
বাংলাদেশের এক অকৃত্রিম বন্ধু!
- অনিরুদ্ধ অপূর্ব
- মার্চ ৫, ২০১৮
প্রকৃতি কিছু মানুষের সাথে বর্বর আচরণ করে থাকে। আবার সেই সব হারানো মানুষগুলোই নিজেদের অকৃত্রিম ভালোবাসা আর কঠিন মনোবলের জের ধরে চিরকাল জায়গা করে নেয় আমাদের হৃদয়ে। বাংলাদেশের সূচনালগ্নের তেমনই একজন অকৃত্রিম বন্ধুকে নিয়ে বলতে চাই কিছু কথা।চায়না ১৯৫৯ সালে তিব্বতে গণহত্যা চালিয়ে অনেক সাধারণ মানুষকে হত্যা করে। তখনও তিব্বতে আড়াই লাখ বৌদ্ধ সন্ন্যাসী ছিল যারা দিনরাত শান্তির বাণী প্রচার করতো, চায়না মাত্র বিশ হাজার সৈন্য পাঠিয়ে তাদেরকে পুড়িয়ে দিয়েছিল, বাস্তুহারা করে দিয়েছিল।
এই তিব্বতেরই তৎকালীন ঘরহারা এক মানুষের নাম ছিলো পেমা, পুরো নাম পেমা গিয়ালপো। চায়নার তিব্বত আক্রমণের সময় পেমা তার ঘর -বাড়ি এবং দুই ভাইকে হারিয়ে ফেলেন। অনেক খুঁজে শেষপর্যন্ত বিশ বছর পর জানতে পারেন তার দুই ভাই আর বেঁচে নেই। পেমা নিজে পালিয়ে গিয়ে শরনার্থী হয়ে বেঁচে রইলেন কোনভাবে। একাত্তরের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পেমা জাপান থেকে শুনতে পেলেন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান থেকে দলে দলে ভারতে প্রবেশকারী নির্যাতিত শরনার্থীদের কথা। পৃথিবীর সব নির্যাতিত মানুষের মধ্যে একটা আত্নিক মিল রয়েছে। এজন্যই পেমা ঠিক করলেন তিনি যেভাবেই হোক নির্যাতিত মানুষের পাশে দাঁড়াবেন। চায়নার কমিউনিস্ট সরকারও তখন পশ্চিম পাকিস্তানকে শক্ত ভাবে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছিলো।

পেমা তার হাইস্কুলের বন্ধুদের নিয়ে একটা ক্লাব খুললেন, ক্লাবটির নাম দিলেন ইন্টারন্যাশনাল ফ্রেন্ডশিপ ক্লাব। পেমা ও তার ক্লাব জাপানের রাজনৈতিক নেতাদের দ্বারে দ্বারে ঘুরতে লাগলেন বাংলাদেশের পক্ষে সমর্থন আদায়ের জন্য। প্রভাবশালী দুজন এমপির সর্মথনও জুটে গেল। তৎকালীন সময়ে জাপানে অবস্থিত পাকিস্তানি দূতাবাসের কর্মকতা ছিলেন এস এম মাসুদ। মাসুদ একদম জনসম্মুখে পশ্চিম পাকিস্তানকে ছেড়ে পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করলেন। জাপানে এটি ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে ফেললো! পেমা মাসুদের শরনাপন্ন হলেন। কীভাবে জাপানে বাংলাদেশের দূতাবাস খোলা যায় এই ব্যাপারে দিনরাত কাজ করতে থাকলেন।
জাপানে বাংলাদেশের নতুন দূতাবাসের জন্য একটা ছোট জায়গাও জুটে গেল। ভারতীয় দূতাবাসের লাইব্রেরির একটা কোণাকে বেছে নিলেন তারা অফিস হিসেবে। এই অফিসে অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ হয়েছে। পেমার প্রধান কাজ ছিলো মাসুদের কথাগুলো জাপানি ভাষায় অনুবাদ করা। তারপর সেগুলোকে স্কুল -কলেজের সামনে লিফলেটের মতো করে হাতে হাতে পৌঁছে দেয়া। টোকিওতে বাংলাদেশের দূতাবাস খোলার ঠিক পূর্বমুহূর্তে বেজে উঠলো বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত, আমার সোনার বাংলা। সবাইকে চমকে দিয়ে সেদিন মাসুদ লুঙ্গি পরে আসলেন এবং উত্তোলন করলেন লাল -সবুজের পতাকা। সামনে উপস্থিত কিছু বাঙালি, ভারতীয় আর জাপানিরা স্যালুট দিয়ে সম্মান জানালেন। সেদিন মাসুদের পাশেই একটা লোক দাঁড়িয়ে নিঃশব্দে কেঁদেছিলো, তার নাম পেমা গিয়ালপো! ঘরহারা, বাস্তুহারা সেই পেমা গিয়ালপো!