শিশুর জন্মগত হৃদরোগ! এর লক্ষণ এবং প্রতিকার 

  • ওমেন্সকর্নার ডেস্ক
  • মার্চ ৩, ২০১৮

একটি সুস্থ শিশু বয়ে নিয়ে আসে আশার আলো, সৌভাগ্যের দীপশিখা  ঠিক তেমনি জন্মগত ত্রুটি নিয়ে বেড়ে ওঠা শিশুও তার পরিবারকে নিয়ে যায় হতাশার সমুদ্রে, সেও পরবর্তীতে জাতির জন্য বোঝা হয়ে উঠে । জন্মগত হৃদরোগ এমনই একটি রোগ যার শুরু মায়ের গর্ভে। গবেষণায় দেখা গেছে প্রতি ১০০০ জন জীবিত শিশুর মধ্যে ৮ জন শিশু জন্মগত হৃদরোগ নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। এই ১০০০ জনের ৮ জনের মধ্যে আবার ২-৩ জনের রোগের লক্ষণ জন্মের প্রথম ৬ মাসের মধ্যেই নানাবিধ উপসর্গ সহ প্রকাশ পায়। বাকিদের পরবর্তীতে জীবনের যেকোনো সময় তা প্রকাশ পেতে পারে । বাংলাদেশে প্রতি বছর ২৫ থেকে ৩০ হাজার শিশু জন্মগত হৃদরোগ নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। আজকে আমরা জন্মগত হৃদরোগ নিয়ে আলোচনা করব।

জন্মগত হৃদরোগ কাকে বলে – মায়ের গর্ভে থাকাকালীন অবস্থায় শিশুর হৃদযন্ত্র তৈরি ও বিকশিত হবার প্রাক্কালেই যদি কোনো প্রকার ত্রুটি হয় এবং শিশু সেই হৃদযন্ত্র নিয়ে ভূমিষ্ঠ হয়, তবে তাকে জন্মগত হৃদরোগ বলে।  অনেক সময় একে  শিশুর  হার্ট  এ  ফুটা বা ছিদ্র আছে  এমন  শব্দ  ব্যবহার  করা হয়।

কারণ : জন্মগত শিশু হৃদরোগের সুনির্দিষ্ট কোনো কারণ এখন পর্যন্ত জানা যায় নাই। তবে গর্ভাবস্থায় ও গর্ভ পরিকল্পনাকালীন সময়ে বিভিন্ন ঔষধ, রাসায়নিক দ্রব্য, রেডিয়েশান, মায়ের ডায়াবেটিস ও উচ্চরক্তচাপ, প্রভৃতি রোগ, গর্ভাবস্থায় মায়ের রুবেলা সংক্রমণ ইত্যাদির সাথে শিশু হৃদরোগের যোগসূত্র পাওয়া যায়। এছাড়াও জেনেটিক কিছু রোগ যেমন – ডাউন সিনড্রোম (Down Syndrome), টারনার সিনড্রোম (Turner Syndrome) নিয়ে জন্মানো শিশুরা হৃদরোগে আক্রান্ত হতে পারে।

লক্ষণসমূহ –

জন্মের পর থেকেই ঘন ঘন ঠান্ডাকাশি ও শ্বাসকষ্ট, মায়ের বুকের দুধ টেনে খেতে অসুবিধা ও অল্পতেই হাঁপিয়ে যাওয়া , হাত ও পায়ের আঙ্গুল ও ঠোঁটে নীলাভ ভাব, ওজন ও শারীরিক বৃদ্ধির অপ্রতুলতা ইত্যাদি।

শিশুর প্রতি মায়েদের লক্ষণীয় বিষয় –

১। শিশুটির জন্মের পর পরই শ্বাসকষ্ট হচ্ছে কিনা ।

২। ভীষণ রকমের কালচে বা নীলাভ ভাব তার ঠোঁটে বা চামড়ায় দেখা যাচ্ছে কিনা

৩। শিশুটির হার্ট বিট যদি অস্বাভাবিক রকমের কম বা বেশি হয় অথবা ছন্দোবদ্ধ না হয়ে অস্বাভাবিক ভাবে চলে ।

৪। বাচ্চাটি জন্মগ্রহণ করার পর মায়ের দুধ পান করার সময় হাঁপিয়ে যায় কিনা।

৫। অল্প অল্প দুধ পান করে ক্লান্ত হয়ে ছেড়ে দিয়ে আবার কিছু সময় পর দুধ পান করছে কিনা।

৬। দুধ পান করার সময় শিশুটি অস্বাভাবিক রকমের ঘামছে অথবা শ্বাসকষ্ট হচ্ছে।

৭। শিশুটি অন্য সব বাচ্চাদের মত ওজনে বাড়ছে না।

৮। জন্মের পর থেকেই শিশুর  বার বার ঠাণ্ডা কাশি লেগেই আছে কিনা এবং সে কারণে বার বার হাসপাতালে ভর্তি হতে হচ্ছে বা ডাক্তারের কাছে যেতে হচ্ছে।

৯। শিশুটি কান্নার সময় অস্বাভাবিক রকমের কালো হয়ে যায় এবং একই সাথে শ্বাস কষ্ট হয়। একটু বড় বাচ্চারা খেলার সময় একটু দৌড়াদৌড়ি করলেই কালো হয়ে যায়, শ্বাস কষ্ট হয় এবং উপুড় করে শুইয়ে দিলে বা বড় বাচ্চারা হাঁটু গেড়ে বসলে তাদের স্বস্তি আসে। বড় বাচ্চাদের কখনো কখনো বুকে ব্যথা, বুক ধড়ফড় করা, অজ্ঞান হয়ে যাওয়া ইত্যাদিও হতে পারে। উপরের যেকোনো একটি লক্ষন দেখা দিলেই শিশুকে দ্রুত ডাক্তার এর কাছে নিতে হবে।

রোগ নির্ণয় : সঠিক সময়ে রোগ নির্ণয় করতে পারলে বেশির ভাগ হৃদরোগ চিকিৎসায় ভালো হয়। একটি মাত্র পরীক্ষা যদি করা হয় রোগ সনাক্তের জন্য তাহলে সেটা হলো কালার ডপলার ইকোকারডিওগ্রাফী ( Color Doppler Echocardiography)। এখন মোটামুটি সব হাসপাতাল বা হৃদরোগ সেন্টার, ডায়াগনস্টিক সেন্টারে ইকোকারডিওগ্রাফী পরীক্ষা হয়। এছাড়াও চেস্ট এক্সরে, ইসিজি, হলটার মনিটরিং, ক্যাথ স্টাডি, কার্ডিয়াক সিটি স্কান, এম আর আই ইত্যাদি।

চিকিৎসা –

(১) ঔষধের মাধ্যমে ।

(২) ইন্টারভেনশান বা বিনা অপারেশনে রক্তনালীর মাধ্যমে ।

(৩) সার্জারি বা অপারেশন ।

(৪) কিছু জন্মগত হৃদরোগের নাম ও চিকিৎসা পদ্ধতি –

(৫) এএসডি- ASD

(৬) একে এট্রিয়াল সেপ্টাল ডিফেক্ট বলা হয়। হার্ট এর উপরের অংশের দুটি প্রকোষ্ঠের মাঝে একটি অস্বাভাবিক ফুটো থাকার নামই এএসডি।

(৭) এএসডি ছোটো হলে ২-৫ বছরের মধ্যে নিজে নিজেই বন্ধ হয়ে যেতে পারে।

(৮) বড় এএসডি হলে অথবা নিজে নিজে বন্ধ না হলে অপারেশনের দ্বারা অথবা ক্যাথেটার করে ডিভাইস ক্লোজার (ইন্টারভেনশান বা বিনা অপারেশনে রক্তনালীর মাধ্যমে) করা যায়।

(৯) অনেক সময় পরিণত বয়স বা বার্ধক্যে এসে এই রোগটি ধরা পড়ে।

(১০) ভিএসডি- VSD

(১১) একে ভেন্ট্রিকুলার সেপ্টাল ডিফেক্ট বলা হয়। হার্ট এর নিচের অংশের দুটি প্রকোষ্ঠের মাঝে একটি অস্বাভাবিক ফুটো থাকার নামই ভিএসডি।

(১২) বিভিন্ন ধরনের ভিএসডি আছে, খুব জটিল প্রকৃতির না হলে এটাও ২ বছরের মধ্যে নিজে নিজেই বন্ধ হয়ে যেতে পারে।

(১৩) অধিকাংশ ভিএসডি ই অপারেশনের দ্বারা অথবা ক্যাথেটার করে ডিভাইস ক্লোজার (ইন্টারভেনশান বা বিনা অপারেশনে রক্তনালীর মাধ্যমে)  করে বন্ধ করতে হয়।

(১৪) এএসডির মত এই রোগটিও অনেক সময় পরিণত বয়স বা বার্ধক্যে এসে ধরা পড়ে।

টফ (টেট্রালজি অব ফেলট)-TOF: এটি বেশ জটিল একটি জন্মগত রোগ। হার্ট এর আভ্যন্তরীন চারটি ত্রুটির সমন্বয়ে এই রোগটি হয়। জন্মের সপ্তাহ দুয়েক পর থেকেই শিশুর শ্বাস কষ্ট দেখা দেয় এবং খাবার সময় অথবা কান্না করলে শিশুটি নীল হয়ে যেতে থাকে। ক্রমান্বয়ে এই লক্ষন গুলো বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং শিশুর শারীরিক বৃদ্ধিও ব্যাপক ব্যহত হয়। মাঝে মাঝে হঠাৎ করেই সে নীল হয়ে যায়, তবে এই মুহূর্ত গুলোয় মলত্যাগের ভঙ্গিমায় বসে থাকলে রোগীর আরাম হয়। অপারেশনই এই রোগের একমাত্র চিকিৎসা। অপারেশন না করালে অধিকাংশ শিশু  শৈশবেই জীবন হারাতে পারে।

পিডিএ – PDA : পুরো নাম প্যাটেন্ট ডাক্টাস আর্টারিওসাস। ফুসফুসের ধমণীর সাথে মহাধমণীর (এওরটা) অস্বাভাবিক সংযোগই পিডিএ। সাধারণত পূর্ণ পরিণত হবার আগেই যেসব শিশু জন্ম গ্রহণ করে তদের এই রোগ বেশি হয়। অভিজ্ঞ চিকিৎসক রোগীকে পরীক্ষা করেই রোগ নির্ণয় করতে পারেন। এটির আকার ছোটো হলে ক্যাথেটার দ্বারা ডিভাইস ক্লোজার (ইন্টারভেনশান বা বিনা অপারেশনে রক্তনালীর মাধ্যমে)
বড় হলে সার্জারি করা লাগে। জন্মগত হৃদরোগ প্রতিরোধে করনীয় –

(১) মহিলাদের রুবেলা টিকা দেওয়া।

(২) গর্ভাবস্থায় যথাযত পরিচর্যা এবং ফলিক এসিডের ঘাটতি পূরণ করা।

(৩) গর্ভাবস্থায় রাসায়নিক পদার্থ ও তেজস্ক্রিয়তা থেকে সতর্ক থাকা।

(৪) গর্ভধারণের পূর্বেই ডায়াবেটিস, উচ্চরক্তচাপ, খিচুনি জাতীয় রোগে আক্রান্ত মায়েদের চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া ।

(৫) শিশুর সুন্দর –সুস্থ- স্বাভাবিক জীবন আমাদের কাম্য । সময়মত সমস্যাগুলি নির্ণয় ও তার সঠিক চিকিৎসা করে আপনিই পারেন তার চলার পথ সুন্দর ও সাবলিল করতে। 

তথ্য এবং ছবি : গুগল 

Leave a Comment