ভয়ংকর সুন্দর জলরাশি যারা মৃত্যুফাঁদ নিয়ে অপেক্ষা করছে!

  • ওমেন্সকর্নার ডেস্ক 
  • মে ৭, ২০১৮

পানির অপর নাম জীবন- এ কথা যেমন সত্যি, তেমনি পানির যে আনন্দেরই অপর নাম- এটিও বোধহয় মিথ্যা নয়। পানি দেখলেই আমাদের মন আঁকুপাঁকু করতে থাকে! ইচ্ছে হয় ঝাঁপিয়ে পড়তে। সেজন্য শীতের মৌসুমে কক্সবাজার আর সেন্ট মার্টিন্সে ভ্রমণ পিপাসুদের ঢল নামে! ক্যারিবিয়ান সমুদ্রের নীল, স্বচ্ছ পানিতে অবগাহন করার জন্য লাখো মানুষ ছুটে যায় প্রতিবছর! পানির টান এমনই প্রবল! এই প্রবল টানকে উপেক্ষা করার সাধ্য কার? তাই বলে যেখানে সেখানে পানি দেখলে ঝাঁপিয়ে পড়া কিন্তু বুদ্ধিমানের কাজ হবে না- তা সে যতই অপরূপ নদী, মায়াবী সমুদ্র উপকূল কিংবা মনোরম হ্রদই হোক না কেন। কেননা সেটিই হতে পারে জীবনের শেষ পানিতে অবগাহন। একবার নেমে পড়লে হয়তো সেখান থেকে আর কখনোই ফিরে আসবেন না। আজ ঠিক এমন কতগুলো জায়গা থেকে ঘুরে আসব আমরা।

রিও টিনটো নদী, স্পেন :

রিও টিনটো নদী

প্রাকৃতিক ভূ-দৃশ্যের জন্য স্পেন বিখ্যাত! সেই ভূ-দৃশ্যকে এক অতি মায়াবী, অপার্থিব রহস্যময় রূপ দান করেছে রিও টিনটো নদী। যদিও রিও-টিনটোর এই অপরূপ রূপ মানুষেরই অবদান। স্পেনের দক্ষিণ-পশ্চিমে আন্দালুসিয়ার উপর দিয়ে বয়ে গেছে এই নদীটি। ১০০ কিলোমিটার লম্বা রিও টিনটো নদীর চারপাশে রয়েছে মূল্যবান খনিজ সম্পদের মজুদ। সোনা, রূপা, তামাসহ আরো বহুবিধ খনিজ সম্পদের লোভে এই এলাকায় খনন চলছে বহু শতাব্দী আগে থেকে।

এখানে প্রথম খনন কাজ শুরু হয়েছিলো আজ থেকে ৩,০০০ বছর আগে! এই খনন কাজ যেমন স্থানীয় মানুষদের সম্পদশালী করেছে, তেমনি নদীকে দিয়েছে ভিন্ন এক রূপ। নানা রকম খনিজ পদার্থ মিশে জটিল রাসায়নিক বিক্রিয়ায় সৃষ্টি হয়েছে এক অপার্থিব লাল রঙ। এজন্য রিও টিনটোকেও কম মাশুল দিতে হয়নি। অসহনীয় অধিক মাত্রার অম্লত্বের কারণে তার স্বাভাবিক জলজ প্রাণীকুল একেবারেই বিলুপ্ত হয়ে গেছে। মাছ তো নেই-ই, নেই কোনো জলজ গাছপালাও।

সম্প্রতি বিজ্ঞানীরা জেরোসাইট নামে এক বিরল খনিজের উপস্থিতি শনাক্ত করেছে এখানে, মঙ্গল গ্রহে পাওয়া কিছু খনিজের সাথে যার অবিশ্বাস্য মিল। বুঝতেই পারছেন, এখানকার আবহাওয়া কতটা অপৃথিবীসুলভ, প্রাণহীন। তবে একেবারেই প্রাণহীন হওয়ার অপবাদ থেকে রিও টিনটোকে বাঁচিয়েছে একজাতের ব্যাকটেরিয়া। অতিরিক্ত তাপ সহ্যক্ষমতাবিশিষ্ট ব্যাকটেরিয়াগুলো এই পরিবেশেও দিব্যি মানিয়ে নিয়েছে। এরা অবাত শ্বসন প্রক্রিয়ায় শক্তি উৎপন্ন করে অর্থাৎ জীবনধারণের জন্য অক্সিজেন লাগে না। কারণ এরা খায় কী জানেন? নদীর তলদেশে জমে থাকা পাথরের গায়ের আয়রন এবং সালফাইড! ব্যাকটেরিয়ার কথা শুনে আর অপার্থিব রূপের মায়ায় রিও টিনটোর বুকে ঝাঁপিয়ে নিঃসন্দেহে বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। আর যদি ঝাঁপিয়ে পড়েনও, তাহলে হয়তো উঠে আসার সময় আপনার হাড়গুলোই অবশিষ্ট থাকবে শুধু।

ফুটন্ত হ্রদ, ডমিনিকা :

ফুটন্ত হ্রদ, ডমিনিকা

অসাধারণ সুন্দর দেখতে এই হ্রদে কেন আপনি সুইমস্যুট পরে লাফিয়ে পড়বেন না, তা নিশ্চয় শিরোনাম দেখে বুঝে গেছেন। ঠিকই ধরেছেন! এখানকার জল সর্বদা টগবগ করে ফুটছে। আয়তনের দিক থেকে দ্বিতীয় বৃহত্তম ফুটন্ত পানির লেক হলেও উত্তাপের দিক থেকে এটিই এক নাম্বার! ডোমিনিকার মরনে ট্রইস পিটন ন্যাশনাল পার্কে অবস্থিত এই লেকটির তাপমাত্রা ৮২-৯২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ভেতরে ওঠানামা করে।

যদিও এটি শুধুমাত্র লেকের বাইরের দিকের তাপমাত্রা। পার্কের ভেতরের তাপমাত্রা মাপার জন্য প্রয়োজনীয় বুকের পাটা কেউ করে উঠতে পারেনি। আপনিও নিশ্চয় অতি সাহসী হয়ে এমন কিছু করতে যাবেন না! এটুকু ভরসা তো রাখাই যায়, তাই না?

ডার্বিশায়ারের নীল লেগুন, যুক্তরাজ্য :

ডার্বিশায়ারের নীল লেগুন, যুক্তরাজ্য

লেগুন বলতে সাধারণত কোনো সমুদ্র উপকূলের নিকটে, অথচ সমুদ্র থেকে কোরাল প্রাচীর, ডুবো তট দ্বারা পৃথকীকৃত কোনো জলরাশি রোঝায়। আমরা এবার যে জায়গাটির কথা বলছি সেটি আসলে প্রাকৃতিক লেগুন নয়, বরং আদিতে এটি একটি খনিজ কোয়ারি ছিল। পরে যখন এটি বন্ধ করে দেওয়া হয়, তখন পানিতে প্লাবিত হয়ে একটি লেগুনে রূপ নেয়। গভীর নীল পানি, অপরূপ পরিবেশ- আপনার ইচ্ছে হবে সব ভুলে বেশ করে সাঁতার কাটতে পারলে দারুণ  হতো।

কিন্তু খবরদার! এ কাজটি ভুলেও করতে যাবেন না। কেন বলুন তো? ঠিকই ধরেছেন! এখানেও রয়েছে সেই বিষাক্ত খনিজের উপস্থিতি। বিষাক্ত খনিজের উপস্থিতি এই লেগুনকে স্বর্গীয় নীল রঙ দেওয়ার পাশাপাশি নারকীয় ক্ষারে ক্ষারিত করে রেখেছে! অ্যামোনিয়ার মতো ভয়ানক শক্তিশালী ক্ষারের ক্ষারত্ব যেখানে Ph  স্কেলে ১১.৫, সেখানে সেখানে এই লেগুনের পানির ক্ষারত্ব ১১.৩ এর চেয়েও বেশি। আশা করি এই তথ্যটি আপনাকে ডার্বিশায়ারের নীল লেগুনের নীল জলরাশি থেকে দূরে রাখার জন্য যথেষ্ট!

‘ঘোড়ার খুর’ হ্রদ, ক্যালিফোর্নিয়া :

‘ঘোড়ার খুর’ লেক, ক্যালিফোর্নিয়া

ক্যালিফোর্নিয়ার শাসটা কাউন্টির ল্যাসেন জাতীয় আগ্নেয় পার্কের কাছে রয়েছে সুন্দর ছিমছাম একটি হ্রদ। আকাশ থেকে দেখলে ঠিক যেন ঘোড়ার খুরের মতো মনে হয় হ্রদটিকে। আপাত শান্ত, স্বচ্ছ পার্কটির চারপাশে পাইনের ঝোপ, একপাশে পর্বত- শান্ত সমাহিত প্রান্তর। এই আপাত শান্ত পরিবেশের আড়ালে লুকিয়ে আছে হ্রদটির এক খুনে সত্ত্বা, যার করাল গ্রাসে মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়েছে আশেপাশের ১৭০ একর বনভূমি। মানুষও রক্ষা পায়নি এর ভয়াল থাবা থেকে। ১৯৯৮ সালে এক দুর্ভাগা হাইকার এখানে গিয়েছিলো ঘুরতে। ঘোড়ার খুর হ্রদের শিকার প্রথম মানুষ সে। ২০০৬ সালে এই হ্রদ একসাথে তিনজন মানুষকে টেনে নেয় মৃত্যুর কোলে।

কিন্তু কী সেই জিনিস যার হাত থেকে রক্ষা পায় না কিছুই- না মানুষ, না গাছপালা? এর রহস্য লুকিয়ে আছে হৃদের গভীর তলদেশে এক মৃত আগ্নেয়গিরির ভেতরে। যেখানে রয়েছে বিষাক্ত কার্বন ডাইঅক্সাইড আর হাইড্রোজেন সালফাইড গ্যাসের বিশাল মজুত, যার উদগীরণ আশেপাশে ডেকে আনে মৃত্যু তাণ্ডবলীলা।

কিভু হ্রদ, আফ্রিকা :

কিভু হ্রদ, আফ্রিকা

আফ্রিকার রুয়ান্ডা আর কঙ্গো প্রজাতন্ত্রের মাঝখানে কিভু হ্রদের অবস্থান। কঠিন পথ এটিকে দুর্গম করে রেখেছে। কিন্তু সে আর কী?  দুর্গম জায়গা যুগে যুগে মানুষকে আকর্ষণ করে এসেছে। তাই দুর্গমতা আসলে বিপদ নয়। বিপদ হলো এই হ্রদের নিচে লুকিয়ে থাকা কার্বন ডাইঅক্সাইডের পাশাপাশি মিথেন গ্যাসের বিশাল মজুদ।

আপনার মনে প্রশ্ন জাগতে পারে- মিথেন গ্যাস আছে তো হয়েছে কী? স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় মিথেন গ্যাস কোনোরকম ক্ষতি করে না। তা ঠিকই আছে, কিন্তু মিথেন যে একটি দাহ্য পদার্থ সেটিও নিশ্চয়ই জানেন। আর এই এলাকায় অসংখ্য আগ্নেয়গিরির অবস্থান, যাদের বড় অংশই সুপ্ত আগ্নেয়গিরি, যেগুলো যেকোনো সময় বিস্ফোরিত হতে পারে! আর সেই বিস্ফোরণ যদি কোনোভাবে এই মিথেন গ্যাসের সন্ধান পায়, তাহলে ব্যাপারখানি কী হবে ভেবে দেখেছেন? আশেপাশের জায়গাগুলো মুহূর্তে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। সুতরাং আপনি কিভু হদের দিকে রওনা দেওয়ার আগে এটা মাথায় রাখবেন, আপনি আসলে একটি টাইম বোমের উপর সাঁতার কাটতে যাচ্ছেন, যার সুইচটা আপনার হাতে নেই!

কারাচে হ্রদ, রাশিয়া :

কারাচে হ্রদ, রাশিয়া

আমরা এতক্ষণ যে সকল জায়গায় ঘুরে এসেছি তার কোনোটাতে বয়ে চলেছে বিষাক্ত পানির ধারা, কোনোটাতে উত্তপ্ত পানি আবার কোনোটাতে রয়েছে মারণ গ্যাসের মজুদ। কিন্তু এবার এমন একটি হ্রদের খোঁজ পাওয়া গেলো, যাতে রয়েছে তেজস্ক্রিয়তা। রাশিয়ার উরাল পর্বতমালায় অবস্থিত এই লেকের পানি তেজস্ক্রিয়তায় পরিপূর্ণ। হ্রদের কাছেই মায়াক প্রোডাকশন অবস্থিত, যারা কিনা এখানে প্লুটোনিয়াম উৎপাদন করতো। সেই সাথে এরা তেজস্ক্রিয় স্ট্রনসিয়াম এবং সিজিয়াম নিয়েও কাজ করতো, যা কারাচের পানিতে মিশে যায়। এর সাথে যুক্ত হয় ১৯৮৬ সালের চেরনোবিল দুর্ঘটনা। কারাচে হ্রদের পানিতে এতটা তেজস্ক্রিয়তা মিশে আছে যে, এই লেকে কেউ যদি একঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকে, তাহলে ভবলীলা সাঙ্গ করার জন্য পর্যাপ্ত তেজস্ক্রিয়তা তার শরীরে জমা হবে।

সূত্র : roar

Leave a Comment