মনস্তাত্ত্বিক ও সামাজিক রূপরেখা নির্ভর গল্পই আমার শক্তি

  • তন্ময় আলমগীর:
  • ফেব্রুয়ারি ৭, ২০১৯

‘একজন লেখকের কোনো পরিচয় নেই, সে সবার এবং সকলের। লেখক তার লেখনি দ্বারা এগিয়ে যায় এবং সকলের নিকট গ্রহণযোগ্যতা পায়। বোদ্ধা পাঠকেরাই সিদ্ধান্ত নেয় কোন লেখকের অবস্থান কোথায়‘ এভাবেই বলছিলেন শিক্ষক ও গল্পকার মুহাম্মদ কামাল হোসেন। এবারের বইমেলায় বেরিয়েছে তার প্রথম গল্পগ্রস্থ ‘অর্ধেক হুমাযূন অর্ধেক আমি‘। কুমিল্লা জেলার লালমাই উপজেলার ছোটশরীফপুর গ্রামে তার জন্ম ও শৈশবের বেড়ে উঠা। লেখালেখিটা এখনো শখের পর্যায়েই রয়েছে। একটি নতুন ভোরের প্রত্যাশায় প্রতিদিন লেখালেখি করে যাচ্ছেন। একটি সুন্দর স্বপ্নিল ও ভালোবাসাময় সহিঞ্চু সমাজ বিনির্মাণে কাগজ কলমের সঙ্গে গড়ে তুলেছেন এক অবিচ্ছেদ্য মিতালি।

তন্ময় আলমগীর : শুরুতেই জানতে চাই বইয়ের নাম 'অর্ধেক হুমায়ূন অর্ধেক আমি' কেন?

মুহাম্মদ কামাল হোসেন : ধন্যবাদ আপনাকে। বইয়ের নামকরণ নিয়ে প্রশ্নটা শুরু থেকে এপর্যন্ত কয়েক ডজনবার শুনতে হয়েছে আমাকে। যদিও এটা চমক হিসেবে রাখতে চেয়েছি। তবুও আপনি যখন প্রশ্নটা করেই ফেলেছেন, এটুকু বলতে পারি-পাঠক বিশেষত হুমায়ূন ভক্তরা এই গল্পে কিছুটা হলেও প্রয়াত হুমায়ূন আহমেদকে খোঁজে পাবে। কিছুটা মুহূর্ত হলেও তারা ভাবতে বাধ্য হবে, গল্পটা বুঝি হুমায়ূনের লেখা। বাকীটা না হয় রহস্যই থাকুক।

তন্ময় আলমগীর : দীর্ঘ ২০ বছর লেখালেখির পর প্রথম গল্পগ্রন্থ বেরুচ্ছে। এত সময় নিয়েছেন, কোন প্রতিবন্ধকতা ছিল কী?

মুহাম্মদ কামাল হোসেন : খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা প্রশ্ন করেছেন। এটা ঠিক দীর্ঘ প্রায় দু'যুগ ধরে লেখালেখিতে রয়েছি। এই সময়টা পত্রিকা লেখালেখিতেই সীমাবদ্ধ ছিলাম। হয়তো নামের পাশে বইয়ের সংখ্যাটা ডজন বা অর্ধ ডজনখানেক থাকতে পারতো। সংখ্যাটা আমার নিকট নিছকই একটা সংখ্যা। আসলে বই প্রকাশ নিয়ে কখনো সেরকম অর্থে অতটা ভাবার অবকাশ পাইনি। প্রতিবন্ধকতা ছিল না। নিজেকে হয়তো লেখক হিসেবে যোগ্য মনে করিনি, এটাও একটা কারণ হতে পারে।

তন্ময় আলমগীর : জাতীয় দৈনিকগুলোতে আপনার সরব উপস্থিতি। কর্মব্যস্ততার মাঝেও লেখালেখির সময় বের করেন কিভাবে?

মুহাম্মদ কামাল হোসেন : মূলত লেখালেখির জন্য উত্তম সময় হলো রাত ও সকালবেলা।  এছাড়াও একটু ফুরসত পেলে কাগজ কলম নিয়ে বসে যাই। আরেকটা কথা আপনাকে বলতে হচ্ছে, আমার মাথায় কোনো একটা গল্পের প্লট চলে আসলে খেলা চলতে থাকে। ব্যস্তার কারণে কাগজ কলম হয়তো সাময়িক চলেনা, কিন্তু মাথায় ঘটনার পরম্পরা, চিত্রনাট্যের রূপরেখা, ঘষামাজা এগুলো চলতেই থাকে। তখন একটা ঘোরের মধ্যে থাকি আমি। গল্পটা শেষ না করা অব্ধি সেই ঘোর কাটতে চায় না।

তন্ময় আলমগীর : মানুষ এবং সমাজকে কেন্দ্র করেই আপনার গল্পগুলোর কাঠামো গড়ে ওঠে। বর্তমান সমাজের রুপরেখা এবং মানুষের মনস্তাত্ত্বিক দিক নিয়ে কিছু বলুন।

মুহাম্মদ কামাল হোসেন : আপনি ঠিক বলেছেন। মানুষের মনস্তাত্ত্বিক দিক ও সামাজিক রূপরেখা নির্ভর গল্পগুলোই আমার শক্তির জায়গা। এগুলো মানুষকে সহসায় ছুঁয়ে যায় ও হৃদয়ে সবচে বেশি দাগ কাটে। আবেগে সিক্ত হতে ভালোবাসে সমাজের প্রতিটি স্তরের মানুষ। যাপিত জীবনের চেনা গল্পগুলো তারা বারবার শুনতে চায়।

তন্ময় আলমগীর : গ্রন্থভুক্ত সব গল্পেই কি হুমায়ূন আহমেদের প্রভাব আছে?

মুহাম্মদ কামাল হোসেন : জননন্দিত হুমায়ূন আহমেদকে উপেক্ষা করা কঠিন। একথা স্মরণ রাখতে হবে আমরা হুমায়ূন জমানার লেখক। হুমায়ূনের প্রভাব এই যুগের লেখকদের মাঝে নেই, সেটা বিশ্বাস করা কঠিন। কোনো না কোনো ভাবে হুমায়ূন আমাদের মাঝে বিরাজমান। সংগত কারণে আমার মধ্যেও একটা হুমায়ূন আছে। সেই অর্থে নন্দিত কথাসাহিত্যিকের প্রভাব তো রয়েছেই। সেটা লেখালেখিতে না হলেও মনোজাগতিক ভাবনা চিন্তায়। তবে আমি বরাবরি চেষ্টা করেছি, লেখালেখিতে আমার নিজস্ব একটা ট্রেন্ড বা ধারা কিংবা স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখতে। সেকারণে গ্রন্থভুক্ত সব গল্পে হুমায়ূনের প্রভাব নেই, সেটা নিঃসন্দহে বলা যায়।

তন্ময় আলমগীর : লেখালেখি নিয়ে নিশ্চয়  মজার কোনো স্মৃতি আছে আপনার। তা জানতে চাই।

মুহাম্মদ কামাল হোসেন : অবশ্যই খুব মজার ও আশ্চর্যের একটা স্মৃতি রয়েছে লেখালেখি নিয়ে। আমার জীবনের প্রথম প্রকাশিত অনুগল্পটির নাম ছিল 'মাল্টিকালার সুখ'। সেটা ১৯৯৯-২০০০ সালের দিকে দৈনিক ইনকিলাবে প্রকাশিত হয়েছিল। ইনকিলাব তখনকার সময়ে সবচেয়ে জনপ্রিয় দৈনিক। তখন আজকের মতো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ছিল না, ইপেপারও ছিল না। যোগাযোগ ব্যবস্থাও আজকের মতো অতটা যুগোপযোগী ও আধুনিক ছিল না। পত্রিকার হকার মফস্বলে বিকেল ৩-৪ টার দিকে পত্রিকা নিয়ে আসতো। সংগত কারণে নানা জটিলতায় প্রথম প্রকাশিত লেখাটি আমি পাইনি। অথচ যেকোনো লেখকের জন্য প্রথম প্রকাশিত লেখা স্পেশাল, একটা ভিন্ন আবেগ তৈরী করে। আমি সেটা থেকে প্রায় বঞ্চিত হচ্ছিলাম। একটা দুঃখবোধ ভেতরে ভেতরে থাকলেও মনে মনে বিশ্বাস রেখেছি, লেখাটি নিশ্চয় কোনো না কোনো উপায়ে হয়তো একদিন পেয়ে যাবো। অবশেষে আমার বিশ্বাসেরই জয় হয়েছে। প্রায় চার বছর পর ঈদে নতুন কেনা লুঙ্গির ভেতরে আমার ওই প্রকাশিত লেখাটার পরপর তিনকপি পেয়েছি! আমার জীবনের প্রথম অভিমানী লেখাটা এতটা নাটকীয়তা ও রোমাঞ্চে আমার নিকট ফিরে আসবে দুঃস্বপ্নেও ভাবিনি!! অথচ এটাই সত্যি। জগতের অনেক আশ্চর্য ও ব্যাখ্যাতীত ঘটনাগুলোর মতো আজও এটার কোনো জুতসই ব্যাখ্যা খোঁজে পাইনি।

তন্ময় আলমগীর : লেখালেখি নিয়ে আপনার স্বপ্ন কী? লেখালেখি দিয়ে কি সমাজ পরিবর্তন করা যায়?

মুহাম্মদ কামাল হোসেন : আমি একজন স্বপ্নচারী মানুষ। স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসি। এই লেখালেখির কারণে বহু মানুষের ভালোবাসা ও সম্মান পেয়েছি। আমার পাঠকের একটা বিশাল অংশ নারী। কোনো এক অজ্ঞাত কারণে তাদের কাছ থেকে সহযোগীতা ও উৎসাহ-উদ্দীপনা একটু বেশি-ই পেয়ে আসছি। আমার লেখালেখিতে নারী-পুরুষ ও শিশু-কিশোর নির্বিশেষে সকলের অবদান অনস্বীকার্য। স্বপ্ন দেখি এই মানুষগুলোর জন্য আমৃত্যু লিখে যাব। ভালোবাসার চেয়ে পবিত্র জগতে আর কিছু নেই। আমি ভালোবাসতে ভালোবাসি। লেখালেখি দ্বারা সমাজ পরিবর্তন অবশ্যই সম্ভব। কাজটা অনেক কঠিন ও চ্যালেঞ্জিং হলেও অসাধ্য নয়।

তন্ময় আলমগীর : লেখালেখির জন্য কারা আপনাকে অনুপ্রাণিত করে এবং কেন?

মুহাম্মদ কামাল হোসেন : দারুণ প্রশ্ন করেছেন। একটা ছোট্ট পিপীলিকার জীবন সংগ্রাম থেকেও আমি দারুণ অনুপ্রাণিত হই। দেখার মতো চোখ থাকলে সব কিছু থেকে অনুপ্রাণিত হওয়ার কোটি কোটি উদাহরণ আমাদের চারপাশে রয়েছে। আমাকে লেখালেখিতে অনেকে অনুপ্রাণিত করে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। আমার পরম শ্রদ্ধেয় মা বাবা, বড় ভাই ও স্ত্রী থেকে শুরু করে আমার অনেক পাঠক শুভাকাংখী প্রতিনিয়ত এই অনুপ্রেরণার কাজটি করে যাচ্ছেন। এছাড়া আমার রাজনৈতিক আদর্শে ভিন্নতা বা মতানৈক্য থাকলেও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও আমার লেখালেখি সত্তার সঙ্গে জড়িত রয়েছেন প্রায় দু'যুগ পূর্ব থেকে। আমার লেখালেখির বীজ বপন হয়, শেখ হাসিনার রচিত 'ওরা টোকাই কেন' বইটি পড়ার মধ্য দিয়ে। নব্বই দশকের শেষের দিকে পড়া ওই বইটির প্রতিটি ছত্র আজও আমার হৃদয়ে গ্রোথিত রয়েছে। একজন রাষ্ট্রনায়কের পরিচয় ছাড়াও তিনি যে একজন দারুণ লেখক ও কথাসাহিত্যিক এই বিষয়টা হয়তো আজকের তরুণ সমাজের অনেকেই সেরকম অর্থে জানে না।

তন্ময় আলমগীর : আপনার গল্পে নারী স্বাধীনতার প্রভাব কতটুকু?

মুহাম্মদ কামাল হোসেন : আমার গল্পে নারী স্বাধীনতার বিষয়টি বেশ জোরালোভাবে রয়েছে। নারী স্বাধীনতা মানে বেলেল্লাপনা নয়, নারীর স্বকীয়তা ইজ্জত আব্রু ও প্রতিপত্তি সম্মান অটুট রেখে ওরা সর্বক্ষেত্রে সমান এগিয়ে যেতে পারে। ওদের সম্ভাবনাকে সর্বোচ্চ কাজে লাগাতে হবে। আমি বরাবরি বিশ্বাস করি, নারী পুরুষ একটি দ্বিচক্রযানের মতো। পুরুষ যদি একটি চাকা হয়,দ্বিতীয় চাকাটি নিঃসন্দেহে হলো নারী। এর ব্যত্যয় হবার কোনো সুযোগ নেই। নারী ও পুরুষের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় একটি সমাজ বা রাষ্ট্র নিশ্চিতভাবে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব। আরেকটি বিষয় আমি বিশ্বাস করি, নারী ও পুরুষকে কিছু কর্মক্ষেত্রে লৈঙ্গিক দৃষ্টিকোণ থেকে না দেখে মানুষ হিসেবে গণ্য করাই শ্রেয়। এতে কর্মক্ষেত্রের পরিবেশ ঠিক থাকে। লিঙ্গ বৈষম্য কিংবা লিঙ্গ পার্থক্যগুলো মানুষের মনস্তাত্ত্বিক  চিন্তা চেতনা ও মানসিকতায় নেতিবাচক কিছু উস্কে দিতে পারে। নৈতিকতার স্খলন রোধে উন্নত মানসিকতা তৈরী জরুরি। এসব বিষয়ে স্ব স্ব অবস্থান থেকে সবাইকে খোলনচে পরিবর্তন হওয়া জরুরি। আমার গল্পগুলোতে এসববিষয়গুলো বেশ সতর্কতার সহিত জোরালো ভাবে রাখার চেষ্টা করি।

তন্ময় আলমগীর : পাঠকের উদ্দেশ্যে কিছু বলুন?

মুহাম্মদ কামাল হোসেন : লেখক পাঠক ও প্রকাশক শব্দগুলো একইবৃন্তে তিনটি ফুলের মতো। পাঠক একজন লেখককে সবসময় উৎসাহ উদ্দীপনা দিয়ে থাকে। তাদের আলোচনা সমালোচনা লেখকের ভুল ত্রুটিগুলো সংশোধনে সাহায্য করে। একজন লেখককে শাণিত করতে তাদের অবদান অনস্বীকার্য। আমার পাঠকদের উদ্দেশ্যে শুধু এটুকু বলবো, আপনারা আমার প্রথম প্রকাশিত বইটি কিনুন, পড়ুন এবং আলোচনা-সমালোচনায় মুখর হোন। আপনাদের গঠনমূলক সমালোচনা আমাকে আরও অনেক দূর পর্যন্ত এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে। পাশাপাশি আপনারা সবসময় ভালো থাকুন, অপরকে ভালো রাখতেও সহায়তা করুন।

তন্ময় আলমগীর : ওমেন্স কর্ণারকে সময় দেয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।

মুহাম্মদ কামাল হোসেন : আপনাকেও ধন্যবাদ। ধন্যবাদ ওমেন্সকর্নারকে।

 

Leave a Comment