চন্দ্রাবতী - প্রথম বাঙালি মহিলা কবি

  • ওমেন্সকর্নার ডেস্ক 
  • মার্চ ১৯, ২০১৯

চন্দ্রাবতী (১৬শ শতক) মধ্যযুগের উল্লেখযোগ্য কবিদের মধ্যে অন্যতম এবং বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে প্রথম বাঙালি মহিলা কবি৷ এই বিদূষী নারী অন্যান্য কাব্য ছাড়াও পিতার আদেশে বাংলা ভাষায় রামায়ণ রচনা করেছিলেন। তার নিবাস ছিল বৃহত্তর ময়মনসিংহের কিশোরগঞ্জ জেলার অন্তর্গত পাঠবাড়ী বা পাতুয়ারী গ্রামে। তাঁর পিতা মনসা মঙ্গল কাব্যের অন্যতম রচয়িতা বংশীদাস ভট্টাচার্য এবং মাতার নাম সুলোচনা৷

চন্দ্রাবতীর রচিত কাব্যগুলি হলোঃমলুয়া, দস্যু কেনারামের পালা (মনসার ভাসান, রচনাকাল: ১৫৭৫ শকাব্দ), রামায়ণ। ড. দীনেশচন্দ্র সেন ১৯৩২ সালে চন্দ্রাবতীর রামায়ণ প্রকাশ করেন। লৌকিক মানবিক ও কিছু মৌলিক উপাদান সংযোগের ফলে এই রামায়ণ কাব্যটি বিশেষ মর্যাদা লাভ করেছে। দীনেশচন্দ্রের মতে, মাইকেল মধুসূদন দত্ত তাঁর মেঘনাদবধ কাব্যের সীতা-সরমার কথোপকথনের অংশটি 'চন্দ্রাবতীর রামায়ণ' থেকে গ্রহণ করেছিলেন।

মৈমনসিংহ গীতিকায় তাঁর নিজের রচিত 'মলুয়া' গীতিকাব্যে এবং তাঁর জীবনী অবলম্বনে পরবর্তী সময়কার কবি নয়ানচাঁদ ঘোষ রচিত 'চন্দ্রাবতী' পালায় তাঁর কথা পাওয়া যায়৷ তাঁর জীবনের ট্র্যাজেডি নিয়ে রচিত লোকগাঁথা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে অবিভক্ত ময়মনসিংহ জেলার মানুষের মুখে মুখে ফিরে এসেছে৷ তাঁর রচিত রামায়ণ কিছুকাল আগেও ময়মনসিংহ অঞ্চলের মেয়েরা বিয়ে উপলক্ষে গান করত। চন্দ্রাবতী নিজের কাব্য ছাড়াও পিতা বংশীদাসের মনসামঙ্গল কাব্যের অনেকাংশ রচনা করেছিলেন।

দীনেশচন্দ্র সেনের মতে কবি চন্দ্রাবতী ১৫৫০ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। মৈমনসিংহ-গীতিকার ‘জয়-চন্দ্রাবতী’ উপাখ্যানের নায়িকারূপে তিনি অমর হয়ে আছেন। ময়মনসিংহ অঞ্চলে ‘চন্দ্রাবতীর রামায়ণ’ নামে একটি গাথা প্রচলিত আছে। গাথানুযায়ী রূপসী চন্দ্রাবতী একই এলাকার ব্রাহ্মণ যুবক জয়চন্দ্রের প্রতি প্রণয়াসক্ত ছিলেন এবং পরিণত বয়সে দুপক্ষের অভিভাবকদের সম্মতিক্রমে বিয়েও স্থির হয়। কিন্তু কমলা নামের এক মুসলিম যুবতীর প্রেমে পড়ে প্রেমিক জয়চন্দ্র ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে।

পরে অবশ্য অনুতপ্ত জয়চন্দ্র চন্দ্রাবতীর নিকট ফিরে এলে করুনভাবে প্রত্যাখ্যাত হয়। তখন অভিমানী জয়চন্দ্র ফুলেশ্বরী নদীতে প্রাণ বিসর্জন দিলে বেদনাহত চন্দ্রাবতী শোক ভুলে থাকার অভিপ্রায়ে পিতার আদেশে রামায়ণকথা রচনায় প্রবৃত্ত হন। অবশ্য কাব্য রচনা সমাপ্ত হওয়ার পূর্বেই তাঁর প্রাণবিয়োগ ঘটে। ইতিহাসের স্মৃতি বিজড়িত পাতুয়ার/পাটোয়ারী গ্রাম আজও আছে৷ কিশোরগঞ্জ শহর থেকে উত্তর-পূর্ব্ব দিকে মাত্র কয়েক কিলোমিটার দূরে৷ আর আছে ফুলেশ্বরী নদীর ধারে শিব মন্দির, যেখানে চন্দ্রাবতী পূজা করতেন।

চন্দ্রাবতী অজস্র লোকগীতি রচনা করেন। নৌকার মাঝির কণ্ঠে, ব্রতে, বিয়েতে এবং প্রতিদিনের গার্হস্থ্য জীবনে আজও শোনা যায় চন্দ্রাবতীর গান। ষোল শতকের সামাজিক-আর্থনীতিক অবস্থার স্বরূপ প্রতিফলিত হয়েছে তাঁর রচনায়। চন্দ্রাবতীর স্মৃতি, রচনা, জীবন ও সাহিত্য আজও বহমান স্রোতোধারার মতো গবেষক ও পর্যটককে আকর্ষণ করে।

Leave a Comment