কোয়েম্বাটুর মহা নগরের খুঁটিনাটি : ব্যবহার ( তৃতীয় পর্ব )

  • ফারজানা আক্তার 
  • মে ১১, ২০১৯

তামিলনাড়ু লোকজনের চলাফেরা ভিন্ন ধরণের। এবং এটা প্রতিটা দেশের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। ভিন্ন দেশ, ভিন্ন কালচার হবে স্বাভাবিক। সেখানকার মেয়েরা শাড়ি পরে আঁচল কোমরে গুঁজে রাখে। মেয়েরা বাহিরে বের হলে মাথায় ফুল পরে। ছেলে মেয়ে উভয়ের কপালে চন্দন থাকে। বাহিরের লোকজনকে খুব সহজে আলাদা করা যাবে তাদের নিজস্বতা থেকে। আর বেশিরভাগ মানুষের গায়ের রং কালো হয়। মজার ব্যাপার হলো তাদের গায়ের রংয়ের মনে হয় কোন থিম আছে! সবাই একই রকম কালো। নিগ্রোও বলা যাবে না, আবার শ্যাম বর্ণও বলা যাবে না। ভাষার কথা কি বলবো! এতো শক্ত তামিল ভাষা! আকার ইঙ্গিতে আর কতক্ষণ মনের ভাব প্রকাশ করা যায়। তারা হিন্দি আর ইংরেজি খুব বেশি বুঝে না। জানে না। হিন্দিটা রাজনৈতিক কারণে তারা এভোইড করে। 

মানুষ হিসেবে তারা অসাধারণ। অসাধারণ মানে খুবই অসাধারণ। ভাষার কারণে এবং আমাদের চলাফেরার কারণে খুব সহজে তারা বুঝতে পারতো আমরা বাহিরের মানুষ। যখন কোথাও খেতে যেতাম, বেড়াতে যেতাম কিংবা কেনাকাটা করতে যেতাম তখন প্রতিটা বিষয় বুঝাতে যেয়ে আমাদের ঘাম ছুটে যেত। অনেকে টুকটাক ইংলিশ বুঝতো, অনেকে হিন্দি। যারা তামিল ছাড়া কিছুই বুঝতো সেখানে কি যে ঝামেলা হতো! টাকা বের করে কোন পণ্যের দাম কত তারা আমাদের সেভাবে বুঝাতো। আমরাও তাদের হাতের টাকা গুনে গুনে পণ্যের দাম মিটাতাম। 

আমাদের ঘাম ছুটে যেতো কিন্তু তারা বিরক্ত হতো না। তারা এমনি খুব আন্তরিক, আর আমরা বাহিরে লোক ছিলাম। তবুও আমাদের প্রতি আন্তরিকতা কম ছিল না। একবার রাস্তায় কাঁঠাল খুলে বিক্রি করছিলো এক মহিলা। আমরা কাঁঠাল খেতে গেলাম। প্রব্লেম সেই ভাষা। কোন রকমে ২৫০গ্রাম কাঁঠাল নিয়ে সেখানে দাঁড়িয়ে খাচ্ছিলাম। মহিলা তামিল ভাষায় কিছু জানতে চাচ্ছিলেন। আমরা যেসব উত্তর আকার ইঙ্গিতে বলেছি কিন্তু তিনি সন্তুষ্ট নন। তিনি জানতে চাচ্ছেন এক, আমরা বুঝাচ্ছি আরেক। 


এই সেই কাঁঠাল 
 

তখন সেই ভদ্রমহিলা পাশের দোকানের একজনকে ডেকে আনলেন। সেই লোক কিছুটা হিন্দি বুঝে। তারপর সেই ভদ্রলোকের কাছে ভদ্রমহিলা প্রশ্ন করে, ভদ্রলোক হিন্দিতে আমাদের ট্রান্সলেট করে দিলেন। আমরা হিন্দিতে উত্তর দিলাম। ভদ্রলোক আবার আমাদের উত্তর তামিলে ট্রান্সলেট করে ভদ্রমহিলাকে বললেন। ভদ্রমহিলা জানতে চেয়েছেন আমরা কোথায় থেকে গিয়েছি, কেন গিয়েছি, কোথায় উঠেছি। আমাদের তার ভালো লেগেছে ইত্যাদি। ছোটখাটো এমন অনেক মজার ঘটনা আছে। 

তাদের সততার একটি ঘটনা বলি। সেখানকার স্থানীয় একটি সুপারশপ থেকে শপিং করছিলাম। প্রথমে আমি কিছু সাইড ব্যাগ আর জুতা নিলাম। ক্যাশ কাউন্টারে সেগুলো রেখে আমি কসমেটিকসের দিকে গেলাম। একটু পর একজন মেয়ে এসে আমাকে ডাকলো। বললো আমার পছন্দ করা একটা ব্যাগ ড্যামেজ। আমি বললাম আপনি যান, আমি আসছি। গিয়ে দেখি তিনি যে ব্যাগ ড্যামেজ বলছেন সেটার এক সাইডে ছোট্ট একটা জায়গায় সুতার ফিনিশিংটা ঠিক হয় নি। এই প্রব্লেমটা এত ছোট যে দেখা যেত আমি হয়তএই ব্যাগ ব্যবহার করে ফেলে দিয়েছি, ওই সুতার ফিনিশিংটা চোখেই পড়ে নি আমার। 

আমি সেই মেয়েকে বললাম, 'ইটস এ সিম্পল ইস্যু' । মেয়ে উত্তর দিলো, 'ইট মে বি সিম্পল ফর ইউ বাট এ বিগ ইস্যু ফর আস।' আমি নিজে পছন্দ করে দেখেশুনে ব্যাগ রেখে আসলাম। প্যাকেট করার আগে তারা আবার প্রতিটা পণ্য নিজেদের মতো করে চেক করে। আমি খুব অবাক হয়েছি এই ব্যাপারটি দেখে। 

খাবার দাবারে ব্যাপক ঝামেলা। তাদের রান্নাটা একটু কেমন যেন! এক মাছ ভাজি, ফুলকপির পাকোড়া ছাড়া তেমন কোন খাবার ঠিক মুখে রুচে নি। তবে কলাপাতায় করে খাবার প্রথম খেলাম। এটা ভালো লেগেছে। তাদের বেশিরভাগ মানুষ দই ভাত খায়। দ্বিতীয়দিন বাহিরে খাওয়ার সময় দেখলাম এক লোক দই ভাতের সাথে মাছ ভাজা খাচ্ছে। ভালো কথা তারা ভাতের সাথে পাপড় ভাজা খায়। তাদের বেশিরভাগ খাবারে কেমন টক টক একটা স্বাদ থাকে। 


ফ্রাইড রাইস আর ফিস ফ্রাই
 

স্থানীয় হোটেলের খাবার দাবার  
 

আমাদের দেশে প্যাকেট করতে দেই এই জিনিস, বাসায় এসে দেখি অন্য জিনিস। তাদের জীবনযাত্রা খুব সাধারণ। খুব ভোরে উঠে কাজে নেমে যায়। রাতের ৮টার মধ্যে সকল মোটামুটি সকল দোকানপাট বন্ধ হয়ে যায়। রাত ১০টার মধ্যে প্রায় সবাই ঘুমিয়ে যায়। প্রতিটা পরিবারের ছেলে মেয়ে সবাই কাজ করে। তারা একজন অন্যের উপর নির্ভর করে না। ঘরের বাহিরের সব কাজ ছেলে মেয়ে সবাই মিলে করে। নিজেদের শারীরিক এবং মানসিকভাবে শান্তিতে রাখার জন্য যতটুকু যা প্রয়োজন তার সবটাই তারা করে থাকে।  সুন্দর মনের অনেকগুলো মানুষের সাথে সুন্দর একটি শহরে বেশ ভালো কিছু সময় কাটিয়ে এসেছি। 

Leave a Comment