জিহাদে এক নির্ভীক নারী

  • কামরুন নাহার স্মৃতি:
  • মে ১১, ২০১৯

নারী জাতির ধৈর্য ও ধর্ম বিশ্বাসে অটুট মনোভাব বাস্তবিকই এক অনন্য সাধারণ ব্যাপার। অন্তরে একবার যখন আল্লাহ পাকের প্রেম ও মহব্বতের আগুন জ্বলে উঠে তখন সবপ্রকার দুঃখ যাতনা সহজ হয়ে যায়। হাজারো ঘটনা পাওয়া যায় যারা ইসলামের জন্য অকাতরে প্রাণ বিসর্জন দিতে কুন্ঠিত হননি। ইসলামের খাতিরে যে সকল মহাপ্রাণ পুরুষ ও নারী অপরিসীম দুঃখ যাতনা ভোগ করেছেন হযরত সুমাইয়া বিনতে খুব্বাত (রাযিঃ) তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন। তাঁর পুত্র হয়রত আম্মার (রাযিঃ) এবং স্বামী হয়রত ইয়াসীর ইবনে আমির (রাযিঃ) - ঐ একই পথের যাত্রী ছিলেন।

সাহাবী হযরত সুমাইয়া বিনতে খুব্বাত (রাযিঃ) -'র এই পৃথিবীতে জন্ম হয়েছিল একজন দাসী হিসেবে। নরাধম আবু জাহেলের চাচা আবু হুজায়ফা ইবনে আল মুগীরার গৃহে হযরত সুমাইয়া বিনতে খুব্বাত (রাযিঃ) -'র জন্ম হয়। হয়রত সুমাইয়া বিনতে খুব্বাত (রাযিঃ) -'র স্বামী ছিলেন হযরত ইয়াসীর ইবনে আমির (রাযিঃ)। ইয়েমেন থেকে হযরত ইয়াসীর ইবনে আমির (রাযিঃ) একজন দাস হিসেবে আবু হুজায়ফা ইবনে আল মুগীরার গৃহে নীত হন। পরবর্তীতে ইসলামের পূর্ব যুগেই আবু হুজায়ফা ইবনে আল মুগীরা উনার দাসী হয়রত সুমাইয়া বিনতে খুব্বাত (রাযিঃ) ও দাস হযরত ইয়াসীর ইবনে আমির (রাযিঃ) -'র সাথে বিয়ে দেন। হযরত সুমাইয়া বিনতে খুব্বাত (রাযিঃ) ও হযরত ইয়াসীর ইবনে আমির (রাযিঃ) সংসার জীবন শুরু করেন স্বাধীন মানব মানবী রূপেই। স্বাধীনভাবে দাম্পত্যজীবন শুরু করলেও তাঁরা ছিলেন প্রভাবশালী গোত্রের অধিনস্থ। আরব সমাজের রীতি অনুযায়ী, দাস দাসী স্বাধীন হলেও আরবের একজন প্রভাবশালী গোত্রপতির অধিনেই আরব সমাজে বসবাস করতে হবে এবং সেই প্রভাবশালী গোত্রপতি সবরকম প্রভাব বিস্তার করতে পারবে। আরব সমাজের রীতি অনুযায়ী আবু হুজায়ফা ইবনে আল মুগীরা আবু জাহেলের আপন চাচা ছিল তাই আবু হুজায়ফা ইবনে আল মুগীরার মৃত্যুর পর আবু জাহেলের অধিনতা মেনেই হযরত সুমাইয়া বিনতে খুব্বাত (রাযিঃ) ও হযরত ইয়াসীর ইবনে আমির (রাযিঃ) স্বাধীন দম্পতিরূপে মক্কায় বসবাস করেন।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দ্বীন ইসলাম প্রচার করার সাথে সাথে হযরত সুমাইয়া বিনতে খুব্বাত (রাযিঃ) ও হযরত ইয়াসীর ইবনে আমির (রাযিঃ) মুসলমান হয়ে যান। ইসলাম গ্রহণ করার পর হযরত সুমাইয়া বিনতে খুব্বাত (রাযিঃ) এর উপর নরাধম আবু জাহেল অকথ্য অত্যাচার শুরু করে। নরাধম আবু জাহেল হযরত সুমাইয়া বিনতে খুব্বাত (রাযিঃ) ও হযরত ইয়াসীর ইবনে আমির (রাযিঃ) কে মক্কার আল বাতহা উপত্যকার মরুভূমির তপ্ত বালুর মাঝে লোহার পোষাক পড়িয়ে ফেলে রাখত। অকথ্য অত্যাচারেও নত হয়নি ইসলামের জন্য বিলিয়ে দেয়া সেই মানুষগুলোর মাথা, দেহের লাল রক্তধারায় হাসি ফুটেছে পাপিদের মুখে। চালিয়েছে ওরা অকথ্য নির্যাতনের পালা, দ্বীন ইসলামে অকুতোভয় আর অকাতরে প্রাণ বিসর্জন দিয়ে অর্জন করেছে শহীদের মালা। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁদের জানিয়েছেন জান্নাতের সুসংবাদ।

 যেহেতু হযরত সুমাইয়া বিনতে খুব্বাত (রাযিঃ) আবু জাহেলের অধীনস্থ ছিলেন এবং অন্য কোন প্রভাবশালী গোত্রপতি তাঁদের ছিলনা তাই এমন অকথ্য অত্যাচার সহ্য করা ছাড়া আর কিছুই করার ছিলনা। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একবার হযরত সুমাইয়া বিনতে খুব্বাত (রাযিঃ) এর পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় তাঁকে উপত্যকার তপ্ত বালুতে লোহার পোষাকে পড়ে থাকতে দেখে হযরত সুমাইয়া বিনতে খুব্বাত (রাযিঃ) কে জান্নাতের সুসংবাদ দেন। তখন হযরত সুমাইয়া বিনতে খুব্বাত (রাযিঃ) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলেন - " ইয়া রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! আমি জান্নাতের সুগন্ধ এই তপ্ত মরুভূমির বুকে শুয়েই পাচ্ছি।"

দীর্ঘদিন অত্যাচার নির্যাতন করার পরও হযরত সুমাইয়া বিনতে খুব্বাত (রাযিঃ) দ্বীন ইসলাম ত্যাগ করেননি। এমন অটল মনোবল আর অসীম ধৈর্য্যের অধিকারী ছিলেন তিনি। একদিন হযরত সুমাইয়া বিনতে খুব্বাত (রাযিঃ) দাঁড়ান অবস্থায় ছিলেন। এমতাবস্থায় দুষ্ট দুরাচার আবু জাহেল কোথা থেকে এসে তাঁকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ শুরু করে এবং অতিমাত্রায় রাগান্বিত হয়ে হযরত সুমাইয়া বিনতে খুব্বাত (রাযিঃ) এর লজ্জাস্থানে বর্শা নিক্ষেপ করে। হযরত সুমাইয়া বিনতে খুব্বাত (রাযিঃ) শাহাদত বরণ করেন। নরাধম, পাপী আবু জাহেল হযরত সুমাইয়া বিনতে খুব্বাত (রাযিঃ) এর স্বামী হযরত ইয়াসীর ইবনে আমির (রাযিঃ) কে তীরবিদ্ধ করে এবং তিনি শহীদ হন।

হযরত সুমাইয়া বিনতে খুব্বাত (রাযিঃ) যখন শহীদ হন  তখন মুসলমানদের ছিল অসহায় অবস্থা। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সামনে হযরত সুমাইয়া বিনতে খুব্বাত (রাযিঃ) কে লোহার বর্ম পড়িয়ে উপত্যকার তপ্ত মরুভূমিতে ফেলে রাখা হত কিন্তু মক্কার সেই রূঢ় পরিবেশেও হযরত সুমাইয়া বিনতে খুব্বাত (রাযিঃ) দ্বীন ইসলাম থেকে একচুলও সরেননি। অথচ আজকের দিনে আমরা মুসলমানের ঘরে জন্ম নিয়েও দ্বীন ইসলাম সম্পর্কে গাফেল কিন্তু সাহাবীরা হাজার অত্যাচার সহ্য করেও ইসলাম থেকে একচুলও সরে দাঁড়াননি। ইসলাম নারীকে দিয়েছে সম্মান, করেছে সম্মানিত। অন্ধকার যুগে যেই মেয়েদের মাটিতে পুতে ফেলা হতো সেখানে আল্লাহর প্রিয় নবী রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নারীকে বিশেষায়িত করেছেন সম্মানে। তবুও আমরা আজকাল ইসলাম থেকে গাফেল। আমাদের উচিত নবী-সাহাবীদের জীবনী বেশি বেশি পড়া এবং ইসলামের কাজে নিজেকে আরো থেকে আরো সংস্পর্শে রাখা।

Leave a Comment