প্যারিসকে ভালোবাসার শহর কেন বলা হয়?

  • ইয়াসিন প্রধান সাজিদ 
  • এপ্রিল ৩, ২০১৮

"প্যারিস",তিন অক্ষরের একটি ছোট শব্দ। তবে এর মাঝেই লুকিয়ে আছে সীমাহীন ভালোবাসা, হাজারো অনুভূতি, শত শত স্বপ্ন পূরন করার ক্ষমতা। সব গুনাগুন মিলিয়ে প্যারিসকে "ভালোবাসার শহর" হিসেবে গন্য করা হয়।

ফ্রান্স এর রাজধানী প্যারিস। এটি উত্তর ফ্রান্সের "ইল দ্যা ফ্রস" অঞ্চলের প্রানকেন্দ্রে অবস্থিত "সেন" নদির তীরে অবস্থিত। প্যারিসের আয়তন ১০৫ বর্গ কিলোমিটার। ফ্রান্স এর জনসংখ্যার প্রায় ১৮ শতাংশ (২২ লক্ষ) বাস করে এই শহরে। প্যারিস কে কেন্দ্র করে অবিচ্ছিন্নভাবে গড়ে উঠে সু-বৃহৎ প্যারিসের "নগর এলাকা",যার জনসংখ্যা ১কোটি। এই নগর এলাকা এবং প্যারিস কেন্দ্রিক উপ-শহরগুলো মিলে গঠিত হয় "প্যারিস মেট্রোপলিটান" এলাকা, যার জনসংখ্যা ১কোটি ২০ লক্ষ।

প্যারিসের এই মেট্রোপলিটান এলাকা ইউরোপের মেট্রোপলিটান এলাকাগুলোর মধ্যে অন্যতম। বিশ্বের অন্যতম বাণিজ্যিক ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র হিসেবে দুই হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে এই নগর এলাকাটি অধিকারী হয়ে আছে। সর্বোধিক থেকে প্যারিসের প্রভাব ও গুরুত্ত এটিকে বিশ্বনগরীর মর্যাদা দিয়েছে। "ইল দ্যা ফ্রস" বা প্যারিস অঞ্চল ফ্রান্সের অর্থনীতির কর্মকান্ডের প্রানকেন্দ্র। প্যারিসের "লা দেফস" ইউরোপের বৃহত্তম পরিকল্পিত বাণিজ্যিক এলাকা। এখানে ফ্রান্সের প্রধান প্রধান কোম্পানিরগুলোর প্রায় অর্ধেক সংখ্যকের সদর দপ্তর অবস্থিত।

বিশ্বের বৃহত্তম ১০০টি কোম্পানীর ১৫টির সদর দপ্তরের অবস্থান এই প্যারিসেই। এছাড়াও প্যারিসেই অনেক আন্তর্জাতিক সংস্থার সদর দপ্তর রয়েছে। এদের মধ্যে আছে:ইউনেস্কো,ওইসিডি,ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার অব কমার্স, আরও অনেক রয়েছে। ফ্রান্স একটি উন্নত দেশ, আর প্যারিস এই উন্নতির উপর অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। শহরটির অনেক উল্লেখযোগ্য দর্শনীয় স্থানসমূহের মধ্যে রয়েছে: আইফেল টাওয়ার, শজেলিকে সড়ক, নোত্র দাম গির্জা, লেজাভালিদ, পন্তেও, পালে গার্নিয়ে, লুভ্যর জাদুঘর ইত্যাদি। এই সকল স্থান গুলি প্যারিসকে করে তুলেছে অত্যন্ত আকর্ষনীয় ও ভালোবাসাময়।

পৃথীবিতে সবচেয়ে ভালোবাসাময় ও রোমান্টিক শহর কোনটি? এই প্রশ্নের উত্তরে কোনো দ্বিধা ছাড়াই বলা যায় উত্তরটি প্যারিস। সর্বপ্রকার মানুশ মেনে নিবেন এই প্যারিসকে। প্যারিসকে আবার বলা হয় কৃষ্টি ও সংস্কৃতির মিশ্র পরিবেশ।এই নগরিকে দেখেছে কিন্তু প্রেমে পরেনি এমন মানুষ পাওয়াটা অসাধ্যের কাজ। প্যারিসের মতো গোছানো শহর অদ্বীতিয়। তাই পৃথীবির সবচেয়ে রোমান্টিক শহর বলা হয় প্যারিসকে। এই প্যারিস কারো কাছে "আলোর শহর" আবার কারো কাছে "ভালোবাসার শহর"। পর্যটকদের কাছে এই ভালোবাসার শহরটি সবচেয়ে প্রিয়। বিশ্বের সবচেয়ে বেশি সংখ্যক পর্যটকদের গন্তব্যস্থল হলো প্যারিস।

প্রতি বছর প্রায় ৮৪ মিলিয়ন বিদেশী পর্যটক বেড়াতে আসে এই প্যারিস-এ। এরা প্রত্ত্যেকেই ভালোবাসার পিপাসু, তারা প্যারিসে আসে শুধুমাত্র ভালোবাসার খোজে। প্যারিসে গিয়ে প্রথমাবস্থায় সবাই যা দেখে অবাক হয় সেটি হলো রেলস্টেশন, এয়ারপোর্ট, ও স্ট্রিট পিয়ানোর সমাহার। সেখানে সবাই নিজের ইচ্ছে মতো পিয়ানো বাজাতে পারে। এই প্রজেক্টের নাম "Play me, I'm yours". ভালোবাসার আকর্ষনে পিয়ানো গুলো হাত বাড়িয়ে ডাকতে থাকে, পিয়ানোর গায়ে হাত বুলিয়ে দেওয়ার জন্য। প্যারিসের প্রতীক "আইফেল টাওয়ার" থেকে চোখ সরালেই চোখ পরে রুপকথার মোনালিসার "লু্ভ্য মিউজিয়ামের উপর। ফ্রেঞ্চ স্থাপত্যকলার অনন্য নিদর্শন"নটর ডেম ক্যাথেড্রাল"।

নেপোলিয়নের বিজয়োল্লাস খচিত তোরন"আর্ক ডে ট্রেম্ফে"সহ আরো ঐতিহাসিক গুরুত্ববাহী স্থান দেখতে পাওয়া যায় এই ভালোবাসার শহরে। তবে দর্শকগণ "স্টেচু অব লিবার্টি" দেখার পরই সবচেয়ে বেশি অবাক হয়। এটি স্থাপিত হয় ১৮৮৯ সালে, এটি স্থাপিত হয়েছে প্যারিসের বুক দিয়ে বয়ে যাওয়া সিন নদীতে তৈরী একটি কৃত্রিম দ্বীপে। বিশ্বের শীর্ষ পর্যটক গন্তব্য হিসেবে প্যারিসের এই ঐতিহাসিক সবস্থানগুলো পরিণত হয়েছে। এখন ইতিহাস বিখ্যাত এই প্যারিস হয়ে উঠেছে আলোকিত ঝলমলে এক ভালোবাসার শহর।

প্যারিসকে ভালোবাসার শহর বলার আরেক অনন্য কারণ হলো: 'সিন নদীর উপর স্থাপিত ৩৭টি ব্রিজের মধ্যে পায়ে হাটার জন্য নির্ধারিত কিছু সুন্দর ব্রিজের রেলিংয়ে "লাভ প্যাডলক" নামে বিশেষ তালা দেখা যায়। আসলে প্রেমিক বা প্রেমিকা তাদের একে অপরের নামের প্রথম অক্ষর খচিত করে এই তালাগুলো রেলিংয়ে ঝুলিয়ে চাবিটি সিন নদিতে ফেলে দেয়। প্রেমিক প্রেমিকার ভালোবাসা প্রকাশের এই অনন্য রীতি প্যারিসকে ভালোবাসার শহর হিসেবে খ্যাতি দিয়েছে।

প্যারিসের আইফেল টাওয়ার টি তৈরী হয়েছে ১৮ হাজার ৩৮ টি লোহার টুকরো দিয়ে। গড়ে দেখা গেছে প্যারিসের প্রতি ১০ নবদম্পত্তির মধ্যে ৩টি কেই পাওয়া যায় এই টাওয়ার এর সামনে। গড়ে প্রতি ১২ মিনিটে একটি সিনেমার শুটিং চলতেই থাকে প্যারিসের এই স্থানে। প্রতি বছর ৭ মিলিয়ন পর্যটকের পদচারনায় ঝলমলে হশে থাকে আইফেল টাওয়ার এর এলাকা। প্যারিসের কেন্দ্রস্থলেই অবস্থিত ১৩০ মিটার লম্বা, ৪৮ মিটার চওড়া, ৩৫ মিটার উচু নটর ডেম ক্যাথেড্রাল। অন্যদিকে প্যারিসকে আবার মিউজিয়ামের শহর ও বলা হয়ে থাকে।

কেননা, প্যারিসে মোট ১৭৩ টি মিউজিয়াম অবস্থিত। তবে এর মাঝে সবচেয়ে বিখ্যাত হলো ল্যুভর মিউজিয়াম, কারন এখানে সংরক্ষিত আছে, "লিউনার্দ দ্যা ভিঞ্চির অমর কীর্তি","মোনালিসা"। তাছাড়াও, এখানে আরও বিশ্ববিখ্যাত অমর ৩,৮০,০০০ টি কীর্তি। আর এই এতকিছুর কারণেই সৌন্দর্য পিপাসুরা ছুটে যায় প্যারিসে। ল্যুভর প্রত্ত্যেকটি শিল্পকর্মে যদি ৫ সেকেন্ড করেও সময় দেওয়া হয়, তবে সব দেখতে একজন সাধারন মানুষের প্রয়োজন হবে ১০০ দিন। এই আকর্ষনের কারনেই প্যারিস আজ মানুষের সবচেয়ে বড় চাহিদা হয়ে উঠেছে।

ফ্যাশনের দিক থেকেও প্যারিস কম যায়না! ১৮০০ সাল থেকেই সৌন্দর্যসচেতন মিলনমেলায় প্যারিস পরিণত হয়েছে। আর এটি এখন বিশ্বের "ফ্যাশন রাজধানী" নামে পরিচিত। পৃথীবির সব নামীদামি পারফিউম আর ব্রান্ড প্যারিসেই অবস্থিত। আশ্চর্য ও বিখ্যাত সব রেস্টুরেন্টগুলোও প্যারিসেই!!! ভূমি থেকে ৪০০ ফিট উপরে, আইফেল টাওয়ারে বসে প্যারিসের সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য আছে "লা জুন ভার্ন" রেস্টুরেন্ট।

আজকাল অনেক মানুষ তার সমাজ, পরিবেশের উপর বিরক্ত হয়ে শান্তির জন্য একটি জায়গা খুজে। প্যারিস-ই সেই জায়গা। ইতিহাস ঘাটাঘাটি করলে দেখা যায় যে, প্যারিসেই রচিত হয়েছে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তিসূচক শান্তিচুক্তি। আর এটি " প্যারিস পিস কনফারেন্স"নামে অভিহিত করা হয়। এই কনাফারেন্সেই স্বাক্ষর করেছিল "ভার্সাই চুক্তি"। "লিগ অব নেশনস" এর ধারনাও বেড়িয়ে আসে এই পিস কনফারেন্স থেকে। এই শান্তির চাদরে ঢেকে থাকা প্যারিসে বেড়াতে আসা প্রতিটি বিদেশী তাদের সর্বপ্রকার চাহিদা মিটাতে সক্ষম হয়। শত-সহস্র বছরের পুরোনো এই রুপকথার নগরী প্যারিস তার "আইফেল টাওয়ার","ল্যুভ মিউজিয়াম" সহ শত শত কীর্তি দিয়ে সর্বদা হাত বাড়িয়ে ডাকে সারা বিশ্বের ভালোবাসা এবং সৌন্দর্য পিপাসুদের।

প্যারিসের এমন আরও অনেক অনেক গুনাগুন রয়েছে যার জন্য তাকে ভালোবাসার শহর বলা হয়। সারা বিশ্বের মধ্যে এটি-ই একমাত্র শহর যার উপর পৃথীবির সকল মানুষের আকর্ষন রয়েছে। আর প্যারিস ই সব পিপাসু পর্যটকদের সকল রকম চাহিদা মিটাতে প্রস্তুত। প্যারিস "ভালোবাসার শহর", এটি যেমন একটি নাম, এমন আরও অনেক নাম সে তার গুন দ্বারা অর্জন করেছে। তাই যখনই একটি সর্বগুনে গুনান্বিত স্থান এর নাম খোঁজা করা হয়, তার ফলাফল হয় একমাত্র "প্যারিস"।

Leave a Comment