প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার -ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলকারী নারী

  • ওমেন্সকর্নার ডেস্ক 
  • মার্চ ১৯, ২০১৯

উনার ডাকনাম রাণী, ছদ্মনাম ফুলতার। প্রীতিলতা বাঙালী ছিলেন, যিনি ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম নারী মুক্তিযোদ্ধা ও প্রথম বিপ্লবী মহিলা শহীদ ব্যক্তিত্ব। প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার ১৯১১ সালের ৫ই মে চট্টগ্রামের ধলঘাট গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা ছিলেন মিউনিসিপ্যাল অফিসের হেড কেরানী জগদ্বন্ধু ওয়াদ্দেদার এবং মাতা প্রতিভাদেবী। তাঁদের ছয় সন্তানঃ মধুসূদন, প্রীতিলতা, কনকলতা, শান্তিলতা, আশালতা ও সন্তোষ।

তাঁদের পরিবারের আদি পদবী ছিল দাশগুপ্ত। পরিবারের কোন এক পূর্বপুরুষ নবাবী আমলে “ওয়াহেদেদার” উপাধি পেয়েছিলেন, এই ওয়াহেদেদার থেকে ওয়াদ্দেদার বা ওয়াদ্দার। ডাঃ খাস্তগীর উচ্চ বালিকা বিদ্যালয় ছিল প্রীতিলতার প্রথম শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। ১৯১৮ সালে তিনি এই স্কুলে প্রাথমিক শিক্ষা শুরু করেন। আই.এ. পড়ার জন্য তিনি ঢাকার ইডেন কলেজে ভর্তি হন। ১৯৩০ সালে আই.এ. পরীক্ষায় তিনি মেয়েদের মধ্যে প্রথম এবং সবার মধ্যে পঞ্চম স্থান লাভ করে। এই ফলাফলের জন্য তিনি মাসিক ২০ টাকার বৃত্তি পান এবং কলকাতার বেথুন কলেজ়ে বি এ পড়তে যান।

১৯৩২ সালে ডিসটিংশান নিয়ে তিনি বি.এ. পাশ করেন। কিন্তু, ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে সম্পৃক্ত থাকায় কৃতিত্বের সাথে স্নাতক পাস করলেও তিনি এবং তাঁর সঙ্গী বীণা দাসগুপ্তের পরীক্ষার ফল স্থগিত রাখা হয়। অবশেষে তাঁদেরকে ২২ মার্চ, ২০১২ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে মরণোত্তর স্নাতক ডিগ্রী প্রদান করা হয়।

ঢাকায় যখন প্রীতিলতা পড়তে যান তখন “শ্রীসংঘ” নামে একটি বিপ্লবী সংঘঠন ছিল। ঢাকায় শ্রীসংঘের “দীপালী সঙ্ঘ” নামে একটি মহিলা শাখা ছিল। লীলা নাগ (বিয়ের পর লীলা রায়) এর নেতৃত্বে এই সংগঠনটি নারীশিক্ষা প্রসারের জন্য কাজ করত। গোপনে তাঁরা মেয়েদের বিপ্লবী সংগঠনে অন্তর্ভুক্ত করার কাজ ও করত।[ ইডেন কলেজের শিক্ষক নীলিমাদির মাধ্যমে লীলা রায়ের সাথে প্রীতিলতার পরিচয় হয়েছিল। তাঁদের অনুপ্রেরণায় দীপালী সঙ্ঘে যোগ দিয়ে প্রীতিলতা লাঠিখেলা, ছোরাখেলা ইত্যাদি বিষয়ে প্রশিক্ষন গ্রহণ করেন। ১৯৩০ সালের ১৯ এপ্রিল আই এ পরীক্ষা দিয়ে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম ফিরে আসেন প্রীতিলতা। আগের দিন রাতেই চট্টগ্রামে বিপ্লবীদের দীর্ঘ পরিকল্পিত আক্রমণে ধ্বংস হয় অস্ত্রাগার, পুলিশ লাইন, টেলিফোন অফিস এবং রেললাইন। 

এটি “চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহ” নামে পরিচয় লাভ করে। চট্টগ্রামের মাটিতে বিপ্লবীদলের এই উত্থান সমগ্র বাংলার ছাত্রসমাজকে উদ্দীপ্ত করে। ১৯৩২ সালে কলকাতার বেথুন কলেজ হতে বিএ পাশ করার পর মাস্টারদা সূর্যসেনের সাথে দেখা করার প্রত্যয় নিয়ে তিনি বাড়িতে ফিরেন কিন্তু বাড়িতে এসে দেখেন তার পিতার চাকরি নাই। সংসারের অর্থকষ্ট মেটানোর জন্য তিনি শিক্ষকতাকে পেশা হিসাবে গ্রহণ করেন এবং অপর্ণাচরণ উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ে (তৎকালীন নন্দনকানন উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়) প্রধাণ শিক্ষকা পদে নিযুক্ত হন। ডাঃ খাস্তগীর বিদ্যালয়ের এক বছরের সিনিয়র কল্পনা দত্ত ছিলেন প্রীতিলতার ঘনিষ্ঠ বান্ধবী। সূর্যসেনের সাথে সাক্ষাতের আগ্রহের কথা তিনি কল্পনা দত্তকে বলেন। যেহেতু কল্পনা দত্ত প্রীতিলতার এক বছরের সিনিয়র সেহেতু প্রীতিলতা বিএ পাশ করার এক বছর আগে অর্থাৎ ১৯৩১ সালে কল্পনা দত্ত কলকাতার বেথুন কলেজ থেকে বদলী হয়ে চট্টগ্রাম কলেজে বিএসসি’তে ভর্তি হন। 

সেজন্য প্রীতিলতার আগেই কল্পনা দত্তের সাথে মাষ্টারদার দেখা হয়। ১৯৩১ সালে কল্পনা দত্ত সহ আরও বেশ কয়েকজন বিপ্লবীর সাথে যখন মাস্টারদা সূর্যসেনের গোপন সাক্ষাৎ হয় তখন মাস্টারদা সেই সাক্ষাতে কল্পনা দত্তের কাছে প্রীতিলতার খোঁজ খবর জানতে চেয়েছিলেন। অবশেষে ১৯৩২ সালের ১৩ জুন চট্টগ্রামের বিপ্লবীদের প্রধান কেন্দ্র ধলঘাটের ঘাঁটিতে মাস্টারদা সূর্যসেনের সাথে দেখা করতে যান প্রীতিলতা। বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় প্রীতিলতা তার মাকে সীতাকুন্ডে যাওয়ার কথা বলেন। যে বাড়িতে প্রীতিলতার সাথে মাস্টারদার সাক্ষাৎ হয় সে বাড়িতে নির্মল সেনও ছিলেন। সেই বাড়িতে সূর্যসেনের অবস্থানের কথা পটিয়া পুলিশ ক্যাম্প গোপনা সূত্রে জানতে পারে। এর আগে একই বছর মে মাসে ব্রিটিশ সরকার সূর্যসেন ও নির্মল সেনকে জীবিত কিংবা মৃত ধরিয়ে দিতে পারলে ১০ হাজার টাকা পুরস্কার ঘোষনা করে। পটিয়া পুলিশ ক্যাম্পের অফিসার-ইন-চার্জ ক্যাপ্টেন ক্যামেরন খবরটা জানার পর পুরষ্কার এবং পদোন্নতির আশায় ঐ বাড়িতে অভিযানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে এবং রাত প্রায় ৯টায় ধলঘাটের ঐ বাড়িতে উপস্থিত হন। 

পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে ব্যাপারটি নির্মল সেনকে জানিয়ে সূর্যসেন ও প্রীতিলতা বাড়ির পিছন দিয়ে পালিয়ে যেতে সক্ষম হলেও নির্মল সেন নিহত হন। ইতিমধ্যে ব্রিটিশ বিরোধী সংগ্রামে প্রীতিলতার সম্পৃক্ততার প্রমাণ পায় পুলিশ ও গোয়েন্দা বিভাগ। এদিকে পরিস্থিতি খুব খারাপ দেখে মাস্টারদা সূর্যসেন প্রীতিলতাকে আত্মগোপন করার নির্দেশ দেন। ৫ জুলাই ছাত্রী পড়ানোর কথা বলে প্রীতিলতা বাড়ি ত্যাগ করেন এবং বিপ্লবী মনিলাল দত্ত ও বীরেশ্বর রায়ের সাথে ঘোড়ার গাড়িতে চড়ে প্রীতিলতা আত্মগোপন করেন। সে দিনের পর প্রীতিলতার সাথে তাঁর বাবা-মা’র আর দেখা হয়নি। প্রীতিলতার বাবা অনেক খোঁজাখুজির পর ব্যর্থ হয়ে মেয়ের খোঁজে থানা-পুলিশের শরণাপন্ন হলে পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ তখন বুঝতে পারে যে প্রীতিলতা আত্মগোপন করেছেন। প্রীতিলতা তখন চট্টগ্রামের বেশ কিছু জায়গায় আত্মগোপন করে থাকেন। ১৯৩২ সালের ১৩ জুলাই কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রীতিলতার আত্মগোপনের খবর প্রকাশিত হয়। ব্রিটিশ সরকার তখন তার সন্ধানে ব্যস্ত সময় কাটায়। প্রীতিলতাকে ধরার জন্য বেঙ্গল পুলিশের সি আই ডি ছবিসহ নোটিশ প্রকাশ করে।

১৯৩২ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের নেতৃত্বে ইউরোপীয় ক্লাব আক্রমণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। ইউরোপীয় ক্লাব ছিল ব্রিটিশদের প্রমোদকেন্দ্র। সন্ধ্যা হতেই ইংরেজরা এই ক্লাবে এসে মদ খেয়ে নাচ, গান এবং আনন্দ উল্লাস করতো। তিন ভাগে বিভক্ত হয়ে আগ্নেয়াস্ত্র হাতে বিপ্লবীরা ক্লাব আক্রমণ শুরু করে। পূর্বদিকের গেট দিয়ে ওয়েবলি রিভলবার এবং বোমা নিয়ে আক্রমণের দায়িত্বে ছিলেন প্রীতিলতা, শান্তি চক্রবর্তী আর কালীকিংকর দে। প্রীতিলতা হুইসেল বাজিয়ে আক্রমণ শুরুর নির্দেশ দেবার পরেই ঘন ঘন গুলি আর বোমার আঘাতে পুরো ক্লাব কেঁপে কেঁপে উঠছিল। মিলিটারীরাও পাল্টা আক্রমণ করে। এতে একটি গুলি এসে প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের বা পাশে লাগে। বিপ্লবীদের একটি মূলমন্ত্র ছিলো – আহত হয়ে শত্রুর হাতে ধরা দেয়া যাবে না। পাহাড়তলী ইউরোপীয় ক্লাব আক্রমণ শেষে পূর্বসিদ্বান্ত অনুযায়ী প্রীতিলতা পটাসিয়াম সায়ানাইড মুখে পুরে দেন। প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের মরদেহ ময়না তদন্ত করে জানা যায় গুলির আঘাত তার মৃত্যুর জন্য যথেষ্ট ছিল না। তার মৃত্যু হয়েছে পটাসিয়াম সায়ানাইড এর বিষক্রিয়ায়।
 

Leave a Comment