দশটি পরিচিত ভয় ( শেষ পর্ব )

  • মারুফ ইমন
  • মার্চ ২৪, ২০১৯

আগের পাঁচটির বাইরে কিছু ভয় আছে যেগুলো আমরা চাইলেও এড়িয়ে যেতে পারি না। মনোবিদরা প্রায় ৭২ রকমের ভয়কে বর্তমান সময়ে চলমান বললেও এর বাইরেও কিছু আছে যা জেনেটিক কারনে কিংবা এলাকাভিত্তিক প্রভাবে রয়ে গেছে ওই এলাকার মানুষের মাঝে। সেসবের আগে আমরা বাকি পাঁচটি ফোবিয়া নিয়ে কথা বলি।

অ্যাস্ট্রাফোবিয়াঃ আকাশে হঠাৎ বিদ্যুত চমকালে 'ওরে বাবা’'বাবা গো’'মা গো’বলে কোথাও গুটিসুটি হয়ে বসে পড়া লোকগুলোর অনেকেই এই ভয়ে আক্রান্ত। চোখের সামনে বজ্রপাতে মৃত্যু দেখা একজন কে দেখতাম আকাশে একটু মেঘ ডাকলেই ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়তো বা কোণায় বসে  থাকতো। অন্যান্য ভয়ের মত এখানেও শরীর কাঁপে, কথা বলতে আটকায় বা হার্টবিট বেড়ে যায়। সাধারনত এইসব রোগীরা খুব আবহাওয়া সচেতন হয় এবং রেডিও টিভিতে খোঁজ রাখার চেষ্টা করে কোন বজ্রপাতের সম্ভাবনা আছে কিনা। উপকূলীয় মানুষের মাঝে এই ভয় বেশি দেখা যায়। এটি অনেক সময় অ্যাগোরাফোবিয়াতে রূপ নিতে পারে। এই ফোবিয়ার মানুষেরা একদিকে যেমন ঘরে থাকতে নিরাপদ বোধ করে আবার অনেকেই বিদ্যুত চমকানোর সাথে সাথে ছুটে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। অনেকে আবার এতই ভয় পায়, সে বাইরে যেতে চাইলেও বাথরুম বা খাটের তলায় গিয়ে বসে মৃগী রোগীর মত কাঁপতে থাকে এবং চিৎকার করে কাউকে ডেকে নিজের অবস্থান জানাতে পারে না।

ট্রাইপেনোফোবিয়াঃ আপনার অনেক বন্ধুদের মধ্যে দেখবেন এরা কোন অসুখ হলেও সহজে ডাক্তারের কাছে যেতে চায়না। অনেক জোরাজুরি করে একবার একজনের কাছ থেকে এর কারন জানতে পেরে অবাক হয়েছিলাম। সে ডাক্তার আর হাসপাতাল ভয় পায় কারন, চিকিৎসা নিতে হলে হয়তো তাকে ইঞ্জেকশন নিতে হতে পারে। ব্যাপারটা আপাতদৃষ্টিতে হাস্যকর লাগলেও এই ভয়টা কিন্তু খুব বেশি দেখা যায়। মেয়েদের মধ্যে অনেকে ইঞ্জেকশন নেবার অবস্থায়ও অজ্ঞান হয়ে যান ভয়ে। মানুষ হেসে উড়িয়ে দিলেও জেনে অবাক হবেন, যুক্তরাষ্ট্রের মত দেশে প্রতি দশ জনে একজন এই ফোবিয়ায় ভোগে যেখানে আমাদের এখানে বারোজনে একজন। কোন কারনে ইঞ্জেকশন নিতে হলে এরা চোখ বন্ধ করে রাখেন, তখন কম্পন বেড়ে যায়। অনেকে শরীর ভয়ে মারত্নক ঠাণ্ডা হয়ে মারাও যান। স্বভাবতই এই ফোবিয়ায় আক্রান্তরা ডাক্তার, ডেন্টিস্টদের এড়িয়ে চলেন। আমার যখন বাতজ্বর ধরা পড়ে, আমি জানতে পারি আমাকে প্রায় দশলাখ পাওয়ারের পেনিসিলিন দেয়া হবে। আমি স্কিন টেস্টের ইঞ্জেকশন দেবার সময়ই অজ্ঞান হয়ে যাই। পরবর্তীতে ডাক্তার বুঝতে পেরে আমাকে  ক্যাপসুল এবং ট্যাবলেট দেন।

সোশ্যাল ফোবিয়াঃ সোশ্যাল এংজাইটি ডিসঅর্ডার কে সোশ্যাল ফোবিয়া বলেছেন মনোবিদরা। আমরা হুট করে অনেককেই অসামাজিক বলে বসি, সে হয়তো কোন অনুষ্ঠান, বিয়ে বা সামাজিক আচারগুলোতে থাকে না তাই। কিন্তু ভেবে দেখিনা, এর পেছনে কি কারন থাকতে পারে। সামাজিক বিষয়াদিতে বিভিন্ন ঝামেলা বা মানহানিকর ব্যপার এড়াতে অনেকে এসব অনুষ্ঠানে যান না, একে সোশ্যাল ফোবিয়া বলা যায়। সাধারনত চোখের সামনে বিভিন্ন ঝামেলা বা অপমানজনক কিছু দেখে (সেটা মারামারির পর্যায়ও হতে পারে) এই ধরনের ভয়ের জন্ম হয়। বয়ঃসন্ধিকালে মেয়েদের যখন মাসিক চলতে থাকে তারা সর্বোচ্চ চেষ্টা করে ঘরের বাইরে না বের হতে, কোন সামাজিক অনুষ্ঠান তো দূরের কথা। এছাড়া খেয়াল করলে দেখবেন, অনেক দিনের কোন সম্পর্ক যেটা জানাজানি হয়ে আছে সেটা ভেঙে গেলে মানুষগুলো লোকচক্ষুর আড়ালে থাকে যেন তাদের দেখে কেউ কথা তুলতে বা  হাসাহাসি না করতে পারে। তাই আমাদের একটু সচেতন হয়ে তাদের সাথে  কথা বলা উচিৎ।

অ্যাগোরাফোবিয়াঃ বজ্রপাতের শব্দের ভয় নিয়ে বলেছি, সেখানে অ্যাগোরাফোবিয়ার কথা এসেছে। বাথরুমে একা একা ভয় পেয়ে যাদের পা আটকে যায়, বের হবার সাহসও থাকে না তাদের এই ভয়টা ঘিরে রাখে আসলে। আরেকটু সাজিয়ে বলতে গেলে, এটা এক ধরনের একাকীত্ব থেকে সৃষ্ট ভয় যেখান থেকে রোগী চাইলেও বেরিয়ে যেতে পারে না। অনেক মানুষের ভীড়ে কনসার্ট দেখতে গিয়ে মেয়েরা অনেকে এই ভয় পায়। সে ভাল করে বের হতে পারবে কিনা বা কারো দ্বারা লান্হিত হবে কিনা তার ভয় পায়। আবার অনেকে বিয়েবাড়িতে বা স্কুল কলেজের পিকনিকে দেখবেন হুট করে কাউকে গান গাইতে বা কিছু করতে বললে সে মারাত্নক ভয় পেয়ে যায়, এটাও তেমনি। ভয় পাওয়ার কারনে যেসব ডিসঅর্ডার দেখা যায় তার এক তৃতীয়াংশের মাঝে এই ভয় থাকে। একটু দেরিতে যাদের মানসিক পরিপক্কতা আসে সাধারণত ত্রিশের শেষের দিকে এই ভয়টা বেশি দেখা যায়। প্রতিবন্ধীদের মাঝে ডাক্তাররা এই ভয়টা কাটাতে  বেশি চেষ্টা করে থাকেন।

মাইসোফোবিয়াঃ আমার এক কলিগের কাছে শুনেছি তার একটু পরপর হাত না ধুলে মানসিক অস্বস্তি হয়। ব্যপারটা এমন না যে তার হাত ময়লা থাকে বা তিনি অপরিষ্কার। এটা অনেকটা তার অভ্যাস বা কিছুটা বদভ্যাস , অন্যের জন্য দৃষ্টিকটু। সাধারনত ময়লা বা পোকামাকড়ের সংষ্পর্শে আসার এই ভয়টির নাম মাইসোফোবিয়া। আমরা  সবাই পরিচ্ছন্নতা পছন্দ করি, কিন্তু মাত্রাতিরিক্ত অবশ্যই না। এই ফোবিয়ার ক্ষেত্রে আক্রান্তকে দেখা যায় একদম গায়ে ময়লা লাগতে দেন না, টিস্যু বা হ্যাণ্ডওয়াশ সবসময় সাথে নিয়ে ঘোরেন। আমাদের ভাষায়, এটিকে ছুঁচিবাই বলে অনেকে। অনেকদিন আগে একটা বিদেশি উপন্যাস পড়েছিলাম, যেখানে গল্পের নায়ক নায়িকার মাঝে গভীর প্রেম হওয়া সত্ত্বেও তারা কেউ কাউকে চুমু খেতনা। নায়ক চাইলেও খুব অন্তরঙ্গ মুহূর্তেও নায়িকা ব্যপারটা এড়িয়ে যেত। একটা সময় নায়ক খেয়াল করলো তার সঙ্গিনী তার হাতও ধরতে চায় না। অনেক জোরাজুরির পর সে জানতে পারে নায়িকা চুমু বা স্পর্শের ভয়ে থাকে যেন কোন জীবাণু তার দেহে না ছড়ায়। এই ধরনের রোগীরা ডাক্তারের চেম্বার, হাসপাতাল, স্কুল বা ফার্মেসি এড়িয়ে চলে জীবাণু বা ময়লার ভয়ে।

এই দশটি ফোবিয়া আমরা একটু চোখ মেলে তাকালেই আমাদের আশপাশের মানুষের মাঝে দেখতে পাই। তবে আরো অসংখ্য আছে যা নিয়ে বিশদ আলোচনা অন্যকোন পর্বে করা যাবে। ডিসঅর্ডার পর্যায়ে যাবার আগ পর্যন্ত এসব ফোবিয়া ততটা মারত্নক নয়, কাছের মানুষের জানা থাকলে খুব সহজেই জীবন যাপন সম্ভব। অন্যথায় উপযুক্ত মানসিক চিকিৎসার সাথে দরকার আমাদের সহযোগীতা। শেষ কথা, আমরা সবাই কিন্তু কোন না কোন ফোবিয়ায় আক্রান্ত।

Leave a Comment