লায়লি-মজনু : বিরহে পূর্ণতা পাওয়া অমর প্রেম-উপাখ্যান

  • তন্ময় আলমগীর
  • অক্টোবর ৩১, ২০১৮

শেক্সপিয়ারের রোমিও-জুলিয়েট বিশ্বে যতটা বিখ্যাত, উপমহাদেশে লায়লি-মজনু কিন্তু আসলে ততটাই নামকরা, হয়ত আরো বেশি। কিন্তু রোমিও-জুলিয়েট যত বেশি পঠিত বা চিত্রিত হয়েছে আর মানুষের মনে গেঁথে গেছে কাহিনীটুকু, লাইলি-মজনুর ক্ষেত্রে আসলে ততটা হয়নি। কীভাবে লায়লি-মজনুর প্রেমের শুরু, কী তার পরিণতি- সে খুঁটিনাটিগুলো সম্পর্কে জানেন না অনেকেই।

আরবের বনু আমির বেদুইন গোত্রের এক মহান শাসক ছিলেন সায়িদ। ধন-দৌলত তার এতটাই বেশি ছিল যে, তাকে আরবের ধনাঢ্য সুলতানদের একজন বিবেচনা করা হতো। হাতেম তাঈ এর মতোই তার দানশীলতা আর প্রজাবাৎসল্যের কথা দিগ্বিদিক ছড়িয়ে পড়ে। ঘর আলো করে তার স্ত্রী জন্ম দিলেন এক পুত্রসন্তান। মুক্তোর মতো ত্বক, গালগুলো যেন গোলাপ দিয়ে রাঙানো। তার শরীর থেকে আলো বেরিয়ে যেন ঘর আলোকিত করে ফেলছে। মনের আনন্দে শিশুর বাবা তার ধনসম্পদ বিলাতে শুরু করলেন। প্রজাদের মনেও আজ আনন্দ। শিশুর যত্নে একজন দক্ষ পালিকাও রাখা হলো। প্রতি মুহূর্তে যেন তার উপর নজর রাখা হয়। বদনজর থেকে রক্ষার জন্য তার চেহারায় টিপ দিয়ে দেয়া হলো। দু'সপ্তাহের মাথায় শিশুটির নাম রাখা হলো কায়েস। বাবার নাম আল-মুলাওয়াহ হওয়াতে শিশুটির পুরো নাম হলো কায়েস ইবন আল-মুলাওয়াহ।

তাকে মক্তবে পাঠানো হলো পড়ালেখার জন্য। শীঘ্রই মক্তবের সেরা ছাত্র হয়ে উঠল কায়েস। মক্তবে শুধু ছেলেরাই পড়তো না, মেয়েরাও পড়তো। একসাথেই পড়ত তারা। বিভিন্ন গোত্রের সম্ভ্রান্ত সব পরিবার থেকে মেয়েরা পড়তে আসত। কিন্তু একদিন নতুন এক মেয়ে এসে যোগ দিল তাদের সাথে। কায়েসের মনে হলো, এত সুন্দর মেয়ে সে আগে দেখেনি কখনো। তাদের বয়স অবশ্য তখনো দশও পেরোয়নি। মেয়েটির নাম লায়লা, বাংলায় যার মানে 'রাত্রি'। লায়লা আল-আমিরিয়া (কিংবা, লায়লা বিনতে মাহদি)। লায়লা যেন উলুবনে ছড়ানো এক মুক্তা। সাইপ্রাস গাছের মতো ছিপছিপে দেহ। মায়াকাড়া হরিণীর মতো তার চোখজোড়া। 

তার এক অলস দৃষ্টিতেই যেন হাজারো হৃদয় ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। সত্যিই, কাজল দেয়া লায়লার চোখের এক পলক যেন পুরো দুনিয়াকে করে দিতে পারে ছারখার। তার লাস্যময়ী চেহারা যেন আরবের আকাশের চাঁদ, কিন্তু হৃদয় ছিনিয়ে নেয়ার বেলায় সে যেন পারস্যের ডানাকাটা পরী। ঘন কালো চুলের খোপে তার মুখ যেন প্রদীপের মতো উজ্জ্বল, কাকের মতো কালো সেই চুল যেন তার রাত্রিময় নামই মনে করিয়ে দেয়। আর কোকিলের কন্ঠে যখন লায়লার কথা শোনা যায়, তখন মনে হয়, এ-ও কি সম্ভব? এত সুন্দর হতে পারে কারো কণ্ঠ? তবে তো সূর্যও পশ্চিম দিক দিয়ে ওঠা খুব সম্ভব। যে দুধে সে চুমুক দেয়, সেটিও যেন গোলাপী হয়ে ওঠে তার ঠোঁটের পরশে। কে সেই ভাগ্যবান মানুষটি যে কি না পাবে টানা টানা কামনার চোখের এ মেয়েটিকে, যার গালের ঐ ছোট তিলটিও যেন পুরো দুনিয়ার যেকোনো কিছু থেকে সুন্দর? শুধু সুন্দর না, অসম্ভব সুন্দর।


লায়লি-মজনু
 

তখন থেকেই কায়েস সুন্দর সুন্দর কবিতা লেখা শুরু করল লায়লাকে নিয়ে, আর রাস্তায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সে সেই কবিতা আবৃত্তি করতে থাকত। কেউ শুনতে না চাইলে পারলে যাকে তাকে দাঁড়া করিয়ে শোনাতো। এককথায় পুরো পাগল হয়ে গেল লায়লার জন্য। লোকে তাকে কায়েস না ডেকে তাই ডাকতে লাগলো 'মাজনুন' বা দিওয়ানা, পাগল। বাংলায় আমরা বলি, মজনু। একদিন মজনু গিয়ে লায়লার বাবার কাছে গিয়ে লায়লাকে বিয়ে করতে চাইলো। কিন্তু লায়লার বাবা সাথেই সাথেই না করে দিল। এ ছেলের কাছে বিয়ে দেয়াই হবে অপমানের ব্যাপার, লোকে একে মজনু ডাকে, পাগল ডাকে। পাগলের কাছে বিয়ে দেবেন নিজের মেয়েকে?

লায়লাও  কিন্তু এ পাগল ছেলেটিকে প্রচন্ড  ভালোবাসত। তিনি নিজের মেয়ের বিয়ে ঠিক করলেন পাশের গ্রামের এক বয়স্ক লোকের সাথে। রাগে, দুঃখে আর শোকে মজনু তার পরিবার ত্যাগ করল, জঙ্গলে চলে গেল। সেখানে গিয়ে হিংস্র জীবজন্তুর সাথে দিন কাটাতে লাগলো। সেখানে বসে বসেই সে লায়লাকে নিয়ে তার কবিতা লিখত। লায়লাকে জোরপূর্বক বিয়ে করতে হলো সেই বুড়ো লোকটিকে। ঘর-সংসার সে করতে থাকলো বটে, কিন্তু বুড়ো মন পায়নি তার। মন তার মজনুর জন্যই কাঁদত। কিন্তু সম্ভ্রান্ত ঘরের মেয়ে হিসেবে ভালো মেয়ে সেজেই স্বামীর ঘর করতে থাকলো লায়লা। লায়লার বিয়ের খবর মজনুর কাছে যখন পৌঁছালো, সে আরো পাগল হয়ে গেল। তখনও সে বাবা-মায়ের কাছে ফিরতে নারাজ। তার বাবা-মা প্রতিদিন তার জন্য খাবার সাজিয়ে রাখত বাগানবাড়িতে, এই আশায় যে একদিন তাদের ছেলে ফিরে আসবে। কিন্তু মজনু রয়ে গেল জঙ্গলেই।

মাঝে মাঝে কিছু পথিক দেখা পেত মজনুর, তারা জানাতো মজনু একা একাই কবিতা আবৃত্তি করে, বালুতে কাঠি দিয়ে কবিতা লিখে। লায়লার কারণে ভেঙে পড়েছে পুরোই। বহু বছর পর, মজনুর বাবা-মা দুজনেই মারা গেল। লায়লা নিজে সে খবর পাঠাতে চাইলো মজনুর কাছে, কিন্তু কাকে দিয়ে পাঠাবে? এক বুড়ো লোককে ধরে রাজি করালো সে। বুড়ো রাজি হলো, যদি পরে কোনোদিন দেখা পায় মজনুর, তবে জানিয়ে দেবে। একদিন যখন আসলেই মজনুর দেখা পেল বুড়ো, তখন জানালো তার বাবা-মায়ের মারা যাবার খবর। দুঃখে ভারাক্রান্ত মজনু কোনোদিন শহরে ফিরবে না মৃত্যুর আগে সে কসম কাটলো। কয়েক বছর পর, লায়লার স্বামী মারা গেল। তখন লায়লা আশা করছিল, অবশেষে সে তার মনের মানুষের সাথে মিলিত হতে পারবে। আমৃত্যু কাছে থাকতে পারবে দুজনে। কিন্তু বেদুইন রীতি বলে, বিধবাকে অন্তত দু'বছর ঘর থেকে বের না হয়ে শোক পালন করতে হবে। কীভাবে আরো দু'বছর মজনুকে না দেখে থাকবে লায়লা? তার অনুভব হচ্ছিল, পুরো এক জীবন মজনুকে না দেখে আছে সে, কীভাবে আরো দু'বছর পারবে? সেই দুঃখে লায়লা মারা গেল নিজের বাড়িতেই।

লায়লার মৃত্যুর খবর বনে জঙ্গলে থাকা মজনুর কাছে পৌঁছালো। সাথে সাথেই সে লায়লার কবরের জন্য রওনা দিল। সেখানে পৌঁছে সে কাঁদতেই থাকলো, যতক্ষণ পর্যন্ত না মৃত্যু তাকেও হরণ করল। লায়লার কবরের ওপর পড়ে রইল মজনুর নিথর দেহ। ব্রিটিশ কবি বায়রন লায়লি-মজনুর কবিতাকে প্রাচ্যের 'রোমিও-জুলিয়েট' আখ্যায়িত করেন। তবে এই কবিতা লেখার অনেক আগে থেকেই, প্রায় নবম শতক থেকেই উপকথা আকারে এ গল্প ছোট ছোট রূপে মানুষের মুখে মুখে বেড়াত, আর ইরানি 'আখবার'-এ, সেটিকেই কবিতায় রূপ দেন নিজামি, এ কাজের জন্য তিনি সবগুলো মৌখিক উপকথা সংগ্রহ করেছিলেন। এরপর নিজামির কবিতা অবলম্বনে আরো অনেক ফার্সি কবি তাদের নিজেদের সংস্করণ রচনা করেন এ ঘটনার; যেমন আমির খসরু দেহলভী (১২৯৯), জামি (১৪৮৪) প্রমুখ। মক্তবি শিরাজি, হাতেফি আর ফুজুলির সংস্করণগুলো বরং তুরস্ক আর ভারতীয় উপমহাদেশে জনপ্রিয় হয়। ইরানে লায়লি-মজনুর ৫৯টি সংস্করণ পাওয়া যায়, আর ওদিকে শিরি-ফরহাদের ৫১টি ও ইউসুফ-জুলেখার ১৬টি সংস্করণ আছে।

ভারতে এমন উপকথাও প্রচলিত আছে যে, লায়লি-মজনু মারা যায়নি, বরং রাজস্থানে চলে আসে, সেখানেই তারা মৃত্যু পর্যন্ত ছিল। বিশ্বাস করা হয়, লায়লি-মজনুর মাজার রাজস্থানের অনুপগড়ে। কিছু কিছু সংস্করণে বেশ রক্তপাতও দেখা যায়। যেমন, একটি সংস্করণ বলছে, মজনু মার খেত যখনই, তখন লায়লারও রক্ত ঝরত জাদুবশে। এমনকি লায়লাকে বিয়ে করতে লায়লার ভাই তাবরেজকে খুন করেছিল, কারণ তাবরেজ এ বিয়ের ঘোরবিরোধী ছিল। এ খুনের জন্য পাথর নিক্ষেপে মৃত্যুদণ্ড হয় মজনুর, তাই মজনু পালিয়ে গিয়েছিল। আবার লায়লার প্রেমের কথা জানবার পর মজনুকে মারবার জন্য লায়লার স্বামী জঙ্গলে যায়, সেখানে তারা দ্বন্দ্বযুদ্ধ করে। যখন লায়লার স্বামী মজনুর বুকে তলোয়ার ঢুকিয়ে দেয়, তখন ঘরে বসা লায়লা ঢলে পড়ে মাটিতে। দুজনে একইসাথে মারা যায়, এবং পাশাপাশি কবর দেয়া হয়। কথিত আছে, দুজনের বাবা তাদের জন্য প্রার্থনা করেন। উপকথা অনুযায়ী, তারা দুজন বেহেশতে মিলিত হবে, সেখানেই তাদের বিবাহ হবে এবং চিরকাল সুখে শান্তিতে কাটিয়ে দেবে।

Leave a Comment