অদ্ভুত ক্ষমতাধর রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথ

  • ওমেন্সকর্নার ডেস্ক
  • নভেম্বর ১৪, ২০১৮

পৃথিবীতে সবচে সুখী মানুষ বোধ হয় সেই ব্যক্তি, যার কোন কাজে কেউ অভিযোগ তুলতে পারে না, যিনি নন কারো কাছে বাধ্যবাধক। এমন মানুষ কি আছে? এই যুগে হয়তো শতভাগ এমন ব্যক্তির সন্ধান মিলবে না। তবে ব্রিটেনের রানী এলিজাবেথ হলেন সেই মাপের মানুষ। শুধু ব্যক্তি না, ব্রিটিশ সরকার যখন কোনো যুদ্ধ ঘোষণা করে, বা কোনো চুক্তি সই করে, তার কর্তাব্যক্তিত্ব সেখানে অবশ্যই থাকতে হয়। যদিও একজন রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে তার ভূমিকা প্রায় পুরোটাই আনুষ্ঠানিক এবং তার থাকা অনেক 'বিশেষ ক্ষমতা' এখন ধীরে ধীরে মন্ত্রী পরিষদের হাতে চলে যাচ্ছে। এ ছাড়াও তার রয়েছে বিভিন্ন অদ্ভুত অদ্ভুত ক্ষমতা, যেগুলো হয়তো পৃথিবীর আর কোনো রাষ্ট্রপ্রধানেরই নেই৷  জেনে নেয়া যাক ব্রিটেনের রানীর অদ্ভুত কিছু ক্ষমতা-

রানীর প্রয়োজন হয় না কোনো পাসপোর্টের : পাসপোর্ট ছাড়া এক দেশ থেকে অন্য দেশে অবস্থান আইনগতভাবে অবৈধ। কিন্তু রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথ এ ক্ষেত্রে ভিন্ন। বৃটেনের রাজপরিবারের সবারই পাসপোর্টের প্রয়োজন হয়, একমাত্র পাসপোর্ট লাগে না তার।  পাসপোর্ট ছাড়াই তিনি ঘুরে বেড়াতে পারেন দেশ থেকে দেশান্তরে।

রানী অস্ট্রেলিয়ার সরকারকে বহিষ্কার করার ক্ষমতা রাখেন : অস্ট্রেলিয়ার রাষ্ট্র প্রধানের ক্ষমতা রানীর হাতে।এই পদাধিকার বলে অস্ট্রেলিয়ার সরকারের ওপর রানীর বেশ কিছু ক্ষমতা রয়েছে। ১৯৭৫ সালে অস্ট্রেলিয়ায় রানীর প্রতিনিধি গভর্নর জেনারেল স্যার জন কের তৎকালীন অস্ট্রেলিয়ান প্রধানমন্ত্রীকে বহিষ্কার করে দিয়েছিলেন মাত্র ৩ ঘণ্টার ব্যবধানে। এরপর নতুন করে নির্বাচন হয়ে নতুন সরকার গঠিত হয়ে। তৎকালীন সরকার অর্থনৈতিকভাবে ধসে পড়ছিল বলে এমনটা করা হয়েছিল তখন।কানাডা, জ্যামাইকা, নিউজিল্যান্ড, পাপুয়া নিউ গিনি, অস্ট্রেলিয়া এবং যুক্তরাজ্য ছাড়াও রানী আরো ১৪টি রাষ্ট্রের প্রধান।  এগুলোকে বলা হয় কমনওয়েলথ রাষ্ট্র। ৫৩টি সদস্য দেশ দ্বারা তৈরি সংগঠন 'কমনওয়েলথ অফ নেশনস' এবং এই কমনওয়েলথ রাষ্ট্র এক নয়। কমনওয়েলথ রাষ্ট্র শুধু ব্রিটেনের রাজতন্ত্রের অধীনে থাকা রাষ্ট্রগুলোকেই বলা হয়।   

বৃটেনের সব ডলফিনের মালিকানা তার : রাজা দ্বিতীয় এডওয়ার্ড ১৩২৪ খ্রিস্টাব্দে অাইন জারি করেন যে,  বৃটেনের রাজতন্ত্রের প্রধান দেশের সব স্টার্জন (একপ্রকার মাছ), তিমি এবং ডলফিনগুলোর মালিক। এই আইনটি এখনো বেশ শক্তভাবেই ঠিকে অাছে। যুক্তরাজ্যের সমুদ্রধারের তিন মাইলের মধ্যে যদি কোনো ডলফিন বা তিমি ধরা পড়ে, সেগুলোকে গ্রহণ করার জন্য রানীকে অনুরোধ করা হয়।

টেমস নদীর সব রাজহাঁসও রানীর মালিকানাধীন : বৃটেনের জলাশয়ের সব রাজহাঁসই প্রকৃতপক্ষে রানীর মালিকানাধীন। কিন্তু রানী তিনি এই ক্ষমতা শুধুমাত্র টেমস ও তার শাখানদীগুলোর ক্ষেত্রেই প্রয়োগ করেন। বৃটেনে প্রতি বছর রাজহাঁসদের নিয়ে সোয়ান আপিং নামের একটি রাজকীয় অনুষ্ঠান হয়। যেখানে টেমস নদীর সব রাজহাঁসকে ধরে তাদের রাজকীয় রাজহাঁস হিসেবে চিহ্নিত করে আবার ছেড়ে দেয়া হয়। 

রানী গাড়ি চালাতে পারেন কোনো লাইসেন্স ছাড়াই : সারা ব্রিটেনে রানীই একমাত্র ব্যক্তি, যার গাড়ি চালাতে কোনো লাইসেন্সের প্রয়োজন হয় না। লাইসেন্স না থাকলেও গাড়ি চালাতে রানী বেশ দক্ষ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তিনি একটি ফার্স্ট-এইড ট্রাক চালিয়েছিলেন উইমেন্স অক্সিলিয়ারি টেরিটরিয়াল সার্ভিসের জন্য। উইমেন্স অক্সিলিয়ারি টেরিটরিয়াল সার্ভিস তখন ছিল ইংল্যান্ডের নারীদের জন্য পৃথক সেনাবাহিনীর স্বরূপ। এই সেনাবাহিনীর অংশ হিসেবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল রানী এলিজাবেথের।  

রানীর অাছে একজন ব্যক্তিগত কবি : এতকিছু আছে, অথচ একজন কবি থাকবে না তা কি হয়? না হয় না। তাই রানীর আছে একজন ব্যক্তিগত রাজকীয় কবি। রানী কবিকে মনোনয়ন দিতে পারেন তার ব্যক্তিগত কবি বা পোয়েট লরিয়েট হিসেবে। সেই কবি হবেন এমন একজন কবি, যার কাজের রয়েছে জাতীয় তাৎপর্য। মজার ব্যাপার হলো, এই কবির সম্মানী দেয়া হয় একটি বিশেষ ধরনের ওয়াইন দিয়ে। বর্তমানে ক্যারল অ্যান ডাফি আছেন এই পদে এবং থাকবেন আগামী বছর পর্যন্ত।

রানী একটি ধর্মের প্রধান ধর্মগুরু : ষোড়শ দশকে রাজা সপ্তম হেনরি রোমান ক্যাথলিক চার্চ থেকে ব্রিটেনকে পৃথক করে ফেলেন এবং ‘চার্চ অব ইংল্যান্ড’ হয় ব্রিটেনের রাষ্ট্রীয় ধর্ম। বর্তমানে সেই চার্চ অব ইংল্যান্ডের প্রধান হচ্ছেন রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথ, এবং তিনি চার্চের জন্য বিশপ এবং আর্চবিশপদের মনোনয়নও দিয়ে থাকেন।  এই নিয়মটির অবশ্য খুব মজার একটি পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আছে। এই নিয়মের কারণে ব্রিটিশ রাজতন্ত্রের যেকোনো প্রধানকেই অবশ্যই চার্চ অব ইংল্যান্ডের অনুসারী হতে হয়। অন্য কোনো ধর্মের মানুষ ব্রিটেনের রানী বা রাজা হতে পারবেন না, এমনকি ক্যাথলিক হলেও না। যেমন প্রিন্স চার্লস এখন যদি ধর্মান্তরিত হয়ে মুসলমান হয়ে যান, রানী এলিজাবেথের উত্তরসূরী তিনি আর হতে পারবেন না।    

আদালতে অভিযুক্ত করার ক্ষমতা কারো নেই : ব্রিটেনের আদালতের যেকোনো বিচারকার্য রানীর নামেই সম্পন্ন করা হয় বিধায় রানীকে অভিযুক্ত করা বা সাক্ষী দিতে বাধ্য করার ক্ষমতা কারো নেই। তাত্ত্বিকভাবে, রাজতন্ত্রের প্রধানের পক্ষে কোনো অপরাধ করা সম্ভব নয়। তবে এই ক্ষমতা সম্পর্কে ২০০২ সালে ব্যারিস্টার হেলেনা কেনেডি বিবিসিকে বলেছিলেন, “রানীর এই ক্ষমতা অবশ্যই প্রশ্নের উর্ধ্বে নয়।”

যেকোনো আইন পার্লামেন্টে গৃহীত হতে রানীর সম্মতি অত্যাবশ্যক : যেকোনো বিলকে পরিপূর্ণ আইনে পরিণত করতে অবশ্যই রানীর সম্মতি থাকা বাধ্যতামূলক। একটি প্রস্তাবিত আইন ব্রিটেনের দু'টি পার্লামেন্টেই পাস হবার পর তার পরবর্তী গন্তব্য হয় রাজপ্রাসাদে। সেখানে অনুমোদন পেলেই তা আইন হিসেবে গৃহীত হয়। ব্যাপারটির আনুষ্ঠানিক নাম ‘রয়েল অ্যাসেন্ট’ বা রাজকীয় সম্মতি। তবে এই রয়েল অ্যাসেন্ট দিতে সাধারণত কোনো রাজা-রানীই কার্পণ্য করেন না। এ ছাড়াও রানীর আরেকটি সম্মতি দেওয়ার জায়গা আছে, তার নাম ‘কুইন্স কনসেন্ট।’ কোনো আইন যদি বৃটেনের রাজতন্ত্রকে কোনোভাবে প্রভাবিত করে, তবে সেই আইন পার্লামেন্টে বিল হিসেবে তোলার আগেই রানীর সম্মতি নিতে হয়। এখন পর্যন্ত এই নিয়মটির প্রয়োগ হয়েছে ৩৯ বার।
এমন সব অদ্ভুত অদ্ভুত ক্ষমতাগুলোই তার ব্যক্তিত্বকে দিয়েছে স্বকীয় এক রাজকীয়তা, যার কারণে সমগ্র পৃথিবী তাকে দেখে শ্রদ্ধার দৃষ্টিতে।
 

Leave a Comment