আমেরিকা আবিষ্কারক কলম্বাস

  • কামরুন নাহার স্মৃতি
  • এপ্রিল ১৬, ২০১৯

কলম্বাসের বাড়ি ছিল ইটালীর জেনোয়ায়। অনুমান ১৪৪৬ সালের জন্ম হয়েছিল কলম্বাসের। সেই ছেলেবেলা থেকেই মনে মনে স্বপ্ন দেখতেন বড় হয়ে জাহাজ নিয়ে পাড়ি দেবেন ভারতবর্ষে। জাহাজ বোঝাই করে বয়ে নিয়ে আসবেন হীরা, মণি, মুক্তা-মাণিক্য।

কলম্বাস ছিলেন কঠোর পরিশ্রমী, অধ্যবসায়ী। কিন্তু অর্থ উপার্জনের ক্ষেত্রে ভাগ্য ছিল নিতান্তই প্রতিকূল। তাই অতিকষ্টে জীবন ধারণ করতেন কলম্বাস। অল্পদিনের মধ্যেই ছোটখাটো একটা কাজও জুটে গেল। কাজের অবসরে মাঝে মাঝে গির্জায় যেতেন। একদিন সেখানে পরিচয় হলো ফেলিপা মোয়িস দ্য পেরেস্ত্রল্লো নামে এক তরুণীর সাথে। ফেলিপার বাবা বার্তলোমিউ ছিলেন সম্রাট হেনরির নৌবাহিনীর এক উচ্চপদস্থ অফিসার।

কলম্বাসের জীবনে এই পরিচয় এক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। পরিচয় পর্ব অল্পদিনের অনুরাগে পরিণত হলো। তারপর বিবাহ। বিবাহের পর কলম্বাস শ্বশুরের গৃহেই থাকতেন। শ্বশুরের কাছে শুনতেন তার প্রথম যৌবনের সমুদ্র অভিযানের সব রোমাঞ্চকর কাহিনী। অন্য সময় লাইব্রেরি ঘরে বসে পড়তেন দেশ-বিদেশের নানা ভ্রমণ কাহিনী। এই সময়ে একদিন তার হাতে এলো মার্কো পোলোর চীন ভ্রমণের ইতিবৃত্ত। পড়তে পড়তে মনের মধ্যে প্রাচ্য দেশে যাওয়ার স্বপ্ন নতুন করে জেগে উঠল৷

কলম্বাসের অনুরোধে স্পেনের রানি ইসাবেলা সহৃদয় বিবেচনার আশ্বাস দিলেও সম্রাট ফার্দিনান্দ সরাসরি প্রত্যাখ্যান করলেন। ইতিমধ্যে কলম্বাসের স্ত্রী ফেলিপা অসুস্থ হয়ে পড়লেন। সমস্ত চিকিৎসা সত্ত্বেও অসুখ ক্রমশই গুরুতর হয়ে উঠল। দূরপ্রাচ্য অভিযানের পরিকল্পনা স্থগিত রাখতে হলো। কিছুদিন পর মারা গেলেন ফেলিপা।

কলম্বাসের জীবনের সমস্ত বন্ধন ছিন্ন হয়ে গেল। এবার নতুন উদ্যমে ঝাঁপিয়ে পড়লেন তার অভিযানে। দেশের প্রায় প্রতিটি ধনী সম্ভ্রান্ত মানুষের দরজায় দরজায় ঘুরে বেড়ান। জাহাজ চাই, নাবিক চাই, অর্থ চাই।

কলম্বাসের দাবি ছিল যে দেশ আবিষ্কার হবে তাকে সেই দেশের ভাইসরয় করতে হবে আর রাজস্বের একটা অংশ দিতে হবে। প্রাথমিকভাবে দু-একজন সম্মতি দিলেও কলম্বাসের দাবির কথা শুনে সকলেই তার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করল।

কলম্বাসের সাথে এই সময় একদিন পরিচয় হলো ফাদার পিরেজের। ফাদার পিরেজ ছিলেন রাজপরিবারের অন্তরঙ্গ বন্ধু এবং রানি ইসাবেলা তাকে অত্যন্ত সম্মান করতেন। কলম্বাসের ইচ্ছার কথা ফাদার নিজেই রানি ইসাবেলাকে বললেন। অনুরোধ করলেন যদি তাকে কোনোভাবে সাহায্য করা যায়। ফাদারের অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করতে পারলেন না রানি। নতুন দেশ আবিষ্কারের সাথে সাথে বহু মানুষকে খ্রিষ্টান ধর্মে দীক্ষিত করার পুণ্য অর্জন করা যাবে।

অবশেষে ৩ আগস্ট, ১৪৯২ কলম্বাস তার তিনটি জাহাজ নিয়ে পাড়ি দিলেন অজানা সমুদ্রে। সেদিন বন্দরে যারা উপস্থিত ছিলেন তাদের অধিকাংশই ভেবেছিলেন কেউই আর সেই অজানা দেশ থেকে ফিরে আসবে না। ভেসে চললেন কলম্বাস। চারদিকে শুধু পানি আর পানি। দিনের পর দিন অতিক্রান্ত হয়। কোথাও স্থলের দেখা নেই, অধৈর্য হয়ে ওঠে নাবিকরা। সকলকে সান্ত্বনা দেন, উৎসাহ দেন কলম্বাস কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর ধৈর্য রাখতে পারে না নাবিকরা। সকলে একসাথে বিদ্রোহ করে, জাহাজ ফিরিয়ে নিয়ে যেতে হবে।

কলম্বাসের চোখে পড়ে ভাঙা গাছের ডাল। সবুজ পাতা। অনুমান করতে অসুবিধা হয় না তারা স্থলের কাছাকাছি এসে পৌঁছেছেন। নাবিকদের কাছে শুধু একটি দিনের প্রার্থনা করেন। দিনটি ছিল ১২ অক্টোবর। একজন নাবিক, নাম রোডারিপো প্রথম দেখলেন স্থলের চিহ্ন। আনন্দে উল্লাসে মেতে উঠলেন সকলে৷

সম্রাটের সহযোগিতায় দ্বিতীয় অভিযানের উদ্দেশ্যে বেরুলেন কলম্বাস। দীর্ঘ সমুদ্রযাত্রার পর কলম্বাস গিয়ে পৌঁছলেন হিস্পানিওয়ালাতে। সেখানে গিয়ে দেখলেন তার সঙ্গী-সাথীদের একজনও আর জীবিত নেই। কিছু মানুষ অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের জন্য মারা গেছে। অবশিষ্ট সকলে স্থানীয় আদিবাসীদের হাতে মারা পড়েছে।

এই দ্বিতীয় অভিযানের সময় কলম্বাস চারদিকে ব্যাপক অনুসন্ধান করেও কোনো ধনসম্পদের সামান্য মাত্র চিহ্ন খুঁজে পেলেন না। শুধুমাত্র নতুন কিছু দ্বীপ আবিষ্কার করলেন। কোনো অর্থ সম্পদ না পেয়ে জাহাজ ভর্তি করে স্থানীয় আদিবাসীদের দাস হিসেবে বন্দি করে স্পেনে পাঠালেন। তখনো ইউরোপের বুকে দাস ব্যবসায়ের ব্যাপক প্রচলন ঘটেনি। কলম্বাসের এই কাজকে অনেকে আন্তরিকভাবে সমর্থন করতে পারল না। তাছাড়া আদিবাসীদের বিরাট অংশই নতুন পরিবেশে গিয়ে অল্পদিনের মধ্যে মারা পড়ল। ইসাবেলা কলম্বাসের এই আচরণকে অন্তর থেকে সমর্থন করতে পারলেন না।

এই সংবাদ কলম্বাসের কাছে পৌঁছতে বিলম্ব হলো না। তিনি আর মুহূর্ত মাত্র বিলম্ব করলেন না। আড়াই বছর পর ১৪৯৬ সালের ১১ জুন ফিরে এলেন স্পেনে। কিন্তু প্রথমবারের মতো এবারে কোনো সংবর্ধনা পেলেন না। কিন্তু অজেয় মনোবল কলম্বাসের। নতুন অভিযানের জন্য আবেদন জানালেন কলম্বাস। প্রথমে দ্বিধাগ্রস্ত থাকলেও শেষ পর্যন্ত সম্মতি দিলেন সম্রাট।

১৪৯৮, ৩০ মে তৃতীয়বারের জন্য অভিযান শুরু করলেন কলম্বাস। এবার তার সঙ্গী হলো তার পুত্র এবং ভাই। কলম্বাসের জীবনের সৌভাগ্যের দিন ক্রমশই অস্তমিত হয়ে এসেছিল। হিস্পানিওয়ালার স্থানীয় মানুষরা ইউরোপিয়ানদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করল। মানসিক দিক থেকে বিপর্যস্ত কলম্বাস অত্যাচারী শাসকের মতো কঠোর হাতে বিদ্রোহ দমন করলেন। শত শত মানুষকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হলো।

কলম্বাসের সহযোগীরাও তার কাজে ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিল। সম্রাটের কাছে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠল, তিনি স্বাধীন রাজ্য গড়ে তোলার চেষ্টা করছেন। তিনি ফ্রান্সিসকো দ্যা বোবদিলা নামে একজন রাজকর্মচারীকে সৈন্যসামান্ত দিয়ে পাঠালেন কলম্বাসের বিরুদ্ধে তদন্ত করার জন্য। কয়েক দিন ধরে অনুসন্ধান করে রাজ্য স্থাপনের কোনো অভিযোগ না পেলেও কলম্বাসের বিরুদ্ধে নির্বুদ্ধিতার অভিযোগ আনা হলো। কারণ কলম্বাস কোনো সম্পদশালী দেশ আবিষ্কার করার পরিবর্তে সম্পদহীন দেশ আবিষ্কার করেছেন। যার জন্য সম্রাটের বিরাট পরিমাণ অর্থের অপচয় হয়েছে।

এই অভিযোগে প্রথমে বন্দি করা হলো কলম্বাসের ভাই ও পুত্রকে। তারপর কলম্বাসকে। কলম্বাসকে শৃঙ্খলিত করে নিয়ে আসা হলো স্পেনে। তাকে রাখা হলো নির্জন কারাগারে। সেখান থেকেই রানি ইসাবেলাকে চিঠি লিখলেন কলম্বাস।

রানি ইসাবেলা ছিলেন দয়ালু প্রকৃতির। তাছাড়া কলম্বাসের প্রতি বরাবরই ছিল তার সহানুভূতিবোধ। তার চিঠি পড়ে তিনি মার্জনার আদেশ দিলেন। পঞ্চাশ বছরে পা দিলেন তিনি। শরীরে তেমন জোর নেই কিন্তু মনের অদম্য সাহসে ভর দিয়ে চতুর্থ বারের জন্য সমুদ্রযাত্রার আবেদন করলেন। সম্রাট সম্মতি দিলেন, শুধু হিস্পানিওয়ালাতে প্রবেশের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলেন।

১৫০২ সালের ১৯ মে কলম্বাস শুরু করলেন তার চতুর্থ সমুদ্রযাত্রা। তার ইচ্ছা ছিল আরো পশ্চিমে যাবেন। পথে তুমুল ঝড় উঠল। নিরুপায় কলম্বাস আশ্রয় নিলেন এক অজানা দ্বীপে। কলম্বাস পৌঁছেছিলেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের এক দ্বীপে। সেখান থেকে ফিরে যান জ্যামাইকা দ্বীপে। ক্রমশই তার দেহ ভেঙে পড়ছিল। অজানা রোগে তার সঙ্গীদের অনেকেই মারা গিয়েছিল। দু বছর পর নিরুৎসাহিত মনে স্পেনে ফিরে এলেন।

এরপর আর মাত্র দু বছর বেঁচে ছিলেন। যদিও অর্থ ছিল কিন্তু মনের শান্তি ছিল না। রাজ অনুগ্রহ থেকে সম্পূর্ণ বঞ্চিত হয়েছিলেন। তার আবিষ্কারের গুরুত্ব উপলব্ধি করার ক্ষমতা দেশবাসীর ছিল না।

১৫০৬ সালে ভ্যাসাডোলিড শহরে এক সাধারণ কুটিরে সকলের অগোচরে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন কলম্বাস। সেখান থেকে তার মৃতদেহ নিয়ে গিয়ে ডেমিঙ্গোতে সমাধি দেয়া হয়।

টি/শা

Leave a Comment