বাংলাদেশের কৃষক কতটা ন্যায্য মূল্য পায়?
- রাবেয়া আহমেদ স্বর্ণা
- মার্চ ১৮, ২০১৮
কৃষিনির্ভর দেশ হিসেবে বিশ্বখ্যাত বাংলাদেশ।এ দেশটি মূলত গ্রাম প্রধান।অন্তত ৬৮ হাজার গ্রাম নিয়ে গঠিত।এ দেশের মোট জনসংখ্যার শতকরা ৮০ ভাগ এবং শ্রমশক্তি ৬০ ভাগ কৃষি কাজে নিয়োজিত। গ্রামের উন্নয়নের কথা বলতে গেলে প্রথমে আসে কৃষি উন্নয়ন, কৃষিভিত্তিক শিল্প, বাণিজ্য ও সেবা খাতের উন্নয়ন।যার ফলে এ দেশের অর্থনীতিতে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ একটি সেক্টরের নাম কৃষি। কিন্তু যে কৃষক দেশের অর্থনীতিতে এতোটা ভূমিকা রাখে তারা তাদের ন্যায্য মূল্য পায় কতটুকু? "কৃষকরাই এদেশের চালিকাশক্তি","কৃষক বাঁচলেই বাঁচবে দেশ" এরকম অনেক কিছুই আমরা আওড়াই,কার্যত যা ফাঁপা বুলি মাত্র। তাদের আমরা চাইলে "শাটল কর্ক" বানাতে পারি। কেন এদেশের কৃষক তাদের ন্যায্য দাম পায় না?
খুব কমন একটা অভিযোগ যা সরকার পর্যন্ত দেশের সকলেই মোটামুটি ভালোভাবে জ্ঞাত তা হল বাজারে পাইকারি ক্রেতা যাদেরকে আমরা ফড়িয়া বলে থাকি তাদের শক্তিশালী সিন্ডিকেট। ধানের দাম কমে আসা এবং ন্যায্যমূল্য পাওয়া থেকে কৃষকের বঞ্চিত হওয়ার পেছনে এ সিন্ডিকেট কাজ করে থাকে। তাছাড়া মজুদ ব্যবস্থার স্বল্পতার কারণেও ধানের জোগান বেড়ে ওঠে মৌসুমের সময়। ব্যবসায়ীরা সে সুযোগটাই নিয়ে থাকেন। কৃষকের হাতে পর্যাপ্ত অর্থ থাকলে পরিস্থিতি ভিন্ন হতে পারত।সরকারের বেধে দেয়া ন্যায্যদাম ফড়িয়ারা মানে না। এদের কারণে প্রত্যন্ত অঞ্চলের অনেক কৃষক সরকারের কাছে ধান বা চাল কখনোই বিক্রি করতে পারেনা।যার ফলে, সরকারের নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে অনেক কম মূল্যে এই সব মধ্যস্বত্বভোগীর কাছে অনেকটা পানির দরেই ধান বিক্রি করতে কৃষক বাধ্য হয়।
এছাড়া, আমাদের অধিকাংশ কৃষক বর্গা বা প্রান্তিক চাষী। বেশির ভাগ কৃষকই ঋণ নিয়ে চাষাবাদ করেন।ক্ষেতের ধান উঠলে তাদের সে ঋণ শোধ করতে তাগাদা দেয় ঋণ প্রদানকারীরা। কৃষকের ধান ঘরে উঠতে না উঠতেই পাওনাদারেরা টাকা পরিশোধ করার তাগিদ নিয়ে আসেন।দাতাদের চাপে অধিকাংশ সময় কৃষকেরা সরকারের ন্যায্য মূল্যের আশায় বসে না থেকে অনেক কম দামে ধান বিক্রি করে দিতে বাধ্য হয়ে থাকেন।
সব থেকে হতাশার কথা হল ,পাইকারী বাজারে ধানের দাম কমে গেলেও খুচরা বাজারে চলের দাম বাড়ছে প্রতিনিয়ত। এর ফলে ভোক্তারা ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। বাম্পার ফলনের সুফল না কৃষক না ভোক্তা কেউই পাচ্ছে না। কিন্তু কৃষকদের ব্যাপারে এখন সরকার অনেক বেশি সচেতন এবং এই ব্যাপারে অনেক পদক্ষেপ হাতে নিয়েছে সরকার।
১৫মার্চ ২০১৮ ইং "সময়ের কন্ঠস্বর" এর একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায় যে,প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, গত ৮ বছরে প্রায় ৪০ হাজার ৩০০ কোটি টাকার কৃষি সহায়তা প্রদান করা হয়েছে। এ সময়ে সরকার দেশের কৃষক ও কৃষিখাতের উন্নয়নে যুগান্তকারী পদক্ষেপ নেয়ার ফলেই কৃষিতে ব্যাপক সাফল্য এসেছে। কৃষকদের জন্য ১০ টাকায় ব্যাংক একাউন্ট খোলার ব্যবস্থা করা হয়েছে- উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ”সরকার কৃষককে ভর্তুকি মূল্যে সার, বীজ, যন্ত্রপাতি দিয়েছে। সেচ মওসুমে বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করা হয়েছে। স্বল্প সুদে ও সহজ শর্তে কৃষি ঋণ প্রদান করা হচ্ছে। বর্গা চাষিদের জন্য কৃষি ব্যাংকের মাধ্যমে স্বল্প সুদে বিনা জামানতে কৃষি ঋণের ব্যবস্থা করা হয়েছে।”কৃষকদের জন্য এটি অবশ্যই অনেক ভাল খবর।
স্বাধীনতার পর দেশে প্রতি হেক্টর জমিতে ধান উৎপাদিত হতো দুই টন। আর এখন উৎপাদন হচ্ছে হেক্টর প্রতি চার টনেরও বেশি। স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশের মোট ধানের উৎপাদন তিন গুণেরও বেশি বেড়েছে। বর্তমান সরকারের বাস্তবমুখী পদক্ষেপ এবং দেশের পরিশ্রমী কৃষক ও মেধাবী কৃষিবিজ্ঞানীদের যৌথ প্রয়াসেই এ সাফল্য অর্জিত হয়েছে। গত পাঁচ বছরে দেশের মানুষকে খাওয়ানোর জন্য বাংলাদেশ কোনো চাল আমদানি করেনি। বরং বাংলাদেশ শ্রীলঙ্কায় চাল রপ্তানি শুরু করেছে। ৮জুন ২০১৫ ইং "আজকের পত্রিকা" র একটি প্রতিবেদন থেকে জানতে পারি,বাংলাদেশে এখন খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধির সবদিক থেকে বিশ্বের জন্য পথিকৃৎ। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি) ৬৭ টি ধানের জাত উদ্ভাবন করেছে। বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিনা) উদ্ভাবন করেছে ১৪টি ধানের জাত। আর ১১৫টি হাইব্রিড ধানের জাত উদ্ভাবন করেছে বেসরকারি বীজ কোম্পানিগুলো। এ পর্যন্ত বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি) ও বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিনা) এর বিজ্ঞানীরা মোট ১৩টি প্রতিক‚ল পরিবেশ সহিষ্ণু ধানের জাত উদ্ভাবন করেছে।
এর মধ্যে লবণ সহিষ্ণু ৯টি, খরা সহিষ্ণু ২টি ও বন্যা সহিষ্ণু ৪টি ধানের জাত উদ্ভাবন করেছেন তারা। এ ছাড়া বাংলাদেশ ইক্ষু গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিএসআরআই) এ পর্যন্ত ২৬টি জাত অবমুক্ত করেছে। অন্যদিকে বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিজেআরআই) বেশ কয়েকটি জাত ছাড়াও এরই মধ্যে পাটের জীবন রহস্য উন্মোচন করেছে। গত পাঁচ বছরে তারা ছয়টি জাত অবমুক্ত করেছে। আরো দুটি জাত অবমুক্তের অপেক্ষায় রয়েছে। গত বছর বিশ্বে প্রথমবারের মতো জিঙ্ক সমৃদ্ধ ধানের জাত উদ্ভাবন করেছেন বাংলাদেশের কৃষি গবেষকরা। উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে এতগুলো প্রতিক‚ল পরিবেশ সহিষ্ণু ধানের জাত উদ্ভাবনের দিক থেকেও বাংলাদেশ বিশ্বে শীর্ষ। হেক্টরপ্রতি ধান উৎপাদনের দিক থেকে বিশ্বের অধিকাংশ দেশকে ছাড়িয়ে গেছে বাংলাদেশ আর মোট ধান উৎপাদনে বঙ্গবন্ধুর বাংলদেশ এখন বিশ্বে চতুর্থ।
জাতিসংঘের কৃষি ও খাদ্য সংস্থার হিসেব মতে, সবজি উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে তৃতীয়। গত এক যুগে দেশে রীতিমতো সবজি বিপ্লব ঘটে গেছে। এখন দেশে ৬০ ধরনের ও ২০০টি জাতের সবজি উৎপাদিত হচ্ছে। এসব সবজির ৯০ শতাংশ বীজই দেশে উৎপাদিত হচ্ছে। দেশে বর্তমানে ১ কোটি ৬২ লাখ কৃষক পরিবার রয়েছে। এ কৃষক পরিবারগুলোর প্রায় সবাই কমবেশি সবজি চাষ করেন। গত এক যুগে দেশে মাথাপিছু সবজির ভোগ বেড়েছে প্রায় ২৫ শতাংশ। পাশাপাশি সবজি রপ্তানি করেও মিলছে বৈদেশিক মুদ্রা। গত এক বছরে শুধু সবজি রপ্তানি আয় বেড়েছে প্রায় ৩৪ শতাংশ। জাতিসংঘের কৃষি ও খাদ্য সংস্থার পরিসংখ্যান অনুযায়ী বিশ্বে সবচেয়ে বেশি হারে সবজির আবাদির জমির পরিমাণ বেড়েছে বাংলাদেশে, বৃদ্ধির হার ৫ শতাংশ। খাদ্য ও কৃষি সংস্থার হিসেবে ২০ বছর আগে ১৯৯৪ সালে দেশে মাথাপিছু দৈনিক সবজি খাওয়া বা ভোগের পরিমাণ ছিল ৪২ গ্রাম। বাংলাদেশে কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিএআরআই) হিসেবে ২০১৪ সালে দেশে মাথাপিছু সবজি ভোগের পরিমাণ ৭০ গ্রাম।
প্রাচীন ‘মাছে-ভাতে বাঙালি’ কথাটি মাঝে হারিয়ে গেলেও বর্তমানে তা আবারো বাস্তব। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) প্রতিবেদন মতে ২০১৪ সালে মাছ উৎপাদনে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান চতুর্থ। মাছ উৎপাদনে চীন বিশ্বসেরা, ২য় ও ৩য় অবস্থানে আছে যথাক্রমে ভারত ও মায়ানমার। তারপরই বাংলাদেশের অবস্থান। এফএও পূর্বাভাস দিয়েছে ২০২২ সাল নাগাদ বিশ্বের যে চারটি দেশ মাছ চাষে বিপুল সাফল্য অর্জন করবে তার মধ্যে প্রথম দেশটি হচ্ছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) অর্থনৈতিক শুমারি বলছে ২০১৩-১৪ অর্থবছরে বাংলাদেশে ৩৪ লাখ ৫৫ হাজার টন মাছ উৎপাদিত হয়েছে তন্মধ্যে চাষ করা মাছের পরিমাণ ছিল প্রায় ২০ লাখ টন। জাটকা সংরক্ষণসহ নানা উদ্যোগের ফলে দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় মাছ ইলিশের উৎপাদন ৫২ হাজার টন বেড়ে সাড়ে তিন লাখ টন হয়েছে। মাছ রপ্তানির পরিমাণ বেড়েছে ১৩৫ গুণ। বাংলাদেশের হিমায়িত মৎস্য রপ্তানির পরিমাণ ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ১৭ দশমিক ৩৫ শতাংশ বেড়ে চার হাজার ১৪৯ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে।
বিশ্বে মোট আম উৎপাদনের অর্ধেকের বেশি হচ্ছে দক্ষিণ এশিয়ায়। আর বাংলাদেশের অবস্থান নবম। কৃষি ও খাদ্য সংস্থার সর্বশেষ মূল্যায়নে প্রতিবেদিত হয়েছে যে প্রায় সাড়ে নয় লাখ টন আম উৎপাদনের মাধ্যমে এ অর্জন সম্ভব হয়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য মতে, ২০০৯-১০ অর্থবছরে উৎপাদন হয় ৮ লাখ ৪২ হাজার আর ২০১০-১১ তে ৮ লাখ ৮৯ হাজার টন। ২০১১-১২ অর্থবছরে তা আরো বেড়ে যায় প্রায় সাড়ে নয় লাখ টনে। দেশে গড়ে ৩২ হাজার একর জমিতে আমের আবাদ হচ্ছে। যুক্তরাজ্যে রপ্তানি হচ্ছে বাংলাদেশের ল্যাংড়া ও আম্রপালি আম। বাংলাদেশ থেকে আম রপ্তানির ব্যাপারে বিশ্বের শীর্ষ পণ্য ক্রয়কারী প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল প্রকিউরমেন্ট লজিস্টিকসের সঙ্গে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, হর্টেক্স ফাউন্ডেশন ও এফএওর মধ্যে একটি চুক্তিও স্বাক্ষর হয়েছে।
এক দশক আগেও বাংলাদেশের আলু উৎপাদন ছিল অর্ধলাখ টনের নিচে। সম্প্রতি জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) কর্তৃক প্রকাশিত প্রতিবেদনে উল্লিখিত হয়েছে বর্তমানে বাংলাদেশে আলুর উৎপাদন ৮২ লাখ ১০ হাজার টন। এ সাফল্য বাংলাদেশকে করেছে আলু উৎপাদনে বিশ্বে অষ্টম। অচিরেই বাংলাদেশের আলু উৎপাদন কোটি টনের দিকে যাবে বলে আশা করা যায়। উৎপাদন বিস্ময়কর সাফল্যই কেবল নয়, আলু এখন দেশের অন্যতম অর্থকরী ফসলও। গত বছর রাশিয়ায় প্রায় ২৫ হাজার টন আলু রপ্তানি হয়েছে। ভারত সরকার বাংলাদেশ থেকে আলু আমদানির আগ্রহ দেখিয়ে কৃষি মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়েছে। অথচ এর আগে বিশ্বের ২০টি দেশ থেকে বাংলাদেশকে আলু আমদানি করতে হতো।
অর্থাৎ বলা যায় কৃষিতে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অবলম্বন করে বাংলাদেশ এখন অনেক দূর এগিয়ে যাচ্ছে আর তা আমাদের জন্য সুফল বয়ে আনবে।