কোয়েম্বাটুর মহা নগরের খুঁটিনাটি : চিকিৎসা ( দ্বিতীয় পর্ব )

  • ফারজানা আক্তার 
  • মে ৮, ২০১৯

যেহেতু আমি চিকিৎসার জন্য কোয়েম্বাটুর গিয়েছিলাম তাই আজকে সেখানকার চিকিৎসা নিয়ে আমার অভিজ্ঞতা লিখবো। 

আমার কিছু গাইনি প্রব্লেম ছিলো। তার জন্য ডাক্তার কিছু টেস্ট দিয়েছিলো। সেই টেস্ট করতে গিয়ে আমার কিডনি প্রব্লেম ধরা পড়ে।  বাংলাদেশে প্রথম যখন আমার এই প্রব্লেম ধরা পরে তখন বলা হয়েছিলো আমার লেফট কিডনি ড্যামেজ। কোন কাজ করছে না। আরো শিওর হওয়ার জন্য সেই ডাক্তার কিছু টেস্ট দিলেন এবং একই রিপোর্ট আসলো। বলে রাখি এই ডাক্তার ছিলেন ভারতের চেন্নাইয়ের। যে নালি দিয়ে ইউরিন পাস হয় (মূত্রনালি) সেই নালিতেও আমার প্রব্লেম ধরা পড়ে। তিনি তখন আমাকে একজন ইউরোলজিস্ট দেখাতে বলেন।

আমি ডাক্তার চেঞ্জ করলাম। একজন ইউরোলজিস্টের কাছে গেলাম। তিনি আমাকে আরো কিছু টেস্ট দিলেন সেই নালিতে পাথর, নাকি নালি চিকন সেটা আইডেন্টিফাই করার জন্য। আমি টেস্ট করিয়ে রিপোর্ট নিয়ে গেলাম। তিনি তখনো শিওর হতে পারলেন না। তারপর তিনি বললেন আমার একটা সার্জারি লাগবে মূত্রনালিতে কি প্রব্লেম সেটা দেখার জন্য। আর, তিনি কিডনির সব রিপোর্ট দেখে বললেন কিডনি কিছুটা কাজ করছে। রিকভার করা সম্ভব তবে ৫০/৫০ চান্স। তিনি আমার বাবা মাকে ডাকতে বললেন কারণ সোজা ভাষায় বললেন ভালো না হলে দ্বায়ভার তার না। ডাক্তার তার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেন রোগীকে সুস্থ করে তোলার। তাই রোগী সুস্থ না হলে অবশ্যই সেই দ্বায়ভার ডাক্তারকে দেওয়া উচিত না। ডাক্তারের দায়িত্বে গাফলতি থাকলে সেটা ভিন্ন বিষয়। 

আসল কথায় আসি। আমি কাঁটাছেড়া, ডাক্তার, হাসপাতাল এমনি অনেক ভয় পাই। সার্জারির কথা শুনে আমার কলিজা একদম মরুভূমি হয়ে গেছে। আরেকটি বিষয় কিডনির ব্যাপারে এক ডাক্তার বললো একদম কাজ করছে না, অন্যজন বললো কিছুটা কাজ করছে। আমরা কনফিউশনে পড়ে গেলাম। মুরাদ (আমার হাসব্যান্ড) মূত্রনালি সার্জারির ব্যাপারে বিস্তারিত জানতে গেলো। আমি সোজা কথায় বললাম আমি সার্জারি করবো না। আগে প্রব্লেম ফাইনাল হোক, তারপর অন্য চিন্তা করবো। 

তারপর আমরা আরো ৩জন ডাক্তার চেঞ্জ করলাম। এবং এই তিনজনের মধ্যেও কেউ বলে আমার কিডনি কাজ করে, কেউ বলে করে না। মূত্রনালির প্রব্লেমটাও কেউ সঠিকভাবে আইডেন্টিফাই করতে পারে নি। সবাই সার্জারির ব্যাপারে সাজেশন দিয়েছেন। মুরাদ মোটামুটি ঠিক করে ফেলেছে আমার সার্জারি করাবে। তখন আমি বললাম একবার ইন্ডিয়া গিয়ে পুরো চেকআপ করিয়ে নেই। আগে প্রব্লেম না জেনে কিসের সার্জারি করবো আমি! 

তখন আমরা সিদ্ধান্ত নেই ইন্ডিয়া যাওয়ার। প্রথমে ভেবেছিলাম চেন্নাই যাবো। কোয়েম্বাটুরে মুরাদের মামা থাকেন। পরে সেখানে যাওয়ার সিদ্ধান্ত হলো। ইন্ডিয়ায় আমি গাইনোকলজিস্ট, ইউরোলজিস্ট, নেফ্রোলজিস্ট তিন ডাক্তারই দেখালাম। প্রথমে আমি গেলাম ইউরোলজিস্টের কাছে। তিনি প্রথমে আমার সকল কথা মন দিয়ে শুনলেন। কথা শুনতে শুনতে টেস্টের নাম লিখেন নি। কথার মাঝখানে বলেন নি আগে এই টেস্টগুলো করিয়ে নিয়ে আসুন। ওই জায়গা থেকে করাবেন! সহকারীকে ডেকে বলেন নি ওদের জায়গাটা সম্পর্কে বলে দাও। 

তিনি আমার সকল কথা শুনে আমার বাংলাদেশের সকল রিপোর্ট খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলেন। তারপর বললেন লেফট কিডনি কোন কাজ করছে না। আমি চাইলে এখন সার্জারি করে লেফট কিডনি রিমুভ করতে পারি। ফিউচারে এর থেকে ইনফেকশন হতে পারে। তখন সেটা আমার জন্য ক্ষতিকর হবে। তিনি এই নিয়ে আরো অনেক বিস্তারিত আমাদের বললেন। তিনি আমাকে কোন টেস্ট দেন নি। শুধু বললেন সার্জারির আগে একটা টেস্ট করাবেন। সাথে আমাদের আরো বলে দিলেন কিডনি রিমুভের সার্জারি এক্সপেন্সিভ এবং রিস্কিও। তাই সিদ্ধান্ত যেন আমরা ভেবেচিন্তে সময় নিয়ে নেই। 

তারপর গেলাম গাইনোকলজিস্টের কাছে। সেদিন আমি আমার সকল রিপোর্ট বাসায় রেখে গিয়েছিলাম। তার কাছে গাইনি সম্পর্কিত সকল প্রব্লেম বলার পর তিনি একটা টেস্ট দিলেন এবং টেস্টের সময় নিজে উপস্থিত ছিলেন। বাংলাদেশের গাইনোকলজিস্ট আমার যে প্রব্লেম বলেছিলেন, তিনিও সেটা বললেন। সাথে তিনি বেটার সমাধানের জন্য আমাকে সার্জারির কথা বললেন। তখন মুরাদ উনাকে আমার কিডনির প্রব্লেমের কথা বললো। তিনি তখন আমার আগের সব টেস্টের রিপোর্ট চাইলেন। বললেন যদি সম্ভব হয় তাহলে রিপোর্টগুলো নিয়ে আসতে। 

মুরাদ মামাকে ফোন করলো। মামা তার চেম্বার থেকে বের বাসা থেকে সব রিপোর্ট নিয়ে গেলেন। ভাগ্য ভালো ছিলো বাসা খুব বেশি দূরে ছিলো না। ভদ্রমহিলা আমার আগের সব রিপোর্ট এবং কিডনির বিষয়ে বিস্তারিত জানার পর বললো এখন তারা আমাকে কোন মেডিসিন বা সার্জারির বিষয়ে বলার আগে কয়েকবার ভাববে। তখন তিনি চিফ নেফ্রোলজিস্ট ড. রামালিংগাম কে এস (Dr. Ramalingam K S) (শুধু উনার নাম কেন উল্লেখ করলাম একটু গুগল করলে বুঝতে পারবেন। )এর কাছে যেতে বললেন। ভদ্রমহিলা সাথে বললেন তার সাথে কথা না বলে তোমরা বাংলাদেশে যেও না। ভদ্রমহিলা তখন আমরা বাংলাদেশ থেকে গিয়েছি থেকে শুরু করে আমার বিয়ের বয়স, আমার বয়স, আমার সকল সমস্যা নিয়ে বিস্তারিত একটা চিঠি লিখলেন। এই চিঠি ড. রামালিংগাম কে এস - কে দিতে বললেন। মোবাইল ফোনের এই যুগে তিনি চাইলে ২মিনিট কথা বলতে পারতেন। কিন্তু এই সময় ড. রামালিংগাম কে এস কথা বলার অবস্থায় আছেন কিনা সেটা আমরা এখানে বসে কেউ জানি না। তাই তিনি চিঠি লিখে দিলেন। 

তারপরের দিন আমরা গেলাম নেফ্রোলজিস্টের কাছে। তিনি আমার কাছ থেকে বিস্তারিত প্রব্লেম শুনলেন, চিঠি পড়লেন। তারপর তিনি আমাকে ৩টা টেস্ট দিলেন। পরেরদিন রিপোর্ট নিয়ে তার কাছে যেতে বললেন। তিনি রিপোর্ট দেখলেন। তারপর আমার গাইনি ডাক্তারকে ফোন দিলেন। দুইজন আমার দুই ধরণের প্রব্লেম নিয়ে নিজেদের মধ্যে কথা বললেন। সামনে কিন্তু আমরা বসা আছি। তারা ইংরেজি আর তামিল ভাষায় কথা বলছিলেন। তারপর তিনি আমাদের জানালেন আমার রাইট কিডনি ভালো আছে। ভালো কাজ করছে। লেফট কিডনি একদম কাজ করছে না এবং সাইজে খুব ছোট। আপাতত নরমাল জীবনযাপন করার জন্য। এখন কোন সার্জারিতে যেতে হবে না। যখন থেকে শরীরে প্রব্লেম শুরু হবে তখন ফাইনাল ট্রিটমেন্টে যেতে। কারণ এখন এই ধরণের সার্জারিতে আমার শরীরে সাইড এফেক্ট বেশি হবে। যেহেতু আমার কোন প্রব্লেম হচ্ছে না, তাই এখন শরীরে শুধু শুধু সাইড এফেক্ট ডেকে নিয়ে আসার মানে নেই। 

মূত্রনালির ব্যাপারে আমাকে জিজ্ঞেস করলো ইউরিনে আমার কোন প্রব্লেম হয় কিনা! জ্বালাপোড়া বা আটকে থাকে কিনা! আমি না বললাম। তখন তিনি বললেন সেখানে সিস্ট টাইপের কিছু একটা আছে। ইউরিন এখানে এসে বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে বাট ক্লিয়ার হয়ে যাচ্ছে। বছরে একবার আমাকে চেকআপ করাতে বললেন। এর মাঝে কোন প্রব্লেম হলে তাকে কল দিতে বললেন। শরীরে প্রব্লেম না হওয়া পর্যন্ত চিন্তামুক্ত থেকে স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে বললেন। 

যেহেতু গাইনি ডাক্তার আমার গাইনি সমস্যার জন্য একটা সার্জারির কথা বলেছিলেন আমরা আবার তার কাছে গেলাম। ফাইনালি কি করবো সেটা জানার জন্য। এরমাঝে তো তার সাথে আবার নেফ্রোলজিস্টের কথাও হয়ে গেলো। তিনিও তখন জানালেন আপাতত কোন সার্জারিতে যেতে হবে না। নরমাল খাবার দাবার খেয়ে সুস্থ থেকে স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে। য্খনই আমি কোন প্রব্লেম ফেস করবো তাদের সাথে যোগাযোগ করতে। 

সেখানে প্রতিটা হাসপাতালে প্রতিটা পেশেন্টের বিস্তারিত আলাদা আলাদা ফাইল থাকে। প্রতিটা টেস্টের দুইটা কপি হয়। একটা চলে যায় ডাক্তারের কাছে, একটা আসে রোগীর কাছে। প্রতিটা পেশেন্ট ডাক্তারের রুম থেকে বের হওয়ার মিনিমাম ৫মিনিট পর অন্য পেশেন্টের ডাক আসে। যখন যে পেশেন্টে ডাক্তারের রুমে ঢুকে তার রিপোর্ট নিয়ে ডাক্তার সেই গ্যাপের সময়টুকুতে একটু স্টাডি করে নেন। প্রতিটা পেশেন্টের পেশেন্ট আইডি কার্ড করা থাকে। আমি যদি ৫বছর পর আবার সেই হাসপাতালে যাই আমার পেশেন্ট আইডি কার্ড নিয়ে, আইডি কার্ড ধরে ৫বছর আগের সেই ফাইল বের করবে।  

ডাক্তারদের ব্যবহার, কথাবার্তা, আন্তরিকতা নিয়ে বলার কিছু নেই। একটু বেশি অমায়িক তারা। কঠিন কথা কত সহজভাবে বলা যায় আমি দেখেছি। আমার একটা কিডনি নেই , এখন ভাবতে এবং লিখতে যেয়ে আমার সারা শরীরে একটু কাঁপন দিলো। কিন্তু উনারা যখন বলছিল আমি হাসছিলাম। তাদের বলার ধরণে মনে হয়েছিলো আমার সর্দি লাগছে। এইতো একটা নাপা এক্সট্রা খেলে ঠিক হয়ে যাবে। 

চলবে   

Leave a Comment