর্মী পিয়েরে কুরি। চোখের জলে ভাসলেন শোকে বিহ্বল কুরি, কিন্তু দাঁতে দাঁত চেপে সিদ্ধান্ত নিলেন স্বামীর গবেষণাকে এগিয়ে নিয়ে যাবেন। খরচ যোগাতে সরবোনে যোগ দিলেন শিক্ষক হিসেবে, বিশ্ববিদ্যালয়টির ইতিহাসে প্রথম নারী প্রফেসর হলেন তিনি। ১৯১১ সালে রসায়নে অনন্য অবদান রাখার জন্য আবার নোবেল পুরষ্কারে ভূষিত হলেন মেরি কুরি, সবার চোখের সামনে পুরষ্কার বিতরণী মঞ্চে কুরি একাই উঠলেন, কিন্তু তাঁর মনের জগতে যে বিদেহী স্বামীর অবস্থান সবসময় হৃদয়ের মাঝে।

তিনি তাঁর সততা ও সুশৃঙ্খল জীবনাচরণের জন্য বিখ্যাত ছিলেন। ১৮৯৩ সালে তিনি একটি ছোট বৃত্তি পান যা তিনি ১৮৯৭ সালে নিজ যোগ্যতায় অর্থ উপার্জনের সাথে সাথে ফিরিয়ে দেন। তাঁর প্রথম নোবেল পুরস্কারের সাথে প্রাপ্ত অর্থের অনেকটাই তিনি তাঁর বন্ধু-বান্ধব, পরিবার, শিক্ষার্থী এবং গবেষণা সহকারীদের দেন। ক্যুরি রেডিয়াম পৃথক করার পদ্ধতিটি পেটেন্ট না করার একটি চমৎকার সিদ্ধান্ত নেন যাতে বৈজ্ঞানিক মহলগুলো বাধাহীনভাবে গবেষণা চালাতে পারে। তিনি আরও চেয়েছিলেন যে অর্থ সহায়তা ও পুরস্কার তাঁকে না দিয়ে তিনি যে সমস্ত বৈজ্ঞানিক প্রতিষ্ঠানে যুক্ত ছিলেন সেগুলোকে দেয়া হোক। তিনি এবং তাঁর স্বামী প্রায়শই পুরস্কার ও পদক নিতে অনীহা প্রকাশ করতেন। বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইন এসবের ভিত্তিতে তাঁর সম্পর্কে মন্তব্য করেছিলেন যে তিনিই সম্ভবত একমাত্র ব্যক্তি যাকে খ্যাতি দ্বারা দুর্নীতিপরায়ণ করা যাবে না।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় হাসপাতালগুলোতে এক্স-রের সরঞ্জামের ঘাটতি ছিল। 

যুদ্ধাহত রোগিদের এক্স রে সঠিকভাবে করানোর অর্থ যোগাতে তিনি তহবিল সংগ্রহে নামেন। এসময় অসুস্থ শরীর নিয়ে তিনি ২২০ টি রেডিওলোজি স্টেশন গড়ে তোলেন। এর মধ্যে ২০০ টি ছিল বিভিন্ন জায়গায় স্থায়ী ছিল, এবং ২০ টি ছিল ভ্রাম্যমান। এগুলো তিনি বিভিন্ন ধনী মহিলাদের কাছ থেকে গাড়ি ধার নিয়ে তৈরী করেছিলেন। তিনি নিজেও বিভিন্ন স্টেশনে এক্সেরে করতে সাহায্য করতেন এবং যুদ্ধের সময় তার গড়া এই রঞ্জনবিদ্যা ইনস্টিটিউটগুলোয় প্রায় ১০ লাখ যুদ্ধাহতের এক্স রে করা হয়েছিল।

পোল্যান্ডের রাজধানী ওয়ারসতে নিজের গড়া রেডিয়াম ইনস্টিটিউটসহ তিনি অন্য একটি রেডিয়াম ইনস্টিটিউটে কাজ করতেন। রেডিয়াম বিষয় নিয়ে রেডিয়াম ইনস্টিটিউটে গবেষণা করে তিনি তার মেয়ে ইরিন, মেয়ের স্বামী ফ্রেডরিক জুলিয়েটের সাথে যৌথভাবে নোবেল পান। সারাজীবনের এত ধকল আর স্বামীর মৃত্যুর শোক কোনদিনই কাটিয়ে উঠতে পারেননি কুরি, দুঃখ ভুলতে রাত-দিন গবেষণাগারেই পড়ে থাকতেন, এই অস্বাভাবিক খাটুনির ধকল পড়তে শুরু করলো তার শরীরে, বিষাক্ত তেজস্ক্রিয়তায় আক্রান্ত হলো পুরো দেহ, অবশেষে বিশ্বজুড়ে লাখো ভক্তকে চোখের জলে ভাসিয়ে নশ্বর পৃথিবী থেকে বিদায় নিলেন ম্যারি কুরি, সমাহিত হলেন প্রিয়তম স্বামীর পাশেই। তিনিই ছিলেন প্রথম মহিলা যার অসামান্য মেধার কারণে ১৯৯৫ সালে প্যান্থিয়নে সমাহিত করা হয়। বিজ্ঞানের জগতে তার অসামান্য অবদান বিশ্ববাসী শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করবে চিরদিন।

Leave a Comment