মহামতি অশোকের ধর্ম বিজয়।

  • কামরুন নাহার স্মৃতি
  • মার্চ ২৬, ২০১৯

প্রতিবেশি দুটি সাম্রাজ্য মগধ এবং কলিঙ্গ। মগধ অপেক্ষাকৃত বড়, তার শক্তিও তুলনায় বেশি। তবুও মগধ সম্রাটের মনে শান্তি নেই। প্রতিবেশি এক শত্রুকে রেখে কি নিশ্চিন্ত হওয়া যায়! দুই পক্ষের সৈন্যবাহিনীই শক্তিশালী। কিন্তু মগধের সৈন্যরা অনেক বেশি যুদ্ধপটু আর কৌশলী। কলিঙ্গের সৈন্যরা বীর বীক্রমে লড়াই করেও পরাজিত হল। আহত আর নিহত সৈন্য ভরে উঠল যুদ্ধক্ষেত্র। রক্তাক্ত হল সমস্ত প্রান্তর। কলিঙ্গরাজ নিহত হলেন। বিজয়ী মগধ সম্রাট হাতির পিঠে চেপে যেতে যেতে দেখলেন তাঁর দুপাশে ছড়িয়ে রয়েছে কত অসংখ্য মৃতদেহ। কত আহত সৈনিক। কেউ আর্তনাদ করছে, কেউ যন্ত্রণায় কাতর হয়ে চিৎকার করচজে। কেউ সামান্য একটু পানির জন্য ছটফট করছে। আকাশে মাংসের লোভে শকুনের দল ভীড় করেছে।

যুদ্ধক্ষেত্রের সেই বিভীষিকাময় দৃশ্য দেখে সম্রাট বিষণ্ণ হয়ে গেলেন। অনুভব করলেন তাঁর সমস্ত অন্তর ভারাক্রান্ত হয়ে উঠেছে। ধীরেধীরে নিজের তাবুতে ফিরে শিবিরের সামনে দিয়ে চলেছে এক তরুণ বৌদ্ধ সন্ন্যাসী। সন্ন্যাসী বললেন, আমি যুদ্ধক্ষেত্রে আহত সৈনিকদের সেবা করতে চলেছি। মুহূর্তে অনুতাপের আগুনে দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল সম্রাটের হৃদয়। সম্রাটের অন্তর জ্বলে উঠল, নতুন এক প্রজ্ঞার আলোক। তিনি শপথ করলেন আর যুদ্ধ নয়, আর হিংসা নয়, ভগবান বুদ্ধের করুণায় আলোর অহিংসা মন্ত্রে ভরিয়ে দিতে হবে সমগ্র পৃথিবী। একদিন যিনি ছিলেন উন্মত্ত দানব - এবার হলেন শান্তি আর অহিংসার পূজারী প্রিয়দর্শী অশোক।

অশোক সিংহাসনে আরোহণ করে প্রথম কয়েকবছর নিজের অধিকারকে সুপ্রতিষ্ঠিত করলেন। যারা তাঁর আনুগত্য অস্বীকার করল, তিনি তাদের নির্মমভাবে হত্যা করলেন। তাঁর এই নৃশংসতার জন্য লোক তাঁকে চণ্ডাশোক বলত। অশোক ঘোষণা করলেন আর যুদ্ধ নয়, এবার হবে ধর্ম বিজয়। ত্রাতৃত্ব প্রেম, করুণার মধ্যে দিয়ে অপরকে জয় করতে হবে। শুধুমাত্র নির্দেশ প্রদান করেই নিজের কর্তব্য শেষ করলেন না  এতদিনও রাজসুখ বিলাস বাসনের সাথে পরিচিত ছিলেন তা পরিত্যাগ করে সরল পবিত্র জীবনযাত্রা অবলম্বন করলেন। তিনি সকল প্রতিবেশি দেশের রাজাদের কাছে দূত পাঠিয়ে ঘোষণা করেছিলেন তাদের সাথে মৈত্রী, প্রেমের বন্ধনে আবদ্ধ হতে চান। সকলে যেন নির্ভয়ে আপন রাজ্য শাসন করেন। এমন কি সম্রাট অশোক তাঁর উত্তরাধিকারীদের কাছেও দেশ জয়ের জন্য যুদ্ধ করতে নিষেধ করেছিলেন। 

তিনি তাদের উপদেশ দিতেন অস্ত্রের মাধ্যমে নয়, প্রেম করুণা সহৃদয়তার মধ্যে দিয়েই মানুষকে জয় কর। এই জয়কে সম্রাট অশোক বলতেন ধর্ম বিজয়। অশোকের নির্দেশে বহু পথ নির্মাণ করা হল। এই সমস্ত পথের দুপাশে প্রধানত বট এবং আম গাছ পোতা হত। যাতে মানুষ ছায়ায় পথ চলতে লারে, ক্ষুধার সময় গাছের ফল খেতে পারে। প্রতি আট ক্রোশ অন্তর পথের ধারে কূপ খনন করা হয়েছিল। শুধু মানুষ নয়, পশুদের প্রতিও ছিল তাঁর গভীর মমতা। তিনি সমস্ত রাজ্যে পশুহত্যা, শিকার নিষিদ্ধ করেছিলেন। অশোক বৌদ্ধ হলেও অন্য কোন ধর্মের প্রতি তাঁর কোন বিদ্বেষ ছিল না। সম্রাট অশোক তাঁর সমস্ত জীবন প্রজাদের সুখ কল্যানে, তাদের আত্নিক উন্নয়নে ব্যয় করেছিলেন।

সেকালের ব্রাহ্মণরা তাঁর এই বৌদ্ধ ধর্ম প্রীতিকে ভালোভাবে গ্রহণ করেনি, গোপন ষড়যন্ত্র আরম্ভ করে, তাঁর এক রানীও সেই ষড়যন্ত্রে যুক্ত ছিলেন। জানতে পেরে প্রচণ্ড মর্মাহত হলেন অশোক। মনের দুঃখে রাজ্যপাট ত্যাগ করে বৌদ্ধ বিহারে গিয়ে আশ্রয় নিলেন। একদিন যিনি ছিলেন সমগ্র ভারতের সম্রাট, তিনি আজ রিক্ত। বুঝতে পারলেন পৃথিবীতে তার প্রয়োজন ফুরিয়েছে, এইবার বিদায় নিতে হবে। অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই বেদনাহত চিত্তে পৃথিবী থেকে বিদায় নিলেন নৃপতি মহামতি অশোক।।

Leave a Comment