ফ্রান্সের প্রেরণাদাত্রী দেবী ( সেন্ট জোআন)

  • কামরুন নাহার স্মৃতি
  • মার্চ ৩০, ২০১৮

চতুর্দশ শতাব্দীতে ফ্রান্সে ভ্যালয় রাজবংশের রাজত্বকালে ইংল্যান্ডের সঙ্গে ফ্রান্সের একশো বছরের যুদ্ধ শুরু হল। ইংল্যান্ডের সিংহাসনে তখন রাজা পঞ্চম হেনরী (১৩৮৭ - ১৪২২)। অনেকগুলো যুদ্ধে ফরাসীদের হারিয়ে তিনি ফ্রান্স দখল করে নিলেন। ফ্রান্সের সিংহাসনে বসলেন তাঁর ছেলে ষষ্ঠ হেনরী (১৪২১ - ১৪৭১)। ফ্রান্সের সেই অন্ধকার দিনগুলিতে প্রদীপ হয়ে জ্বলে উঠল এক কৃষক বালিকা -- জোআন অভ আর্ক (ইংরেজীতে Joan of Arc, ১৪১২ - ১৪৩১)। "আবার আমরা স্বাধীন হব, তোমরা নিরাশ হয়ো না "-- ডেকে ডেকে মানুষকে জানাতে লাগল জোআন।

কৃষকের মেয়ে জোআন - সারাদিন মাঠে মাঠে ভেড়া চড়ানো তার প্রতিদিনের কাজ। ইংরাজ এসে, অন্য দেশের মানুষ এসে তার নিজের দেশ কেড়ে নিয়েছে --একথা ভাবলেই তার বুকের ভেতর টনটন করে উঠত। একদিন ভেড়ার পাল মাঠে ছেড়ে দিয়ে একটা গাছের গুঁড়িতে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে জোআন আপন মনে ভাবছে। ভাবছে তার নিজের দেশের কথা। এমন সময় তার মনে হল যে, তার সামনে যেন এসে দাঁড়ালেন তলোয়ার হাতে এক দেবদূত। সেই দেবদূত যেন জোআনের হাতে তলোয়ার তুলে দিয়ে তাকে বললেন --"সৈন্য নিয়ে যুদ্ধে যাও, ইংরাজের হাত থেকে ফ্রান্সকে স্বাধীন করার ভার নাও।"

তারপর মিলিয়ে গেলেন দেবদূত। নিষ্পাপ, সরল কৃষক - বালিকার মনে বিশ্বাস জন্মাল --সত্যিই দেবদূত এসেছিলেন, আর ভগবানের ইচ্ছের কথা তিনিই তাকে জানিয়ে গিয়েছেন। জোআন অনেক যোগাড়যন্ত্র করে ফ্রান্সের পলাতক রাজপুত্রের কাছে গিয়ে সৈন্য সাহায্যের প্রার্থনা জানাল - ভগবান তাকে ফরাসী দেশের স্বাধীনতা আনার ভার দিয়েছেন, সৈন্য পেলে সে বিদেশী শত্রুদের তাড়িয়ে দেবে। সামান্য একজন কৃষক বালিকা হলেও তাকে রাজা ফিরিয়ে দিলেন না। একটি সাদা ঘোড়া দিলেন আর দিলেন একটি সাদা নিশান। সৈন্যদের আদেশ দিলেন জোআনকে সাহায্য করতে। জোআনের কথা মিথ্যে হল না। তার নেতৃত্বে একদল সৈন্য ইংরাজ - অধিকৃত একটি শহর আক্রমণ করে সেটা দখল করে নিল। তারপর সে এক আশ্চর্য ঘটনা। জোআনের সৈন্যদল একটার পর একটা শহর দখল করে চলল। ক্রমাগত জয় হতে লাগল তাদের। ইংরাজ সৈন্যরা ভয় পেয়ে দলে দলে পালাতে লাগল।

কিন্তু একটা সামান্য গ্রামের মেয়ে যুদ্ধ করছে! শুধু যুদ্ধই করছে না, একের পর এক যুদ্ধে জয়লাভ করে চলেছে! ইংরাজ ভাবল এ তো মানুষ নয়! এ নিশ্চয় ডাইনী। ফরাসীদের সিংহাসনে আবার বসলেন ফ্রান্সের রাজা। জোআন কোন কিছুই চাইল না। তার স্বপ্ন সফল হয়েছে। রাজার মাথায় রাজ-মুকুট পরিয়ে দেবার সঙ্গেসঙ্গেই তার স্বপ্ন সার্থক হয়ে উঠেছিল। জোআন রাজসভায় এসে দাঁড়াল, এক হাতে খোলা তলোয়ার, অন্য হাতে সাদা নিশান।

ইংরাজ তাকে ভুলতে পারেনি। ফ্রান্সের রাজার এক শত্রু তাকে ইংরাজদের হাতে ধরিয়ে দিল। জোআনের বিচার হল। একজন পাদ্রি আর কয়েকজন বিচারক ছিলেন সেই সভায়। বিচারের নামে এক প্রহসন হল। সমবেতভাবে রায় দেওয়া হল : জোআন মানুষ নয়, সে ডাইনী । আর সে যুগে ডাইনী বলে সন্দেহ করা হত তাদের পুড়িয়ে মারা হত। জোআনেরও মৃত্যুদণ্ড হল। তাকে পুড়িয়ে মারা হবে। কিন্তু আশ্চর্য! একটু ও সে চোখের জল ফেলল না! বাজারের কাছে যেখানে অনেক লোকের যাতায়াত, সেইখানে একটা কাঠের খুঁটির সঙ্গে তাকে বেঁধে রাখা হল শক্ত করে। তার হাতে তুলে দেওয়া হল ভারী ক্রুশ। 

তারপর চারদিকে আগুন জ্বালিয়ে দিয়ে জীবন্ত অবস্থায় পুড়িয়ে মারা হল এই অসম - সাহসিকা মেয়েকে। বর্বর ইংরাজ সৈন্যরা সেই দৃশ্য দেখে উল্লাস করতে লাগল। মৃত্যুর সময় সে আকাশের দিকে তাকিয়ে প্রার্থনা জানাল ভগবানের কাছে। ভগবানের প্রতি বিশ্বাস সে কোনদিন হারায়নি। এই বিশ্বাসের জোড়েই সে অমন অসম্ভব কাজ করতে পেরেছিল। জোআনের মৃত্যুর পর ফরাসীরা ইংরাজদের এই বর্বরতার শোধ নিয়েছিল। ফ্রান্স থেকে চিরদিনের জন্য মুছে গেল ইংরাজ অধিকার। এখন জোআনকে বলা হয় সেন্ট জোআন-- কি না সাধ্বী জোআন। জোআন ছিল স্বাধীনতার পূজারিণী। সে ছিল পরাধীন ফ্রান্সের প্রেরণাদাত্রী দেবী। ঈশ্বরের নির্দেশে সে ক্ষুদ্র হয়েও মহান কাজ করতে পেরেছিল। বিশ্বাস আর বিশুদ্ধ স্বার্থহীনতার বলে সে সমগ্র ফ্রান্সকে উদ্ভুদ্ধ করেছিল। তার আদর্শ আজ সমস্ত পরাধীন দেশের মন্ত্র উঠেছে।

Leave a Comment