চিরসুন্দরের কবি জন কিটস

  • কামরুন নাহার স্মৃতি:
  • মে ১১, ২০১৯

প্রায় দুইশ বছর আগের কথা। লন্ডন শহরের প্রাণকেন্দ্রে ছিল একটি আস্তাবল। এমনি একটি আস্তাবলের পরিচালক ছিলেন টমাস কিটস। বিবাহের এক বছর পর ১৭৯৫ সালের অক্টোবর মাসে টমাসের প্রথম সন্তানের জন্ম হলো। যথাসময়ে শিশুর নামকরণ করা হলো জন কিটস। কিটসের জন্মের কয়েক বছরের মধ্যেই জন্ম হলো তার দুই ভাই জর্জ আর টমের। তিন ভাইয়ের মধ্যে কিটস ছিলেন সবচেয়ে সুন্দর। সাত বছর বয়সে তাকে এনফিল্ডের স্কুলে ভর্তি করে দেয়া হলো। কিটসের তখন নয় বছর বয়স। জীবনে প্রথম আঘাতের মুখোমুখি হলেন। ঘোড়া থেকে পড়ে মারা গেলেন টমাস কিটস।

স্বামীর মৃত্যুর পর কিটসের মা রলিগুস নামে একজনকে বিয়ে করলেন। কিন্তু অল্পদিনেই দুজনের সম্পর্কে ফাটল ধরল। এক বছরের মধ্যেই বিবাহবিচ্ছেদ হয়ে গেল। ছেলেমেয়েদের নিয়ে বাপের বাড়ি এলেন কিটসের মা। কিটস তখন দশ বছরের ছেলে। ১৮১০ সালে মারা গেলেন কিটসের মা। মরার আগে নিজের অজান্তেই রাজরোগ যক্ষ্মার বীজ দিয়ে গেলেন সন্তানকে। মায়ের মৃত্যুর পর পিতৃ-মাতৃহীন ছেলেমেয়েদের দায়িত্ব নিলেন মিস্টার অ্যাবি। স্কুলে ফিরে এলেন কিটস। দিন-রাত পড়াশোনা নিয়ে থাকেন। মাঝে মাঝে মনের খেয়ালে কবিতা লেখেন।

১৫ বছর বয়সে স্কুলের পড়া শেষ হলো। কিটসের অভিভাবকের ইচ্ছা কিটস ডাক্তারি পড়বেন। ডাক্তারি পড়ার জন্য ভর্তি হলেন মেডিকেল কলেজে। কিন্তু যার মনের মধ্যে জেগে উঠেছে কবিতার নেশা, হাসপাতালের ছুরি কাঁচি ওষুধ রোগী তার ভালো লাগবে কেন। সৌভাগ্য সেই সময় তার স্কুলের বন্ধু কাউডেন ক্লার্ক কিটসকে নিয়ে গেলেন সেই সময়ের খ্যতিমান তরুণ কবি লে হান্টের কাছে। হান্টের সাথে পরিচয় কিটসের জীবনে এক উল্লেখযোগ্য ঘটনা। হান্ট কিটসের কবিতা পড়ে মুগ্ধ হলেন, তাকে আরো কবিতা লেখার জন্য উৎসাহিত করলেন। হান্ট একটি পত্রিকা প্রকাশ করতেন। সেই পত্রিকাতেই কিটসের প্রথম কবিতা প্রকাশিত হলো। এখানে কিটসের পরিচয় হলো শেলির সাথে। আর ডাক্তারির মোহে নিজেকে বেঁধে রাখতে পারলেন না। অভিভাবকের উপদেশ অগ্রাহ্য করে মেডিকেল কলেজ ছেড়ে দিয়ে স্থির করলেন সাহিত্যকেই জীবনের পেশা হিসেবে গ্রহণ করবেন।

কিটস তার দুই ভাইকে নিয়ে লন্ডন ত্যাগ করে এলেন হ্যাম্পস্টেডে। এখানে আসার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল হান্টের সঙ্গ পাওয়া। অল্পদিনের মধ্যে কিটস প্রকাশ করলেন তার প্রথম কবিতা সংকলন। সকলের মনে আশা ছিল এই বই নিশ্চয়ই জনপ্রিয় হবে। কিন্তু দুর্ভাগ্য কিটসের, পরিচিত কিছু লোকজন ছাড়া এই বইয়ের একটি কপিও বিক্রি হলো না। প্রথম কাব্য সংকলনের ব্যর্থতায় সাময়িক আশাহত হলেন কিটস। কিন্তু অল্পদিনেই নতুন উৎসাহে শুরু করলেন কাব্য সাধনা। লেখা হলো প্রথম দীর্ঘ কবিতা এন্ডিমিয়ন। এ এক অসাধারণ কবিতা। এই কবিতার প্রথম লাইনের মধ্যেই কিটসের জীবন দর্শন ফুটে উঠেছে।

একদিকে যখন পত্রিকার সমালোচনায় ভেঙে পড়েছেন কিটস, সেই সময় এল আরেক আঘাত। ১৮১৮ সালের ১ ডিসেম্বর মারা গেল টম। এই সময় কিটসের জীবনে এল ফ্যানি ব্রন, সুন্দরী প্রাণোচ্ছল তরুণী। ফ্যানি তার মায়ের সাথে ব্রাউনের বাড়ির ভাড়াটিয়া হয়ে এসেছিল। কয়েক দিনের পরিচয়ে ভালো লেগে গেল দুজনের। কিটস ফ্যানিকে বিবাহ করতে চাইলেন। ফ্যানি সম্মত হলেও সংসার অভিজ্ঞ মিসেস ব্রন তৎক্ষণাৎ কোনো সম্মতি দিলেন না। বললেন, আগে কিটস স্বাবলম্বী হয়ে উঠুক তারপর বিয়ে হবে। কিটস স্থির করলেন যেমন করেই হোক তাকে অর্থ উপার্জন করতেই হবে। স্বাস্থ্য আগের মতো ভালো যাচ্ছিল না। কিন্তু মনের অদম্য শক্তিতে কিটস লিখে চললেন একের পর এক কবিতা। প্রকৃতপক্ষে কিটসের জীবনের সমস্ত শ্রেষ্ঠ কবিতাই এই সময়ে লেখা। আর্থিক অবস্থাও ভালো যাচ্ছিল না কিটসের। কিটসের শরীর যতই ভেঙে পড়ছিল ততই ফ্যানি তার কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছিল। তার সাজগোজ হাসি, অন্য ছেলেদের সাথে মেলামেশা কিটস সহ্য করতে পারতেন না। তার সমস্ত অন্তর ক্ষতবিক্ষত হয়ে যেত।

তিনি ফিরে এলেন লন্ডনে। একদিন বাইরে বেড়াতে বেরোলেন কিটস। বাড়িতে ফিরে কাঁপুনি দিয়ে জ্বর এল, সেই সাথে কাশি। এক ঝলক রক্ত উঠে এল মুখ দিয়ে। কিটস বললেন, একটি মোমবাতি নিয়ে এস। ব্রাউন মোমবাতি নিয়ে আসতেই কিটস কিছুক্ষণ রক্তের দিকে চেয়ে বললেন, এই রক্তের রং আমি চিনি, এ রক্ত উঠে এসেছে ধমনী থেকে। এই রক্ত আমার মৃত্যুর সমন। ডাক্তার এল। সে যুগে যক্ষ্মার কোনো চিকিৎসা ছিল না। প্রচলিত বিশ্বাস অনুসারে শিরা কেটে কিছুটা রক্ত বের করে দেয়া হলো। কিন্তু তাতে কোনো সুফল দেখা গেল না। তখন তার বয়স মাত্র পঁচিশ। গলার স্বর ভেঙে গিয়েছিল, মাঝে মাঝেই জ্বর হতো, গলা দিয়ে রক্ত উঠে আসত, এই সময় তার সৃষ্টির উৎসও ফুরিয়ে আসছিল। এই সময় প্রকাশিত হলো কিটসের তৃতীয় ও শেষ কাব্য সংকলন। এই কবিতাগুচ্ছ কিটসকে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ কবিদের পাশে স্থান দিয়েছে। এই সংকলনে একদিকে ছিল কিছু বড় কবিতা, অন্যদিকে ছোট কিছু কবিতা, সনেট। ছোট কবিতাগুলোর মধ্যে আছে

ode to a Nightingale. Ode on a Grecian urn. Ode on Melancholy, Ode to Autumn.

কবিতা ছাড়া কিটস কোনো গদ্য লেখার চেষ্টা করেননি। তার কাব্যজীবন ছিল মাত্র ছয় বছর অর্থাৎ উনিশ থেকে চব্বিশ বছর বয়স। ১৯২০ সাল। কিটসের দেহ ক্রমশই ভেঙে পড়ছিল। তাকে নিয়ে আসা হলো ফ্যানিদের বাড়িতে। ইতালিতে যাওয়ার আগে এক মাস তিনি ফ্যানির নিবিড় সান্নিধ্য পেয়েছিলেন। ১৮২০ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর কিটস রওনা হলেন ইতালির দিকে। দীর্ঘ সমুদ্র পথ পার হতে ছয় সপ্তাহ লাগল। জাহাজে যেতে যেতে কিটস মুক্ত আকাশের দিকে চেয়ে থাকতেন। ধ্রুবতারাকে নিয়ে লিখলেন একটি কবিতা, এটিই কিটসের জীবনের শেষ কবিতা। ২১ অক্টোবর জাহাজ এসে ভিড়ল ইতালির নেপলস বন্দরে। অচেনা-অজানা ইতালিতে কোথায় থাকবেন কিছুই স্থির করতে পারেননি কিটস। এমন সময় বন্ধু শেলির চিঠি পেলেন। শেলি তখন ছিলেন পিসায়। কিন্তু বন্ধুর এই বিপদের দিনে সব কিছু ভুলে তাকে আমন্ত্রণ করলেন, তুমি পিসায় চলে এস। আমি তোমাকে সুস্থ করে তুলব।

ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও কিটসকে যেতে হলো রোমে। কারণ সেই সময় ক্ষয়রোগের সবচেয়ে বড় চিকিৎসক ডাক্তার ক্লার্ক থাকতেন রোমে। রোমে ঘর ভাড়া নেয়া হলো। শুরু হলো কিটসের চিকিৎসা। কিন্তু কোনো উপকার পাওয়া গেল না। ক্রমাগত শরীর ভেঙে পড়ছিল। কাশির সাথে রক্তবমি হতে আরম্ভ করল। ২৩ ফেব্রুয়ারি শুক্রবার ১৯২১ সাল। সমস্ত দিন কেমন আচ্ছন্ন ছিলেন কিটস। রাত তখন প্রায় এগারোটা, মাথার পাশে বসে ছিল বন্ধু সেভার্ন। আস্তে আস্তে কিটস বললেন, ‘আমাকে তুলে ধর, আমার মৃত্যু এগিয়ে এসেছে। আমি শান্তিতে মরতে চাই, তুমি ভয় পেয়ো না-ঈশ্বরকে ধন্যবাদ, অবশেষে মৃত্যু এল।’ সেভার্নের কোলেই চিরদিনের জন্য ঘুমিয়ে পড়লেন চিরসুন্দরের কবি কিটস। পরদিন রোমের এক সমাধিক্ষেত্রে তাকে সমাধি দেয়া হলো। দুই বছর পরে এই সমাধিক্ষেত্রেই সমাধি দেয়া হয় আরেক তরুণ কবি শেলিকে।

টি/আ

 

Leave a Comment