চোখের ছানির বিস্তারিত বর্ণনা এবং চিকিৎসা 

  • রেজবুল ইসলাম
  • এপ্রিল ২১, ২০১৮

চোখের আইরিশ বা কালো পর্দার পিছনে স্বচ্ছ বা পরিস্কার কাঁচের মত যে জিনিসটি আছে তাকে লেন্স বলে। আলোকরশ্মি এই লেন্সের মধ্য দিয়ে চোখের পিছন দিকে স্নায়ুপর্দা বা রেটিনাতে পড়ে। তবেই আমরা কোন জিনিস দেখতে পাই। যদি কোন কারণে এই লেন্সটি অস্বচ্ছ বা ঘোলাটে হয়ে যায় তখন তাকে আমরা ছানি বা ক্যাটার্যাক্ট বলে খাকি। আলোকরশ্মি কোন অস্বচ্ছ বস্তুর মধ্য দিয়ে প্রবেশ করতে পারে না। তাই ছানি পড়ে গেলে আলোকরশ্মি চোখের রেটিনাতে পৌঁছাতে পারে না। ফলে ছানি পড়া চোখে দেখা যায় না। তবে দৃষ্টিশক্তি আস্তে আস্তে কমে আসে। পৃথিবীব্যাপী অন্ধত্বের চারটি প্রধান কারণের মধ্যে ছানি একটি। অন্য কারণগুলো হলো- কর্ণিয়ার রোগ, গ্লুকোমা ও ডায়াবেটিসজনিত চোখের রোগ। আমাদের দেশেও ছানি অন্ধত্বের একটি অন্যতম প্রধান কারণ।

ছানির কত প্রকার হয়?

জন্মগত ছানিঃ কোন কোন শিশু ছানি নিয়ে জন্ম গ্রহণ করতে পারে বা জন্মের পর পরই ছানি দেখা দিতে পারে। এ ধরণের ছানিকে জন্মগত ছানি বলে। এক তৃতীয়াংশ জন্মগত ছানি সাধারণত: বংশগত। গর্ভাবস্থায় মায়ের কোন কোন অসুখ যেমন- রুবেলা, টক্সোপ্লাজমোসিস, সাইটোমেগালোভাইরাল ডিজিজ, মাম্স, ইনফ্লুয়েন্জা ইত্যাদি হলে সন্তানের এ ধরণের ছানি হতে পারে। গর্ভাবস্থায় মা যদি অতিরিক্ত স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধ সেবন করে তবেও সন্তানের এ ধরণের ছানি হতে পারে।

চিকিত্সাঃ জন্মের পর পরই যদি পূর্ণ ছানি দেখা দেয় তবে জন্মের কয়েক সপ্তাহের মধ্যে ছানি অপারেশন করা উচিত। দেরীতে বা বেশী বয়সে ছানি অপারেশন করলে চোখ অলস চোখে পরিণত হতে পারে।

বয়সজনিত ছানি বা এজ রিলেটেড ক্যাটার্যাক্টঃ এ ধরণের ছানিই সবচেয়ে বেশী হয়। বযস বাড়ার কারণে এ ধরণের ছানি হয়। পরিণত বয়সে ছানি পড়তে শুরু করে ৫০-৬০ বত্সর বযসে। বয়স ৬০-৭০ বছর হলে ছানি পড়াটা খুব স্বাভবিক। তবে অনেকের বংশগত কারণে ৪০-৪৫ বছর বযসেও ছানি পড়তে পারে। বয়স বেশী হলে ছোখের লেন্সের মধ্যে কিছু রাসায়নিক পরিবর্তন সাধিত হয়ে লেন্স অস্বচ্ছ বা ঘোলাটে হয়ে যায় এবং ছানি পড়ে।

ছানি অপারেশন : অপারেশনই হচ্ছে ছানির একমাত্র চিকিত্সা। বয়সজনিত কারণে ছানি পড়ার প্রথম দিকে ছানি অপরিপক্ক থাকে। তখন আলোক রশ্মির কিছু অংশ রেটিনাতে প্রবেশ করতে পারে। চশমা দিয়ে দৃষ্টিশক্তি কিছুটা বাড়ানো যায়। এতে যদি রোগীর দৈনন্দিন কাজকর্মে কোন অসুবিধা না হয় তবে আরো কিছুদিন পরে ছানি অপারেশন করা যেতে পারে। কিন্তু চশমা দিয়েও যদি রোগী দৈনন্দিন কাজকর্ম করতে না পারে, তবে অবশ্যই ছানি অপারেশন করতে হবে। একটা প্রচলিত ধারণা আছে যে, ছানি পরিপক্ক না হলে অপারেশন করা যায় না। এ ধারণাটি সম্পূর্ণ ভুল। আধুনিক যন্ত্রপাতির সাহায্যে যে কোন পর্যায়েই ছানি অপারেশন করা যায়। ছানি অপারেশন নির্ভর করে রোগীর পেশার উপর। ছানির জন্য একজন কৃষকের যদি দূরের দৃষ্টি খারাপ হয়, তার কাছের দৃষ্টি ভাল থাকলেও অপারেশন করা হয়। আবার একজন লাইব্রেরিয়ানের যদি ছানির জন্য কাছের দৃষ্টি খারাপ হয়, তার দূরের দৃষ্টি ভাল থাকলেও অপারেশন করা হয়।

ছানি অপারেশরে বিভিন্ন পদ্ধতি :

কাউচিং ঃ প্রাচীনকালে কাউচিং পদ্ধতিতে চোখের অস্বচ্ছ লেন্স চোখের ভিতর জেলীর মত জিনিস ভিট্রাসে ফেলে দেয়া হতো। এতে রোগী সাময়িকভাবে কিছু কিছু দেখতে পেত। কিন্তু অচিরেই এই পদ্ধতির জটিলতার দরুন চোখ চিরতরে অন্ধ হয়ে যেত। এটা একটা অবৈজ্ঞানিক পদ্ধতি।

আইসিসিই (ইনট্রাক্যাপসুলার ক্যাটার্যাক্ট এক্সট্রাকশন)ঃ এই পদ্ধতিতে লেন্সের ক্যাপসুলসহ পুরো লেন্স অপারেশন করে বের করা হয়। এ পদ্ধতির জটিলতা বেশী। এই পদ্ধতিতে ছানি অপারেশন করে কৃত্রিম লেন্স সংযোজন করা হয় না। ফলে পুরু ও মোটা লেন্সের চশমা ব্যবহার করতে হয়। এ ধরণের পুরু ও মোটা লেন্সের চশমা দিয়ে আরামদায়ক দৃষ্টি ফিরে পাওয়া যায় না। বর্তমানে এ পদ্ধতি সম্পূর্ণ অচল।

ইসিসিই (এক্সট্রাক্যাপসুলার ক্যাটার্যাক্ট এক্সট্রাকশন)ঃ এই পদ্ধতিতে লেন্সের সামনের ক্যাপসুল গোলাকৃতি করে কেটে ভিতর থেকে লেন্স বের করা হয়। পিছনের ক্যাপসুলটি থেকে যায়। এখানে সামনের ক্যাপসুলের কিছু অংশ ও পিছনের ক্যাপসুল মিলে যে ব্যাগ তৈরী করে সেখানে কৃত্রিম লেন্স বসানো হয়। এই পদ্ধতি যে কোন ধরণের ছানির জন্যই উত্তম। এই পদ্ধতির জটিলতা কম। লেন্সের পিছনের ক্যাপসুলটি থাকার ফলে চোখের ভিতরের জেলীর মত জিনিস বা ভিট্রাস স্থিতাবস্থায় থাকে, যা রেটিনাকে সুরক্ষা করতে সাহায্য করে। কৃত্রিম লেন্স লাগানোর ফলে রোগী চশমা ছাড়া বা অল্প পাওয়ারের চশমা দিয়ে দূরের ও কাছের জিনিস দেখতে পারে। চোখ প্রায় স্বাভাবিক দৃষ্টি ফিরে পায়।

ফ্যাকোইমালসিফিকেশনঃ সংক্ষেপে ফ্যাকো সার্জারী বলে। ছানি অপারেশনের সবচেয়ে উন্নত পদ্ধতি। এই পদ্ধতিতে চোখের অস্বচ্ছ লেন্সকে আলট্রাসনিক ভাইব্রেশনের সাহায্যে টুকরা টুকরা করে বের করে আনা হয়। ছোট একটি টানেল ইনসিশনের মাধ্যমে ফ্যাকো মেশিন দ্ব্বারা চোখের অস্বচ্ছ লেন্সকে অপসারণ করা হয়। ঐ একই পথে চোখের ভিতর কৃত্রিম লেন্স সংযোজন করা হয়। এতে কোন সেলাই-এর প্রয়োজন হয় না।

এসআইসিএস (স্মল ইনসিশন ক্যাটার্যাক্ট সার্জারী)ঃ উন্নয়নশীল দেশসমূহে এই পদ্ধতিতে ছানি অপারেশন বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। এই পদ্ধতিতে ফ্যাকো মেশিনের মত দামী যন্ত্রপাতির প্রয়োজন হয় না। তবে অপারেশনের ফলাফল ফ্যাকোর মতই উন্নত। ছোট একটি টানেল ইনসিশনের মাধ্যমে কতগুলি বিশেষ যন্ত্রপাতি দ্ব্বারা চোখের অস্বচ্ছ লেন্সকে বের করে আনা হয়। তবে টানেল ইনসিশনের দৈর্ঘ ফ্যাকোর চেয়ে বেশী হয়। এই পদ্ধতিতে ছানি অপারেশনও সধারণত: চোখে কোন সেলাই-এর প্রয়োজন হয় না।

ছানির জটিলতা : ছানি অপারেশন না করলে চোখে বিভিন্ন জটিলতা দেখা দিতে পারে। চোখের চাপ বেড়ে যেয়ে গ্লুকোমা হতে পারে। লেন্স চোখের ভিতর ভিট্রাসে পড়ে যেতে পারে। ধীরে ধীরে চোখ ট্যারা হয়ে যেতে পারে। চোখের আইরিশের প্রদাহ হতে পারে। চোখে গ্লুকোমা হলে বা আইরিশের প্রদাহ হলে চোখে ভীষণ ব্যথা হয়। এতে রোগী ভীষণ কষ্ট পায়। ছানির জটিলতা দেখা দিলে পরবর্তীতে ছানি অপারেশন করলে আশানুরূপ ফলাফল পাওয়া যায় না।

ছানি প্রতিরোধ : চোখের আঘাত, বিভিন্ন চোখের রোগ, ডায়াবেটিস, কোন কোন ওষুধ ইত্যাদি অল্প বয়সে ছানি পড়ার অন্যতম কারণ। এই কারণগুলি প্রতিহত করা যায়। সাধারণত: শিশু-কিশোরদেরই চোখের আঘাতে ছানি পড়ে বেশী। তাই সতর্ক থাকলে আঘাতজনিত ছানি পড়বে না। শিশুদের হাতে ধারালো কোন জিনিস দেয়া উচিত নয়। তাদের ধারালো খেলনা দিয়ে খেলতে দেয়া উচিত নয়। চোখের কোন অসুখ হলে সময় মত চিকিত্সা করালে অনেক ক্ষেত্রে ছানি পড়বে না। ডায়াবেটিস হলে চিকিত্সার মাধ্যমে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। জন্মগত ছানি প্রতিরোধে গর্ভবতী মায়ের প্রতি বিশেষ নজর দিতে হবে। গর্ভবতী মাকে বেশী পরিমাণে বা দীর্ঘ দিন ধরে ষ্টেরয়েড জাতীয় ওষুধ সেবন করতে দেয়া উচিত নয়। গর্ভবতী মায়ের কোন অসুখ হলে তার উপযুক্ত চিকিত্সা করাতে হবে। নিয়মিত ডাক্তার দ্বারা পরীক্ষা করাতে হবে।

Leave a Comment