ইসলামে উজ্জ্বল নাম মহাকবি হাফিজ

  • কামরুন নাহার স্মৃতি:
  • মে ১১, ২০১৯

বাহাউদ্দিন সিরাজ ইরানের সিরাজনগরীর অধিবাসী। তিনি একজন ব্যবসায়ী। তার ঘরে জন্মগ্রহণ করে এক ফুটফুটে ছেলে। চেহারা যেন সূর্যের আলোর মত উজ্জ্বল। দেখলে চোখ ফেরানো যায় না। পিতা আদর করে নাম রাখলেন শামসুদ্দীন। অর্থাৎ দ্বীনের সূর্য্য। তাদের পরিবারটি ধর্মকর্মে নিষ্ঠাবান। ইসলারেম যাবতীয় হুকুম আহকাম সঠিকভাবে মেনে চলেন। একারণে পিতার মনের ইচ্ছা এই ছেলে শুধুমাত্র চেহারা সুরতে সুন্দর হলেই চলবৈ না, বরং তাকে হতে হবে একজন সত্যিকার জ্ঞানী লোক। যিনি আল্লাহকে চিনতে পারবেন আর নেক আমলের দ্বারা দ্বীন ও দুনিয়ার কল্যাণ ও মঙ্গল করবেন। শামসুদ্দিনের পরিবারের সকলেই নামাজ রোজা ও অন্যান্য এবাদত বন্দেগীতে পাকা ছিলেন। তিনি এই পরিবেশেই বড় হতে থাকেন। ছোট বেলাতে তাকে কুরআন পড়তে পাঠানো হয়। তিনি অল্প দিনেই তা মুখস্থ করে ফেলেন। এ কারণে তাকে সকলে হাফিজ বলে ডাকতো।

শামসুদ্দিনকে শিক্ষালাভের জন্য বিদ্যালয় ভর্তি করা হয়। তিনি কম সময়ের মধ্যে আরবী ও ফারসী বাষায় গভীর জ্ঞঅন অর্জন করেন। ছোট বেলা থেকেই তিনি ছিলেন খুবেই বুদ্ধিমান ও মেধাবী। হঠাৎ করে তাদের পরিবারের আর্থিক অবস্থা খারাপ হয়ে যায়। ফলে তাকে লেখাপড়া বন্ধ করে দিতে হয়। দারিদ্রের কারণে তার পক্ষে উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ সম্ভব হল না। বাধ্য হয়ে তাকে অর্থ উপার্জনের দিকে মনযোগ দিতে হল। তিনি সিরাজনগরে একটি নব প্রতিষ্ঠিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষাদান শুরু করেন। দীর্ঘদিন এখানে তিনি শিক্ষকতা করেন। এসময় তিনি গজল ও কবিতা রচনা করতেন। একবার তিনি ‘বাবা কোহী’ নামের এক বিখ্যাত দরবেশের মাজারে যান। সেখানে তিনি নীরবে আল্লাহপাকের কাছে নিজের দুরবস্থা ও দুঃখের কথা প্রকাশ করলেন। এ সময় তার চোখ থেকে অশ্রু বের হতে লাগল। তিনি পরদিন রাতে স্বপ্ন দেখলেন, একজন দরবেশ যেন তাকে কিছু খেতে দিলেন। তিনি তা’ খেলেন। এরপর দরবেশ তাকে বললেন, যাও এখন হতে সব দরজাই তোমার জন্র খোলা। পরদিন সকালেই তিনি অবিশ্বাস্য একটি সুন্দর গজল রচনা  করলেন। চারদিকে তার গজলের প্রশংসা শুরু হল। এরপর তিনি জনগণের কাছে কবি হিসেবে খ্যাতি লাভ করেন। সারা ইরানে তার সুখ্যাতি ও সুনাম ছড়িয়ে পড়ে।

তাঁর আসল নাম শামসুদ্দিনের কথা লোকে ভুলে গেল। সকলেই তাকে হাফিজ বলেই চেনে। তিনি সহজ সরল জীবন যাপন পছন্দ করতেন। রাজকীয আড়ম্বর মোটেই পছন্দ হত না। এজন্য রাজাবাদশাহদের কাছ থেকে দূরে থাকতেন। একবার বাগদাদের খলিফা সুলতান আহমদ তাকে রাজ দরবারে ডেকে পাঠালেন। কিন্তু তিনি কবিকে পেলেন না। এতে ক্ষুব্ধ হলেও তিনি অবিবেচক ছিলেন না। তাই উপহার সামগ্রী হাফিজের বাড়ীতে পাঠিয়ে দিলেন। কবি হাফিজের কবিতায় রয়েছে জ্ঞানের অতুলনীয় রত্নভান্ডার। বিশ্ব প্রকৃতি ও মানব জীবনের গভীর রহস্য তার কবিতার প্রতিটি বাক্যে ফুটে ওঠেছে। েএর মধ্যে দেওয়ান-ই হাফিজ’ দুনিয়া জোড়া সাড়া জাগানো এক পুস্তক। হাফিজ মূলতঃ গীতি কবিতা লিখতেন। এর মধ্যে কোনটা সনেট জাতীয় আবার কোনটা গজল। দেওয়ান-ই হাফিজ’ এর কবিতা ও গজল গুলো যেন প্রেমের এক অমর কাব্য। কবি তার জীবন কালে তার লেখাগুলো একত্রিত করে যাননি। জনপ্রিয় গজল হিসেবে সেগুলো মানুষের মুখে মুখে শোনা যেত। তার বন্ধু গুল আন্দাম সেগুলো সংগ্রহ ও সংকলন করেন। এর সংখ্যা পাঁচ শতাধিক।

কবি হাফিজ যখন যুবক। তার গজল ও কবিতা রচিত হবার পর পরেই তা মানুষের মুখে মুখে ফেরে। বিশেষ করে যুবক ও তরুনরা কবির এসব কবিতার ভক্ত। সিরাজনগরীতে শাখে নাবাত নামে এক সুন্দরী মহিলা থাকতেন। তিনি হাফিজের কবিতা পড়ে তার প্রেমে পড়ে যান। কবি হাফিজ একথা জানতে পেরে তাঁকে দেখেন এবং পছন্দ করে বিয়ে করেন। তাদের দাম্পত্য জীবন সুখেই কাটছিল। কিন্তু হঠাৎ করে কবি পত্নী ইন্তেকাল করলেন। এর ফলে কবির হৃদয় রাজ্যে তুমুল ঝড় সৃষ্টি হয়। হতার জীবন দুঃখ কষ্টে ভরে যায়। এরপর কবি আর বিয়ে করেননি। হাফিজ জীবিত কালই অনেকের বিরাগভাজন হন। তারা তার নামে নানান অপপ্রচার চালায়। কবিও তার নিন্দুকদের প্রতি কটাক্ষ করে কবিতা রচনা করেন। হাফিজ সে সময় প্রচলিত অনেক রীতিনীতিকে মেনে নিতে পারেননি। তিনি যুক্তি তর্ক দিয়ে সে সবের সমালোচনা করতেন। অনেকে তার এসব সমালোচনা পছন্দ করত না।

কবি তার পত্নী শাখে নাবাতাকে গভরভাবে ভালোবাসতেন। পত্নীর স্মরণে তিনি রচনা করেছেন বহু প্রেমের কবিতা ও গজল। তার স্মৃতিকে ধরে রেখে তিনি বাকী জীবনটা কাটিয়েছেন। তিনি লিখেছেন, তোমার ভালবাসা আমার মন ও প্রাণের কাষ্ঠফলক থেকে কখনো মুছে যাবার নয়। তোমার প্রেমের মাধুরী আমার স্মৃতি হতে কখনো দূরীভূত হবার নয়। কবি আরো বলেন, তোমার প্রেম আমার মনপ্রঅণ এমন ভাবে অধিকার করে বসেছে যে আমার মাথাও যদি কেটে নেয় তথাপি আমার প্রাণ হতে তোমার ভালবাসা আলাদা হবে না। সে যুগে ধর্মের নামে অনেকে বাড়াবাড়ি করতেন। সে যুগে প্রচলিত ৪টি মাজহাব কবি মানতেন না। তিনি খোদা প্রেমে বিভোর ছিলেন। তাই সহজভাবে তিনি নিজেকে সকল মাজহাব থেকে মুক্ত ঘোষণা করেছেন। অনেকে তাকে জিজ্ঞেস করতো- আপনি কোন মাজহাবের মুসলমান। জবাবে তিনি বলেন,

নাহি হানাফী, শা’ফী, হাম্বলী মালেকী

প্রেম মম এক ধর্ম, অন্য কিছু নাজি জানি।

তিনি প্রেমের মাধ্যমে আল্লাহকে পেতে চাইতেন। এজন্য বাস্তব জীবনে নামাজরোজা ও ইসলামের অন্যসকল নিয়ম কানুন যথাযথভাবে পালন করতেন। হাফিজ ১৩৮৯ সালে সিরাজনগরে ইন্তেকাল করেন। তবে ইন্তেকালের পর তার দাফন নিয়ে শুরু হয় বিতর্ক। কেউ কেউ কবির জানাজা পড়তে রাজী হলেন না। কবি নিজেকে পাপী মাতাল বলেছেন। এ কারণেই তাদের এই মনভাব। অথচ কবিতায় এসব শব্দ রূপক হিসেবে ব্যবহার হতে পারে। মাতাল মদ খেয়ে নেশা করলেই হয় না। এ শব্দটি প্রেমের ক্ষেত্রে ব্যবহার হয়। যেমন- তোমার প্রেমের শরাপ পানেস আমি হয়েছি মাতাল। এখানে শরাব বলতে মদ বোঝায় না আবার মাতাল বলতে মদ খোরকে বোঝায় না।

কবি হাফিজের লাশ পড়ে আছে। কিন্তু বিরোধ বেধেছে তিনি সত্যিকার খাঁটি মুসলমান কিনা তা নির্ধারণ করা নিয়ে। একদল বলছে, এতে কোন সন্দেহ নেই তিনি একজন ভাল মুসলমান। অপর দল তাঁকে প্রকৃত মুসলমান বলে মানতে রাজী নয়। এই বিরোধের ব্যাপারে শালিস বসলো। সিদ্ধান্ত হল, কোন এক ব্যক্তি কবির একটি কাব্য সংকলন খুলবেন যেখানে কবির ঈমানের সাক্ষ্য প্রমাণ পাওয়া যাবে। হাফিজের কাব্যগ্রন্থ খোলা হয়। সেখানে যে শ্লোকটি রয়েছে তা’তে সকলে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলেন। কবি লিখে গেছেন,

ফিরিয়ে দিও না ক্ষোভ ভরে, চরন তোমার

হাফিজের জানাজা হতে

হতে পারে সে পাপ পঙ্কে নিমজ্জিত

কিন্তু জান্নাতে সে যাবে।

এরপর আর কারো মুখে কোন কথা নেই। সবাই মিলে মহা সমারোহে কবির জানাজা ও দাফন কাজ সম্পন্ন করলেন। সিরাজনগরের ৩ কিলোমিটার দূরে একটি গাছের নীচে তার কবর দেয়া হয়। পরবর্তীকালে মোগল সম্রাট বাবর সিরাজনগর দখল করে হাফিজের কবর সুন্দরভাবে সাজিয়ে দেন। তিনি সেখোনে সমাধি স্তম্ভও নির্মাণ করান। সেখানে বহুমূল্যবান কালপাথরে কবির লেখা কিছু কবিতা খোদাই করে সমাধি স্তম্ভে লাগিয়ে দেয়া হয়। পারস্য সম্রাট খান জান্দ কবির মাজারের আরো সৌন্দর্য্য বৃদ্ধি করেন। কবির সমাধির চারদিকে রয়েছে বাগান। হাফিজের প্রিয় সাইপ্রেস গাছ এ বাগানে শোভা পাচ্ছে। বর্তমানে কবি হাফিজের নাম অনুসারে ঐ স্থানের নাম করণ করা হয়েছে হাফিজিয়া। কবি আজ চির নিদ্রায় শায়িত। বর্তমানে দেশ বিদেশ থেকে হাজার হাজার লোক এসে মাজার জেয়ারত করে। কবির সমালোচকরা মহাকালের গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। কিন্তু কবির গজল ও কবিতা টিকে আছে। আজও মানুষ ভক্তিভরে দিওয়ান-ই-হাফিজ পাঠ করে। আজ জ্ঞানী গুণী ও পন্ডতরা কবির অমর ও শাশ্বত প্রেমের কবিতা পড়ে মুগ্ধ হয়ে পড়েন।

টি/আ

 

Leave a Comment