নেফারতিতি

  • ওমেন্সকর্নার ডেস্ক:
  • মার্চ ২৫, ২০১৯

ইতিহাস নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করেন, অথচ মিশরের রানী নেফারতিতির নাম শোনেননি, এমন মানুষ খুব কমই পাওয়া যাবে। তার নামের অর্থ ছিলো সৌন্দর্যের আগমন। আর নামের সাথে যেন তার রুপের সত্যিকার অর্থেই মিল ছিলো। নেফারতিতি বিয়ে করেন ফারাও তৃতীয় আমেনহোটেপের সন্তান আখেনাতেনকে, যিনি পরবর্তী ফারাও হিসেবে রাজত্ব করেন চতুর্থ আমেনহোটেপ হিসেবে। তিনি ছিলেন মিসরের অষ্টাদশ রাজবংশের ফারাও। ধারণা করা হয় নেফারতিতি ও আখেনাতেনের মধ্যে ভালোবাসার কোনো কমতি ছিল না যা সাধারণত মিসরীয় ফারাওদের মধ্যে খুঁজে পাওয়া যায় না। নেফারতিতির জীবন সম্পর্কে খুব বেশি জানা যায়নি বলেই তিনি এত রহস্যের কারণ। তবে ধারণা করা হয়, তিনি রাজবংশের একজন ছিলেন। তিনি ঠিক কোথায় জন্মেছিলেন এখনো সে ব্যাপারে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। কারও কারও মতে, তিনি আখমিম শহরে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। আবার কেউ কেউ বলেন তিনি মিসরের বাইরে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তুতেনখামেন হলেন নেফারতিতির সৎ ছেলে। আর পৃথিবীর ইতিহাসে একমাত্র তার মমি বা সমাধিই অবিকৃত অবস্থায় আবিষ্কৃত হয়। আর এই মমির অভিশাপে অনেক মানুষের মৃত্যু হয় যেটি ইতিহাসে তুতেনখামেনের মমির অভিশাপ নামে বিখ্যাত।

স্বামী ফারাও আখেনআতেন এর পাশাপাশি তিনিও খ্রিষ্টপূর্ব ১৩০০ এর মাঝামাঝি সময়ে শাসন করছেন বলে ধারণা করা হয়। এই ক্ষমতা এর আগে কোন রাণীকে দেয়া হয়নি। ধারণা করা হয় আখেনআতেন এর মৃত্যুর পরে পরবর্তী ফারাও তুতেনখামেন এর আগ পর্যন্ত তিনি ফারাও হিসেবে শাসন করেন। মিশরের ইতিহাসে তিনি দ্বিতীয় নারী যিনি হাটসেপুত এর ফারাও হয়েছিলেন। কারনাকের মন্দিরের প্রবেশপথের পাশের দেওয়ালের পাথরের ধ্বংসাবশেষ থেকে প্রায় একশোর মত চিত্র পাওয়া গেছে। এইসব চিত্রে নেফারতিতিকে দেখা গেছে শাস্ত্রীয় আচার অনুষ্ঠানের মধ্যমণি হিসাবে। সাধারণত এইসব অনুষ্ঠানের ক্ষমতা ন্যস্ত থাকত ফারাওদের হাতে। সেইখান থেকেই ধারণা করা হয় যে নেফারতিতি দেবীর পর্যায়ে তাকে নিয়ে গিয়েছিলেন এমনকি তা ছিল ফারাওয়ের সমকক্ষ। একযুগের ও বেশী সময় ধরে নেফারতিতিই ছিলেন প্রাচীন মিশরের সবচেয়ে সুন্দরী আর ক্ষমতাশালী নারী। একটি খণ্ডিত পাথরের লিপি উদ্ধার হলে দেখা যায়, সেখানে নেফারতিতির নাম রয়েছে। যেখানে তার নামের পাশে উৎকীর্ণ রয়েছে “গ্রেট রয়্যাল ওয়াইফ” শব্দটি যা তার সামাজিক মর্যাদা প্রকাশ করছে।  

প্রাচীনকালে মিশরের ফারাওদের বহু স্ত্রী থাকত। কিন্তু রাণী উপাধি দেওয়া হত তাদেরকেই যারা কিনা যোগ্য ফারাও এর জন্য ছেলেসন্তান জন্ম দিতে পারতেন। নেফারতিতি ছয়টি কন্যাসন্তানের জন্ম দিলেও ইতিহাসে তার পুত্রসন্তানের কোন সঠিক হদিস পাওয়া যায়নি। তাদের মাঝে দুজন পরবর্তী রাণী হয়। বিভিন্ন হায়ারোগ্লিফিকে আখেনআতেন ও নেফারতিতিকে কন্যাসন্তানদের সাথে দেখা গিয়েছে। সেখানেও পুত্রসন্তানের কোন চিহ্ন পাওয়া যায়নি। তাকে তুতেনখামেনের মা মনে করা হলেও গবেষণার দেখা যায় তিনি আসলে তুতেনখামেনের বায়োলজিক্যাল মাতা নন। তিনি ছিলেন তার শাশুড়ি এবং সৎ মা। তবুও কেন তিনি রাণীর মর্যাদা পেলেন এই নিয়ে ইতিহাসবিদগণের মত বিস্তর মতপার্থক্য রয়েছে। তবে ধারণা করা হয় তার অসাধারণ রূপের সাথে অসামান্য রূপ, ক্ষুরধার বুদ্ধি এবং আখেনআতেনের প্রতি নিখাদ ভালোবাসা এবং অগাধ সমর্থন তাকে এইআসনে অধিষ্ঠিত করে।

নেফারতিতিকে নিয়ে ১৯১২ সালের আগে কেউই চিনতই না। ১৯১২ সালের ৬ ডিসেম্বর জার্মানির একটি খননকারী দল যার নেতৃত্বে ছিলেন Ludwig Borjardt এল-আমারনা”র ধ্বংসাবশেষ থেকে কাদামাটির তৈরি একটি রেলিক খুঁজে পায়, যাতে ছিল ৩২০০ বছরের পুরনো একটি নারীর প্রতিমূর্তি। গবেষণায় বেড়িয়ে আসে সেই প্রতিমূর্তিটিই হল রাণী নেফারতিতির। সেই রেলিকটি এখন বার্লিনের অল্টেস মিউজিয়ামে রাখা আছে। নেফারতিতিকে প্রাচীন মিশরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাণী হিসেবে ঐতিহাসিকরা গণ্য করেন। তাকে অসংখ্য নামে ও উপাধিতে অভিহিত করা হয়েছে তাকে Ruler of the Nile এবং Daughter of Gods হিসাবে ডাকা হয়। দীর্ঘ এবং হাসের মত গলার জন্য তিনি বিখ্যাত ছিলেন। তিনি গ্যালেনা উদ্ভিদ ব্যাবহার করে তার রূপসজ্জা করতেন। প্রাচীন মিসরীয় ইতিহাসে নেফারতিতিকে খুশি, আনন্দ বা ভালোবাসার প্রতীক হিসেবেও চিহ্নিত করা হয়েছে।

কিছু মানুষের কাছে নেফারতিতি ছিলেন ধর্মত্যাগী, বিশ্বাসঘাতক। আর কারো কাছে তিনি ছিলেন একজন জীবিত দেবী যিনি তার সর্বোচ্চ ত্যাগ করেছিলেন তার দেশের জন্য। তিনি ছিলেন একাধারে রহস্যের রাণী, যাদুর রাণী, ভালোবাসার রাণী কিংবা হিংসাপরায়ণতা এবং প্রতিশোধের রাণী। নেফারতিতি মোহনীয় রূপ ও বাচনভঙ্গি দিয়ে যে কাউকে বশ করতে পারতেন। হয়তো তার ওপর ভরসা করেই আখেনআতেন সবচেয়ে বড় এবং অসম্ভব বিপদসংকুল সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। রানী নেফারতিতির আমলে চিত্রকলায় নতুন ধারা শুরু হয়। রানী নেফারতিতি এবং তার কন্যাগণের যেসব ছবি এপর্যন্ত আবিষ্কৃত হয়েছে তার সাথে আগের যুগের চিত্রকলার ধারার সামঞ্জস্য পাওয়া যায় না।

কিন্তু হটাৎই আখেনআতেনের শাসনামলের ১৪ বছর পরেই তার মৃত্যু ঘটে। ধারণা করা হয় তখন নেফারতিতি ক্ষমতায় বসেন। তবে তার দালিলিক প্রমাণ পাওয়া যায়নি। সে সময় নেফারনেফারুআতেন নামে অন্য কারো সিংহাসনে বসারও আলামত পাওয়া যায়। নেফারতিতির তত্ত্বাবধানে আতেন দেবতার আখেনাতেন শহরের কাজ আরও জোরেশোরে শুরু হয়। এর মধ্যেই নেফারতিতির মৃত্যু হয় বলে ধারণা করা হয়। কিছু সূত্র আবার বলে অন্য কথা। আখেনাতেন এবং নেফারতিতির কোনও ছেলে ছিল না, ছিল ছয় মেয়ে। তাই নেফারতিতির মৃত্যুর পর পুরোহিতরা আখেনআতেনের অন্য রানীর আট বছর বয়সী ছোট ছেলে তুতেনখামেনকে মিসরের ফারাও নির্বাচন করেন। বালক তুতেনখামেনকে সিংহাসনে বসিয়ে, পুরোহিতরা সমগ্র মিসরকে আগের অবস্থায় নিয়ে যান।

অনেক বিশ্লেষকেরাই মনে করেন রোগে শোকে নেফারতিতির মৃত্যু হয়নি। বরং এসব চিন্তাকারীদের ধারনা, ফারাও আখেনাতেন এর মৃত্যুর পরে নেফারতিতি চেষ্টা করে থাকবেন রাজ্যকে ধরে রাখতে। তাই তিনি বিদেশী কাউকে বিয়ে করার প্রস্তাব পাঠিয়েছিলেন যা উৎকীর্ণ আছে একটি পাথরের শিলালিপিতে। শিলালিপিটি পাঠানো হয়েছিলো “হিতিস” সম্রাটের কাছে । শিলালিপিটিতে ফারাওয়ের মৃত্যু সংবাদ উল্লেখের পাশাপাশি একজন রাজপুত্রকে মিশরে পাঠানোর অনুরোধ ছিল। “হিতিস” হিতিস” সম্রাট কথামতো একজন যুবরাজকে পাঠিয়েও নাকি ছিলেন যিনি পথিমধ্যে আততায়ীর হাতে নিহত হন। উদ্ধারকৃত পাথর খণ্ডের এই লিপির লেখা কাহিনী বা “থিওরি” নেফারতিতির নামের সাথে যুক্ত করেছেন এ ধরনের গবেষকরা । তাদের ধারনা সত্যিকার নেফারতিতির মমি কোনোদিনই খুঁজে পাওয়া যাবেনা। সম্ভবত তার মরদেহকে মিশরের পুরোহিতরা এমন সমাধিতে সমাহিত করেছেন যা সহজে খুঁজে পাওয়া হবে দুষ্কর। তবে আশ্চর্যের বিষয় এই যে এখন পর্যন্ত এ ক্ষমতাশালী নারীর মৃতদেহ বা সমাধি নিয়ে রহস্যই থেকে গেছে। বিভিন্ন ইতিহাসবিদগণ এখনো এই নিয়ে গবেষণা করছেন।

দ্বিতীয় আমেনহোতেপ এর মন্দিরে যাকে KV35 বলে সেখানে ৩ টি মমি পাওয়া যায় যার মধ্যে দুটি ছিল নারীর এবং একটি ছিল অল্প বয়সী কোন ছেলের। একটি ছিল আখেনআতেন এর মা‌ তুতেনখামেন এর দাদী এবং আমেনহোতেপ ৩য় এর স্ত্রী রাণী তিয়ার । আর একটি ছিল তারই ছেলে, যে অকালে‌ মারা‌ গিয়েছিলো প্লেগ এ আক্রান্ত হয়ে। যদিও তার নাম‌‌ সঠিকভাবে জানা যায়নি ধারনা করা হয় তিনি আখেনআতেন এর ছোটভাই ছিলেন। ৩য় মমিটা‌ ছিল খুবই আশ্চর্যজনক। ডক্টর ফ্লেচার বলে একজন গবেষক ধারণা করেন মমিটা‌ ছিল রাণী নেফারতিতির। কারণ ডক্টর ফ্লেচার এমন এক সূত্র ধরে অনুসন্ধান চালান যা এর আগে কেও করেনি এবং তা হল “প্রাচীন মিশরীয় নারীদের চুল নিয়ে গবেষণা”।

প্রাচীন রানীরা বিভিন্ন পরচুলা এবং মুকুট পরিধান করতেন যা তাদের বিভিন্ন সময় বিভিন্ন উৎসব বা আয়োজনে বিভিন্ন ভাবে উপস্থাপিত করতো। এই‌ পরচুলা এবং মুকুট নিয়ে গবেষণা করে দেখতে পান যে এক ধরনের বিশেষ মুকুট বিশেষভাবে পরলে যে‌ অংশ দাগ পরার কথা সেটা আছে। এবং এই লক্ষ্যে‌ তিনি মমিটাকে নেফারতিতি‌ বলে ধারনা করে তা প্রমাণের জন্য চেষ্টা চালান যা সম্পূর্ণ নীতি বিরুদ্ধ। যদিও সেই সময় ডিএনএ পরীক্ষার ব্যবস্থা ছিল না। এই মমিটার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে সম্পূর্ণ মমিটা ক্ষত বিক্ষত ছিল। কে‌ বা কারা‌ যেন এর মুখমণ্ডলে আঘাতের পর আঘাত করে তার একপাশ ধসিয়ে দিয়েছে। তার বক্ষজোড়া যেন কারা‌কেটে নিয়ে গিয়েছিলো এবং সেই মমির শরীরে কোন ব্যান্ডেজ ছিলোনা।

২০১৫ সালের আগস্ট মাসে তুতেনখামেনের সমাধির দেয়ালের স্ক্যান করা ছবি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে যেয়ে ব্রিটিশ প্রত্নতত্ত্ববিদ নিকোলাস রিভস দেয়ালের গায়ে গোপন দরজার নকশা দেখতে পান। পরে আরও সূক্ষ্মভাবে স্ক্যান করে দেখা যায় উক্ত দেয়ালের পাশে ফাঁকা জায়গা রয়েছে যা কোন আলাদা কক্ষ হতে পারে। নিকোলাস রিভস মনে করেন, তুতেনখামেনের সমাধিস্থল সর্বপ্রথম রানী নেফারতিতি দখল করেন এবং সমাধির দেয়ালের অপর পাশেই নেফারতিতি সম্পূর্ণ অক্ষত অবস্থায় ঘুমিয়ে আছেন। হয়তো রহস্য অনুসন্ধানকারীরা একদিন নেফারতিতির মমি খুঁজে পাবে। তার আগ পর্যন্ত নেফারতিতির অন্তর্ধান এক রহস্যই হয়ে থাকবে। এই রহস্যের কারণেই হয়তো এত বছর পরেও আমরা তাকে মনে রেখেছি, রাখবো আরও বহু বছর।

টি/আ

Leave a Comment