থ্যালাসেমিয়া ও একজন জীবনযুদ্ধে জয়ীর গল্প

  • সুকন্যা ঘোষ ব্যাগ
  • মার্চ ২১, ২০২১

আমি সুকন্যা ঘোষ ব্যাগ। পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার একটি ছোট অঞ্চল বোলপুরে নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারে আমার জন্ম হয়। আমি আমার বাবা মায়ের প্রথম সন্তান তাই সবার খুব আশা ছিল ছেলে হবে, মেয়ে হওয়ার জন্যে অনেকেই অনেক কিছু বলেছিল। যদিও আমার মা বাবা খুবই খুশি। জন্মের ২দিন পর আমার জ্বর আসে ৪দিন পর আমার জন্ডিস ধরা পড়ে। আমাকে বর্ধমান নার্সিং হোমে নিয়ে যাওয়া হয়।আমার মনেঞ্জাইটিস ধরা পড়ে। আমার বাবা মা আর্থিক ভাবে একটু পিছিয়ে ছিল।

আমাদের অনেক বড় পরিবার ছিল কিন্তু খুব সদস্যই সাহায্য করে ছিল এইসময়। এইভাবেই কাটে অনেক গুলো দিন। তারপর বাড়ি ফিরে আসে আমার মা বাবা আমাকে নিয়ে, জন্মের পর প্রথম বাড়ি ফিরলাম, না কেউ দেখতে এলো, না আমাকে কেউ একটু আদর করলো বরং অনেকে আমার মা বাবা কে পরামর্শ দিল; আমাকে কোনো অনাথ আশ্রমে রেখে এসে, আবার বাচ্চা নিয়ে নতুন করে জীবন শুরু করার। আমার ৭মাস বয়স হলো সবাই বললো মেয়েের অন্নপ্রাশন করতে নেই। তবুও আমার মা কারোর বারণ না শুনে নিজের সোনার কানের দুল বিক্রি করে আমার অন্নপ্রাশন করে অনেক লোক খাওয়ানো হয়, আমাকেও খুব সুন্দর করে সাজানো হয়।

আরো পড়ুনঃ বাড়তি ওজন দ্রুত কমাতে রাতের খাবার যেমন হওয়া জরুরী

সেইদিন বিকালে আবার জ্বর আসে। ডক্টর জানায় আমি একজন থ্যালাসেমিয়া নামক রক্তাল্পতা রোগে ভুগছি যার কোনো স্থায়ী চিকিৎসা নেই রক্ত দিয়ে বাঁচিয়ে রাখতে হবে সারাজীবন। (এই রোগের কারণ বাবা মা ২জনেই বাহক হলে তবে তার কোনো ১টি বাচ্ছা এইরকম রোগী হয়ে জন্ম নেবে তাই বিয়ের আগে রক্ত পরীক্ষা করিয়ে তবেই বিয়ে করা উচিৎ। তবে ১জন বাহক ১জন সুস্থ মানুষের বিয়ে হলে তাদের সন্তানদের কোনো অসুবিধা নেই। অনেক সরকারী হাসপাতালে এই বাহক পরীক্ষা সম্পূর্ণ বিনামূল্যে করা হয়। এছাড়াও যদি গর্ভাবস্থায় বাচ্চার পরীক্ষা করিয়ে নেওয়া যেতে পারে যদিও তা অনেক ব্যয়বহুল আর এই সুবিধা সব জায়গায় নেই।)

এইভাবেই কাটে অনেক গুলো মাস। যেহেতু আমার বাবা মা আর্থিক ভাবে খুবই পিছিয়ে তাই থেমে যায় আমার চিকিৎসা। ৩বছর কেটে যায় অনেকে বলে একে মেয়ে তারপর অসুস্থ ওর পড়ে কি হবে, ও এত পারবেও না। আমার মা আমাকে স্কুলে ভর্তি করে। আমার মা আমাকে নাচ গান আঁকাতেও ভর্তি করে দেন। আমিও ভালো রেজাল্ট করি সবকিছুতেই। যখন আমার বয়স ৭বছর তখন আমার টাইফয়েড হয়, আমি খুব অসুস্থ হয়ে পড়ি। খুব রক্ত কমে যায় আবার রক্ত দেয়া শুরু হয়। পড়াশোনাতেও খুব পিছিয়ে পড়ি। আমার নাচ গান বন্ধ হয়ে যায়।অনেক ডক্টর দেখানোর পর কিছু ডক্টর জানায় bone marrow transplant করলে আমি সুস্থ হয়ে যেতে পারি। যা খুবই ব্যয়বহুল। তবু আমার মা বাবা সেদিকেই এগোয়। তারপর অনেক ডক্টরের আলোচনার পর আমরা জানতে পারি bone marrow transplant আমাদের দেশে সবসময় সফল নয় এতে জীবনের ও ঝুঁকি আছে। আরও কয়েক বছর কেটে যায় নার্সিং হোম আর বাড়ি এইভাবেই। তারপর ১জন ডক্টর বলেন spleen surgery (শরীরের সব থেকে বড় লসিকা গ্রন্থি যা আমাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধ করতে সাহায্য করে)করলে আর কিছু ওষুধের মাধ্যমে সাময়িক ভাবে একটু ভালো থাকা যেতে পারে।

আরো পড়ুনঃ আপনার প্রিয় সন্তানের উচ্চতা বাড়ানোর সহজ ৬টি কৌশল!

অবশেষে অনেক আলোচনার পর 14March 2014 তে আমার surgery হয়। তারপর অনেকটাই ভালো আছি, তবুও কিছু সমস্যা থেকেই যায় তাই খুব সাবধানে থাকার কথা বলেন চিকিৎসক। আবার আমার মা বাবার উৎসাহে আবার আমার নাচ গান এর প্রশিক্ষণ শুরু হয়। শুরু হয় আরো ২টো নতুন স্বপ্ন, 1.modeling(pagent model), 2. থ্যালাসিমিয়া প্রতিরোধ। আর এই বছর আমি শ্যাম সুন্দর জুয়েলার্স শারদ সুন্দরীর তালিকায় ৩০জনের ১জন হয়েছি, বোলপুর কলেজের সংস্কৃত সাম্মানিকের সেরা পাঁচজনের ১জন আমি। সঙ্গে কাজও করে যাচ্ছি থ্যালাসিমিয়া সচেতনতা ও প্রতিরোধ। আজও আমাদের দেশে অনেক কুসংস্কার অনেক খারাপ ধারণা আছে এই নিয়ে। আর তাই ডাক্তার এবং এই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসা ও খুবই কম। দেশের মন্ত্রী ও সজ্জন মানুষ ও উদাস এই বিষয়ে। অনেক রোগীই এখনও রক্তের অভাবে পর্যাপ্ত চিকিৎসা না পেয়ে কষ্ট পায় অনেকে মারাও যায় (এই অসুবিধা তে আমিও পড়েছি)।

অনেকের পরিবার রোগীকে পাপী মনে করে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেন। আমার বিনীত অনুরোধ দয়া করে এমন কেউ করবেন না। ওদের পাশে থাকুন ওদের সাহায্য করুন বাবা মায়ের সাহায্য অনুপ্রেরনা ওদের কাছে সব থেকে বেশি প্রয়োজনীয়। আমার আরো ১টি বিনীত অনুরোধ women's corner কে আমার এই ক্ষুদ্র প্রচেষ্টাকে সফল হতে আপনারাও সাহায্য করুন অনুগ্রহ করে শেয়ার করবেন এবং অন্যকে শেয়ার করতে অনুরোধ ও করবেন। আমার একার উদ্যোগে এই সমস্যা সমাধান হয়ত কোনোদিনই হবে না। তাই আপনারাও এগিয়ে আসুন আর আমাকে সাহায্য করুন please...।

এ সম্পর্কিত আরও পোস্ট

Leave a Comment