বদ অভ্যাস ত্যাগ করি,বিব্রতকর পরিস্থিতি এড়িয়ে চলি

  • ইউসুফ আহমেদ শুভ্র
  • নভেম্বর ১৩, ২০১৮

তখন পঞ্চম শ্রেনিতে পড়ি, বৃত্তি পরীক্ষার আগে মাস তিনেকের জন্য আব্বু খাগড়াছড়িতে নিজের কাছে নিয়ে গেলেন আমাকে। আব্বুর সাথে অফিসে যাই, আব্বু কাজ করে আমি পড়ি। মাঝেমধ্যে দোতলা অফিসের সামনের বারান্দায় হাঁটি। পাশের রাস্তায় দিয়ে বাস ট্রাক যাওয়ার আওয়াজ পেলে দৌঁড়ে রূম থেকে বের হয়ে গাড়ির দিকে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকি। বারান্দায় দৌঁড়াতে বা হাঁটতে গিয়ে পা দিয়ে শব্দ করতে বেশ মজা পাচ্ছিলাম। বারান্দায় হাঁটছি,খসখস খসখস শব্দ হচ্ছে। সেই বয়সে ব্যাপারটা আমার অনেক বেশি ভালো লেগে যায় এবং একটা অভ্যাসে পরিনত হয়ে যায়!

একদিন সেই বারান্দায় শব্দ করেই হাঁটছিলাম আর পাশের ডিসি আংকেলের রূম থেকে একজন এসে আমাকে ডেকে নেয়। ডিসি আংকেল অনেকক্ষন আমার সাথে গল্প করে,চিপস খেতে দেয়,ড্রাইকেক দেয় তারপর সুন্দর করে বুঝিয়ে বলে যে শব্দ করে হাঁটলে মানুষ খারাপ বলে।সেই থেকেই বন্ধ এই বদ অভ্যাস।

আরেকটা ঘটনা বলি। আমি ইন্টারের পর ঢাকায় আসি। ঢাকায় আসার আগে নিয়মিত চা না খেলেও এখানে এসে এটা বেশ নিয়ম মাফিক চলতে লাগলো৷ সকালে নাস্তার সাথে এক কাপ চা, সন্ধ্যাতেও এক কাপ আর দুপুরে বাসায় ফেরার সময়  রহমান মামার টং থেকে এক কাপ। মামার দোকানে চা খেতে গিয়ে একদিন এক বড় আপুকে দেখলাম চা পিরিচে ঢেলে ফুরুৎ ফুরুৎ শব্দ করে খাচ্ছে। ব্যাপারটা বেশ মজার লেগে গেলো আমার। এর কিছু দিন পর আবিস্কার করলাম আমিও শব্দ করে চা খাই এবং আনন্দ নিয়েই খাই!এটাও অনেকটা অভ্যাসেই পরিনত হয়ে যায়।

বছর খানেক পর প্রেমে পড়ি। প্রেমিকা কে নিয়ে একদিন চা খাচ্ছিলাম।একটু পর দেখি সে আমার দিকে হা হয়ে তাকিয়ে আছে।আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যাই তার এই অদ্ভুত ভাবে তাকানো দেখে। মানুষ নয় যেনো এলিয়েন দেখছে। চা শেষে বাসায় ফিরতে ফিরতে সে আমায় বেশ ভালোভাবেই বুঝিয়ে দিয়েছিলো এটা খারাপ অভ্যাস। সেই থেকে আমি চা একটু ঠান্ডা করে শব্দ করা ছাড়াই খাই।

আমরা অবচেতনভাবে অভ্যাসে পরিনত হওয়া অনেক কিছুই বিভিন্ন ঘটনার প্রেক্ষিতে বুঝতে পারি যে সেগুলো ছিলো আমাদের বদ অভ্যাস।যে সব অভ্যাস প্রকাশ্যে করলে মানুষ বিরক্ত হয়,স্বাভাবিকভাবে নেয় না বা অপছন্দ করে সেগুলোই বদঅভ্যাস। কথায় আছে মানুষ অভ্যাসের দাস।সেটাতে সমস্যা নেই তবে নিজের ভিতরে যদি কোন বদ অভ্যাস থেকে থাকে আর আমরা যদি সেটার দাসে পরিণত হই তাহলে অনেক ক্ষেত্রেই আমাদেরকে বিব্রত হতে হয়।

হোটেলে খেতে  অনেকেই হাঁচি দেন খোলামেলা ভাবে।তাতে করে থুতু আর সর্দি ছড়িয়ে যায় আশেপাশে। এটা বেশ বিব্রতকর সবার জন্যই। অথচ হাঁচি আসার সাথে সাথে চেয়ার ছেড়ে একটু দূরে গিয়ে হাঁচি দেওয়া যায় কিংবা নিদেনপক্ষে মুখটা ঢেকে রেখে হাঁচি দেওয়া যায়। এতে করে এড়িয়ে চলা যায় অনেক বিব্রতকর পরিস্থিতি। 

অনেকে কোন অফিসে বা বাসাতেই বসতে গিয়ে চেয়ার টানেন শব্দ করে যা অন্যের জন্য বিরক্তিকর।অনেকে দরজা লাগানোর সময় প্রচন্ড শব্দ করেন,খাওয়ার সময় চপচপ শব্দ করে খাবার খান,ঘর থেকে বের হওয়ার সময় লাইট ফ্যান অফ করতে ভুলে যান কিংবা ব্রাশ করেন পানির কল ছেড়ে দিয়ে।এই সবগুলোই প্রচন্ডরকমের বদ অভ্যাস।

বাইক চালানোর সময় অন্য একজনের সাথে পাল্লা দিয়ে বাইক চালানো কিংবা ফুট ওভারব্রীজ থাকতেও ব্যস্ত রাস্তা দিয়ে পারাপার হওয়াটা যেমন জীবনকে ঝুকির মধ্যে ফেলে দেয় তেমনি এগুলো এক ধরনের বাজে অভ্যাস। আমাদের আরেকটা বিব্রতকর বদ অভ্যাস হচ্ছে নাক খুটানো।অফিসে কিংবা মিটিংয়ে, বেড রূমে কিংবা রাস্তায়,বিমানে কিংবা বাসে আমাদের এই অভ্যাস চলতেই থাকে। আমরা নাক খুটাই,নাকের ময়লা সামনের সিটের পিছনের দিকে লাগিয়ে রাখি।যা প্রচন্ড রকমের অসাস্থ্যকর এবং বিব্রতকর।

কাউকে ফোন করে পাওয়া না গেলে বা কেউ ফোনে ওয়েটিং থাকলে আমরা পরপর ফোন দিতেই থাকি,দিতেই থাকি।অপর প্রান্তে থাকা ব্যাক্তি কোন কাজে ব্যস্ত থাকতে পারেন বা ফোন ধরার মতো পরিস্থিতিতে নাও থাকতে পারেন এটা অনেকেই অনুধাবন করি না যা উভয়ের জন্যই বিব্রতকর এবং একধরনের বদ অভ্যাস। 

ফাস্টফুড জিনিসটাই লোভনীয়। কিন্তু নিয়মিত ফাস্টফুড খেলে এর খারাপ প্রভাব আপনার শরীরে পরবেই। তাই ফাস্টফুড হোক কোন উপলক্ষ্যকে উদযাপনের অংশ,এটা কে অভ্যাসে পরিনত করলে সেটা বদ অভ্যাসই হবে। অতিরিক্ত টেলিভিশন দেখা, সোশ্যাল মিডিয়াতে অপ্রয়োজনে সময় নষ্ট করা,অনুমতি না নিয়ে ফেসবুকে অপরিচিত কাউকে কল করা,অপ্রয়োজনে রাত জাগা কিংবা সবসময় কানে হেডফোন গুজে রাখাও বদঅভ্যাস। এতে শরীরের যেমন ক্ষতি হয় তেমনি আশেপাশের মানুষজনও বিরক্ত হয়।

এমন আরও অনেক বদ অভ্যাস রয়েছে যেগুলো প্রাথমিক অবস্থায় সহজেই আমরা ত্যাগ করতে পারি। কিন্তু দীর্ঘ দিনের বদ অভ্যাস ত্যাগ করা আসলেই কঠিন।এর জন্য প্রয়োজন প্রবল ইচ্ছা শক্তি। বদ অভ্যাস ত্যাগ করার জন্য প্রথমেই নিজেকে নির্ধারণ করতে হবে যে নিজের ভিতর কী কী বদ অভ্যাস আছে।এই ক্ষেত্রে খুব কাছের মানুষদের সাহায্যও নেওয়া যায়। নিজের ভিতর একাধিক খারাপ অভ্যাস থাকলে একটা একটা করে ত্যাগ করতে হবে,এক সাথে শুদ্ধ হতে গেলে সবকিছুই ভেস্তে যাবে। নির্ধারিত অভ্যাসটি ত্যাগের জন্য নিজেকে সংকল্পবদ্ধ হতে হবে,নিজেকে সময় বেধে দিতে হবে।অনেক ক্ষেত্রে একটি বদ অভ্যাস ত্যাগের জন্য দীর্ঘ সময় লেগে যেতে পারে,এতে ধৈর্য্যহারা হওয়া যাবে না।বদ অভ্যাসের ব্যাপারে সচেতন থাকলে ধীরে ধীরে তা থেকে বেরিয়ে আসা যাবে। নিজের এই কৃতিত্বের জন্য নিজেকে ধন্যবাদ দিয়ে পরবর্তী বদ অভ্যাস ত্যাগের জন্য নিজেকে তৈরি করতে হবে।

বদ অভ্যাস আমাদের কে পারিবারিক কিংবা সামাজিক সব ক্ষেত্রেই অনেক বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখোমুখি করে দেয়।আর আমাদের নিজেদের ইচ্ছাশক্তি প্রয়োগেই আমরা এই বিব্রতকর পরিস্থিতি এড়িয়ে যেতে পারি।

Leave a Comment