১৩ কেজি ওজনের চেরাগ আলীর সংগ্রামী জীবন

  • ওমেন্সকর্নার ডেস্ক
  • নভেম্বর ১৪, ২০১৮

দেশের সবচেয়ে কম ওজনের মানুষ সিলেটের বিশ্বনাথ উপজেলার রামপাশা ইউনিয়নের চকরামপ্রসাদ গ্রামের মৃত আবদুল হামিদ ও মৃত টেকার মা দম্পতির সন্তান চেরাগ আলী কটু। তাঁর উচ্চতা ৩২ ইঞ্চি, ওজন মাত্র ১৩ কেজি। ৬০ বছর বয়স্ক চেরাগ আলী কটু মিয়া পাঁচ সন্তানের জনক। বর্তমানে তিনি সাত সদস্যের পরিবার নিয়ে দিন কাটাচ্ছেন অর্থনৈতিন দৈন্য-দশায়।

চেরাগ আলী কটু নিজের জমিজমা বিক্রি করে ভাগ্যের চাকা ঘুরানোর জন্য পাড়ি দিয়েছিলেন প্রায় ১২ বছর আগে স্বপ্নের দেশ লন্ডনে। কিন্তু তার ভাগ্যের পরিবর্তনের সুযোগ থাকা সত্ত্বেও এক প্রবাসী লন্ডনির কারণে প্রতারিত হন তিনি। ৩২ ইঞ্চি উচ্চতার এই মানুষ তার দীর্ঘ জীবনে বাবার রেখে যাওয়া পারিবারিক কৃষিসম্পদ রক্ষণাবেক্ষণ এবং চাষাবাদ করেছেন। কৃষিকাজ ছাড়া এর আনুসাঙ্গিক যেমন জমিতে সেচ দেওয়া এই জাতীয় ছোটখাটো কাজ করতে বেশ পারদর্শী চেরাগ আলী কটু।

পরিবারের সাত সদস্যদের বিশাল সংসার কৃষিজমি থেকে প্রাপ্ত ফসল দিয়ে চালানো বেশ কঠিন। বর্তমানে একমাত্র বসতভিটাটিই তাঁর মূল সম্বল। চেরাগ আলীর একমাত্র পুত্র জাহেদ আহমদ (১৯) চায়ের দোকানে কাজ করে। ছেলের উপার্জিত টাকা দিয়ে তাদের সংসার কোনোভাবে চলছে। পরিবারের দুইবেলা দুমুঠো ভাত জোগাড়ের ব্যবস্থা না হওয়ায় নিকটাত্মীয়রা নিয়মিত সহযোগিতা করায় কোনোমতো বেঁচে আছে চেরাগ আলীর পরিবার।

১৯৯৬ সালে চল্লিশ বৎসর ছুঁইছুঁই চেরাগ আলীর বিয়ের স্বাদ জাগলেও খাটো হওয়ার কারণে পাত্র পছন্দ না হওয়ায় বিয়ে করতে পারছিলেন না চেরাগ আলী। এ সময় লন্ডনের এক প্রবাসী চেরাগ আলীকে লোভ দেখান ভিজিট ভিসায় লন্ডন নিয়ে যাবার। অচেনা-অজানা দেশে চেরাগ আলী যেতে রাজি না হওয়ায় ধোঁকা দেওয়া হয় বিয়ের প্রলোভন দিয়েই। কনেকে দেখে পাত্রের পছন্দ হলেও পাত্র দেখে পাত্রীর কোনো অবস্থায় পছন্দ হয়নি। এ সময় চতুর প্রবাসী আতিক মিয়ার বাড়িতে পিতামাতাহীন ৬৪ ইঞ্চির সুন্দরী জরিনা বেগম (২২) কে লোভ দেখায় চেরাগ আলীকে বিয়ে করলে সহজেই লন্ডনে যাওয়া যাবে। এর সাথে ছিল মানসিক ছাপ। তাই বাধ্য হয়েই ৬৪ ইঞ্চির সুন্দরী জরিনাকে ৩২ ইঞ্চির কালো চেরাগ আলীর সাথে বিয়ের পিড়িতে বসতে হয়।

চেরাগ আলী কটু জানান, তার পিতার রেখে যাওয়া জায়গা জমি বিক্রি করে লন্ডনপ্রবাসী আতিক মিয়া নামের এক ভণ্ড প্রতারকের ফাঁদে পড়ে স্বপ্নপূরণের আশায় পাড়ি দেন লন্ডনে। লন্ডনের বৃহত্তর ম্যানচেস্টার এলাকায় সম্ভবত আজিজ মিয়ার মালিকানাধীন রেস্তোরাঁতে কাজ হয় চেরাগ আলীর। রেস্তোরাঁর প্রধান ফটকে বিলিতি পোশাক পরে আতিক মিয়ার শিখানো ইংরেজি ভাষা হায় হ্যালো বলে রেস্তোরাঁয় খেতে আসা সাদাচামড়ার পুরুষ ও মহিলাদের অভিবাদন জানানোই ছিল তার প্রধান কাজ। আর এতে সাদা রঙের মানুষগুলো চেরাগ আলীর হায় হ্যালোতে মুগ্ধ হয়ে এক পাউন্ড দুই পাউন্ড করে টিপস দিত। অনেকেই আরো বেশি দিত। রেস্তোরাঁয় আসা কোনো খরিদ্দারের কাছ থেকেই খালি হাতে ফিরতে হয়নি চেরাগ আলীকে।

কাজ ছাড়া আর কোনকিছু করতে পারত না চেরাগ আলী। কাজ শেষে কোথাও বাইরে যাওয়া কিংবা কারো সাথে কথা বলা বন্ধ করার জন্য আতিক মিয়ার এক ছেলে কড়া নজরে রাখত তাকে। অন্যদিকে টিপসের টাকা যাতে চেরাগ আলী সরাতে না পারে সে জন্য রেস্তোরাঁর ভেতর ও বাইরে লাগানো হয় সিসিটিভি ক্যামেরা। প্রতিদিন কাজ শেষে টিপসের সব টাকা আতিক মিয়ার লোকজন নিয়ে যেত। এভাবে কাটে দীর্ঘ প্রায় ১৫ মাস।  আতিক মিয়া দেশি-বিদেশি লোকদের কাছ থেকে টিপস নিয়ে কয়েক লাখ টাকা কামিয়ে নিলেও দেশে থাকা চেরাগ আলীর পরিবার-পরিজনদের জন্য একটি টাকাও পাঠায়নি। বরং এই দীর্ঘ ১৫ মাস পর কোনো টাকা পয়সা ছাড়াই অনেকটা জোর করে চেরাগ আলীকে দেশে পাঠায় প্রতারক আতিক মিয়া।

তিনি বলেন, সন্তানদের ভবিষ্যতের কথা ভেবে আতিক মিয়ার মিষ্টি কথায় মুগ্ধ হয়ে প্রচুর জায়গা জমি বিক্রি করে স্বপ্নের দেশ লন্ডনে পাড়ি জমালেও স্বপ্ন ভঙ্গ হয়। সপ্তাহের মজুরি ও বিলিতিদের টিপস স্বপ্ন দেখাতে শুরু করে চেরাগ আলীর। কিন্তু ভণ্ড প্রতারক আতিক মিয়া সব অর্জন লুটে নিলে শূন্য হাতে ফিরতে হয়েছে দেশে। বর্তমানে বয়সের ভারে নিজের কাজই ঠিক মতো করতে পারছেন না তিনি।

Leave a Comment