সুন্দরবন ভ্রমণ

  • মোঃ ফজলুল কবির পাভেল
  • আগস্ট ২৫, ২০১৯

২০১৩ সালের মাঝামাঝি সময়। তখন আমি বাঘা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে সহকারী সার্জন হিসেবে কর্মরত। সহকারী সার্জন হিসেবে অনেক কাজ করতে হত। বাঘায় যেদিন ডিউটি থাকত সেসময় প্রতিদিনই নতুন নতুন মানুষের সাথে পরিচিত হতাম। আমার বেশ  ভাল লাগত। তবে এদের মধ্যে সবাই যে মনে দাগ কাটত তা নয়। কাউকে কাউকে আবার অনেক  বেশি  ভাল লাগত। যাদের ভাল লাগত তাদের  মধ্যে একজন  ছিলেন শাজাহান ভাই। উনি ছিলেন সহজ সরল। আমাকে খুব ভালবাসতেন আর শ্রদ্ধা করতেন বুঝতে পারতাম। বাংলাদেশের অনেক জায়গা আমি ঘুরেছি। সুন্দরবনের কথা অনেক শুনেছি কিন্তু কোনদিনই যাইনি। সুন্দরবন দেখার আগ্রহ তাই আমার সবসময়ই ছিল।

একদিন শাজাহান ভাইকে কথা প্রসঙ্গে সুন্দরবনের কথা বললাম। সাথে সাথে উনি রাজি হলেন।পরিকল্পনা অনুসারে একদিন খুব ভোরে রাজশাহীর বাসা থেকে বের হলাম। আমি তখন থাকতাম রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে।দুইজন একসাথে রাজশাহী রেল ষ্টেশনে গেলাম। যে ট্রেনে যাব বলে ঠিক করেছিলাম যেয়ে দেখি সেই  ট্রেন সেদিন বন্ধ। একটু হতাশই  হলাম। কিন্তু আমি সহজে হাল ছাড়ার পাত্র নই। জানতে পারলাম আরেকটু পরেই আরেকটা ট্রেন ছাড়ে তবে সে ট্রেন খুলনায় যায়না । সেই ট্রেনে কুষ্টিয়া পর্যন্ত যাওয়া যাবে। কি আর করা!  ৭ টার  সেই মধুমতি ট্রেনে চেপে বসলাম আমরা দুজন। ট্রেন জার্নি আমার  সবসময়ই ভাল লাগে। জানি আমার মত অনেকেরই ট্রেন জার্নি ভাল লাগে। সকালের নাস্তা ট্রেনেই সারলাম। যদিও খাবারের মান নিয়ে মনের মধ্যে কিছু  প্রশ্ন থেকেই গেল। ট্রেনের কাটলেট আমার কাছে খুব রহস্যময় খাবার মনে হয়। সেটাই খেলাম বাধ্য হয়ে।  প্রায় সাড়ে দশটার দিকে কুষ্টিয়ায়  চলে গেলাম। সেখান থেকে রিক্সা নিয়ে সোজা  গেলাম মজমপুর বাসস্ট্যান্ডে । একটা বাস খুলনায় যাচ্ছিল । গড়াই পরিবহন বা এজাতীয় কিছু একটা নাম ছিল সঠিক মনে নেই।যেহেতু কিছুক্ষণের মধ্যেই ছাড়বে তাই সেই বাসেই উঠলাম ।  বাসের গতি ছিল  দুর্দান্ত যদিও একবার দুর্ঘটনার হাত থেকে  বাসের সব যাত্রীরা বেঁচে গেলাম। এভাবে গাড়ী চালিয়ে কি লাভ কে জানে! ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে দুই জন শিক্ষক আমার পরিচিত ছিলেন। ভেবেছিলাম দেখা করব। বিশ্ববিদ্যালয় পার হবার কিছু আগে ফোন দিলাম। দুর্ভাগ্যক্রমে  কাউকেই পাওয়া গেলনা! ঝিনাইদহ এবং আরও কয়েকটি শহর পার করে যশোরে পৌঁছে গেলাম। সেখান থেকে আরও  ঘণ্টা দেড়েক চলার পর খুলনায় চলে এলাম। পথিমধ্যে বৃষ্টি নামল । বৃষ্টি নামার আগে ও পরে বাংলার প্রকৃতির যে রূপ তা বর্ণনা করার ধৃষ্টতা আমার নেই। এই রূপ দেখেই বোধহয় আমার প্রিয় কবি জীবনানন্দ দাশ বলেছেন ,” বাংলার  মুখ আমি দেখিয়াছি, তাই আমি  পৃথিবীর রূপ খুঁজিতে যাই না আর : অন্ধকারে জেগে উঠে ডুমুরের গাছে চেয়ে দেখি ছাতার মতন বড়ো পাতাটির নিচে বসে আছে ভোরের দোয়েলপাখি “।

খুলনায় বাসস্ট্যান্ডের  খুব কাছেই একটা হোটেলে উঠলাম । আমরা খুব ক্লান্ত ছিলাম। ঘণ্টাখানেক ঘুমিয়ে নিলাম সেই হোটেলে ।ঘুম থেকে উঠে পরিচিত জনদের ফোন দিলাম।এরমধ্যে একজন  সন্ধ্যায় দাওয়াত দিলেন।যিনি দাওয়াত দিলেন  তিনি হচ্ছেন সুফিয়ান ভাই। একসাথে বুনিয়াদি প্রশিক্ষণ করেছি। চমৎকার মানুষ । আড্ডাবাজ ।একসাথে খাওয়া দাওয়া করে উনি বিদায় নিলেন। আরপর আমরা দুজন  নিউমার্কেট ও শহর ঘুরলাম। ভাল লাগল। অনেক উন্নত শহর মনে হল। এরপর গেলাম প্রফেসর কে পি সরকার স্যারের  সাথে দেখা করতে । স্যার রাজশাহী মেডিকেলে অনেকদিন ছিলেন।আমার সরাসরি শিক্ষক।  অত্যন্ত সৎ আর ভাল মানুষ।  অবসর নিয়ে খুলনায় একটা ক্লিনিকে রোগী দেখেন। এত ভাল আর সৎ মানুষ এখনও আছে স্যারের সাথে কথা বললেই সবাই বুঝতে পারবেন। স্যার আমাকে  চিনতে পারলেন।বেশ কিছুক্ষণ গল্প করলাম স্যারের সাথে । নাস্তা করলাম। স্যার আগের মতই আছেন। সুন্দরবন দেখতে এসেছি জেনে খুব খুশি হলেন।রাত হয়ে এসেছিল।  এরপর হোটেলে চলে এলাম।

পরদিন  খুব ভরে উঠে মংলার দিকে যাত্রা করলাম। বৃষ্টি হচ্ছিল। পথ যেন শেষই হতে চায়না। যদিও ভাল লাগছিল সবকিছু। নতুন জায়গা বরাবরই আমাকে কাছে টানে । চারদিকে  সবুজ আর সবুজে ভরা আমার প্রিয় দেশ। অবশেষে মংলা পৌঁছে গেলাম। এরপর যেখান থেকে সুন্দরবনের দিকে নৌকা ছাড়ে সেদিক গেলাম। নৌকা আর মাঝি পাওয়া গেল। আমরা ছিলাম দুই জন। ভাড়া অনেক বেশি চাচ্ছিলেন মাঝিরা । ৮ জন  এক নৌকায় উঠতে পারে। আমাদের ৮ জনের ভাড়াই দিতে হল। ব্যপারটা ভাল লাগল না । কি আর করা! আল্লাহ্‌র নাম নিয়ে নৌকায় উঠলাম । কিছুদূর যাওয়ার পর ভয় লাগা শুরু হল। তখন ছিল জোয়ার। অনেক পানি নদীতে । এমন এক সময়  আসল যখন পানি ছাড়া আর কিছু দেখতে পাচ্ছিলাম না। তাছাড়া নৌকার মাঝি আর তার সহকারীর চেহারাও সন্দেহজনক। এক অজানা ভয় মনে ঢুকে গেল। ভাবলাম ফিরতে পারব তো রাজশাহীতে ? আমি অনেক জায়গা ঘুরেছি। অনেকবার বিপদের মুখোমুখি হয়েছি। কিন্তু এবারের  বিপদটা একটু বেশীই মনে হল। যত দোয়া জানি পড়তে থাকলাম। দীর্ঘক্ষণ এভাবে চলার পর অবশেষে দূরে  ঝাপসা বনের মত কিছু একটা দেখতে পেলাম। মনে একটু সাহস এল। আর কিছুক্ষণ পরে বনের পাশ দিয়ে নৌকা চলতে লাগল । অসম্ভব ভাল লাগল। ভয় সব কেটে গেল।

এরপর করমজলে এসে নামলাম । বন বিভাগের কর্মচারীরা ছিলেন। সেখানে ওয়াচ  টাওয়ার ছিল। ওয়াচ টাওয়ারে  উঠলে বনের অনেকদূর দেখা যায় । অনেক পশু পাখি আমার  চোখে পড়ল । ওয়াচ টাওয়ার থেকে নেমে  কুমির প্রজনন কেন্দ্র দেখলাম। এরপর বন বিভাগের কর্মচারীকে সাথে নিয়ে সুন্দরবনের মধ্যে ঢুকলাম।বিভিন্ন ধরণের গাছ দেখলাম। কর্মচারী ছিলেন অনেক ধৈর্যশীল ।কিছু  গাছ চেনালেন। অনেক অজানা পাখি দেখলাম। হরিণ বেশী চোখে পড়ল । সাপ যেতে  দেখলাম। বাঘ দেখা যাবে কিনা জিজ্ঞাসা করলাম। উত্তর যা পেলাম তাতে মনে হল বাঘ দেখা খুব সহজ নয়। সুন্দরবন অনেকে দেখেছেন। কিন্তু বাঘ দেখেছেন এমন দাবী আমি অন্তত একজনকেও করতে শুনিনি ।বাঘ দেখতে পাবোনা  শুনে একটু হতাশ হলাম। শাজাহান ভাই বললেন ,” স্যার , রাজশাহী থেকে এতদূর আসলাম হরিণ আর শুধু কুমির দেখতে?”  শুনে খুব  হাসি লাগল। অনেকের ধারণা সুন্দরবনে গেলেই খালি একটার পর একটা  প্রাণী চোখে পড়বে । ব্যপারটা  আসলে সেরকম নয়। কর্মচারী ভাই অবশ্য বেশি দূর যেতে দিলেন না। খুব বেশিদূর গেলে নতুন কোন প্রাণী দেখব তেমনও মনে হলনা।  তাই নৌকার কাছে ফিরে এলাম। আবার সেই ভয়ঙ্কর নদী । যদিও ফেরার সময় ভয় আর লাগল না। ফেরার সময় দূর থেকে আবার সুন্দরবন দেখলাম। সুন্দরবন কে দূর থেকে যত ভাল লাগে কাছ থেকে কিন্তু আমার  ততটা ভাল লাগেনি।অবশ্য আমরা ভাসাভাসা দেখেছি। যারা লঞ্চে দুই তিনদিন থেকে দেখেছেন তারা নিশ্চয় আরও আনন্দ পেয়েছেন। আরও অনেক বেশি কিছু দেখেছেন। আমাদের ফেরার তাড়া ছিল।  ফেরার সময় নৌকায় বসে মোবাইলে  খবর পেলাম পাবনা মেডিক্যাল কলেজে আমার  বদলী হয়েছে। খবরটা আমার জন্য ছিল খুব স্বস্তিদায়ক। সাড়ে তিন বছর উপজেলা পর্যায়ে কাজ করে মেডিক্যাল কলেজে  পোস্টিং চাচ্ছিলাম। আল্লাহ্‌র রহমতে হয়েও গেল। এরপর মংলায় পৌঁছে সেখান থেকে বাসে  বাগেরহাট চলে গেলাম । ষাট গম্বুজ মসজিদ আর খানজাহান আলী (রঃ) এর মাজার  ঘুরে দেখলাম। তারপর এক অদ্ভুত বাসে চড়ে খুলনায় এলাম।সরাসরি চলে গেলাম ষ্টেশনে। নয়টার এক ট্রেনে  খুলনা থেকে  নাটোর আসলাম ভোররাতের দিকে। তারপর ভাল এক বাসে করে ফিরে এলাম আমার প্রিয় শহর  রাজশাহীতে। পেছনে রেখে এলাম অনেক  আনন্দের স্মৃতি । নদীর মাঝখানে ছোট নৌকার সেই দৃশ্য মনে হলে আজও একটু ভয় লাগে।যারা সুন্দরবন দেখেনি তারা দেখলে আনন্দ পাবেন এই ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই। যদিও বেশী সময় আর বেশী মানুষজন একসাথে গেলে  আরও বেশী মজা পাবেন  একথা বলাই বাহুল্য ।

কেএস/

                               

Leave a Comment