ওরা বুলিতে বাঁচবে, গালিতে নয়!

  • রোমানা আক্তার 
  • মার্চ ১৫, ২০১৮

যে নারী তার ওইটুকুন একটা পেটে আস্ত একটা জীবন্ত প্রাণী ধরে রাখতে পারে, সঠিক সময়ে তার বিশেষ অঙ্গ দিয়ে তাকে দুনিয়ার মুখ দেখাতে পারে, আদর ভালোবাসা দিয়ে বড় করতে পারে সে নারীর কাছে প্লেন, রকেট, জাহাজ, স্টিমার চালানো জাস্ট ওয়ান টুর ব্যাপার। শুধু সুযোগ সুবিধা পেলেই হয়। আমাদের পৃথুলারতো শারীরিক কোন অক্ষমতা ছিল না। কিন্তু বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে পাইলট হওয়াটা তার জন্য কোন ওয়ান টুর ব্যাপারো ছিল না। পুরুষতান্ত্রিক সমাজের বেড়াজাল ছিড়ে অনেক কাঠ কয়লা পুড়িয়েই সে পাইলট হয়েছে। যারা তাকে পাইলটের লাইসেন্স দিয়েছে তারা জানে, বাংলাদেশে কিছু দাচোয়া মানুষ আছে, যারা কথায় কথায় নারীকে দুচে দেয়। সো, পৃথুলাকে কোন ভাবেই অদক্ষ পাইলট বলার সুযোগ নেই।

পৃথুলার মত অন্য এক নারী পাইলটের সাথে ব্যক্তিগত আলাপে বিমান চালাতে কি লাগে প্রশ্নের উত্তরে বলেছিল, কনফিডেন্স, কনসানট্রেশন আর হাত পা সচল রাখতে হয়। ওদিকে জেসিকা কক্স নামের আমেরিকান পাইলট, যিনি কিনা বিশ্বের প্রথম পা দিয়ে প্লেন চালানো লাইসেন্সধারী পাইলট হিসেবে পরিচিত তিনিতো আমাদের দেশি পাইলট আপার কথা ভুল প্রমাণ করে দিলেন। হাত পা যদি সচল রাখা জরুরি হয় তাইলে জেসিকা কিভাবে পাইলট হল? তিনিতো জন্মই নিয়েছিলেন দুটো হাত ছাড়া। আমি দেশি পাইলট আপাকে দোষ দেইনা। কেননা, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে প্রতিবন্ধী হয়ে পাইলট হওয়া দূর থাক পাশের বাসার খালাম্মার সাথে কথা বলার চান্স পেতেও এপোয়েন্টমেন্ট লাগে।

ওদিকে আবার স্টিফেন হকিং মারা গেছেন। ফেসবুকে একজনকে দেখলাম "হকিন্স প্রেশার কুকারের প্রতিষ্ঠাতা স্টিফেন হকিং আর নেই" লিখে শোক প্রকাশ করেছেন। হায় কপাল! এই হল আমাদের জ্ঞান, যেই জ্ঞান নিয়ে আমরা পৃথুলার মত সাহসী পাইলটকে গালি দেই, স্টিফেন হকিং এর মত পদার্থবিদকে প্রেশার কুকারে বসিয়ে ঘুটা দেই।

জেসিকা কক্স যদি বাংলাদেশে জন্ম নিতো পাইলট না, পাগল হয়ে ঘরের কোণে বসে থাকতো। সকাল, বিকাল মায়ের চোখ ভিজে যেতো মেয়ের দিকে তাকিয়ে। আর হকিং যদি এই দেশের ছেলে হত, তাহলে মাত্র একুশ বছর বয়সে  যখন তার দুরারোগ্য রোগ এমিওট্রফিক ল্যাটারাল স্ক্লেরোসিস ধরা পরে ওই সময়েই হুজুর ডেকে, তওবা কলেমা পড়িয়ে, সবার থেকে মাফ টাফ চাইয়ে মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত করে দিত। তাকে বুঝিয়ে দিত, ইহকালের কেউ তোমার উপরে দাবি রাখে নাই, তুমি এইবার নিশ্চিন্তে পরকালে যেতে পার। তাও ধরেন হকিং নিজের মানসিক শক্তি দিয়ে রোগ বালাই পাত্তা না দিয়ে ডাক্তারের নির্ধারিত আয়ু ২-৫ বছর ছাড়িয়ে পঞ্চাশ বছর হুইল চেয়ারে বসে গবেষণা নিয়ে নিজেকে ধরে রাখলো। কিন্তু ১৯৮৫ সালে যখন তার সিভিয়ার নিউমোনিয়া হয়ে স্বাভাবিক ব্রিদ করার ক্ষমতা হারালো সেই সময় তাকে টিউব দিয়ে নিশ্বাস নেওয়ানো কিংবা ভয়েস সিন্থেসাইজার দিয়ে কথা বলানোর চেষ্টাতো দূর থাক, উলটো চৌদ্দগুষ্ঠি মিলে উনার মৃত্যু কামনা করতে করতে আল্লাহ রে পারতোনা আসমান থেকে মাটিতে নামিয়ে নিয়ে আসত। কারন, হকিং তখন সম্পদ না, সবার চোখে বিপদ আপদ হিসেবে ধরা দিত। আর, আপদ যত দ্রুত বিদায় হয় ততোই ভাল।

আমরা না পারি নিজেকে গড়ে তুলতে, না পারি অন্যকে গড়তে সাহায্য করতে। সাহায্য দূর থাক ন্যুনতম গর্ববোধটাও আমরা করিনা। আর সে কারণেই, আমাদের দেশের আবাল, অপদার্থ, আকাইম্মা, কানা, লুলা, আতুর পোলাপানগুলো বিদেশের মাটিতে পা দেয়া মাত্রই হয়ে উঠে সম্পদ। সেখানে গিয়ে সম্পদ হয়েও তাদের রক্ষা নেই। এখানে তাদের নামে বদনাম রটে, "দেশের মাটিতে ভাত পায়না, বিদেশে গিয়ে মেথরগিরি করে"। বিদেশে যেই কাজেই যাক, আমাদের ধারণা রাস্তা ঝাড়ু দিতে গিয়েছে। আমরা আসলে কি পারি? কথা পারি। আকথা, কুকথা, হিংসাত্মক কথা, আক্রমণাত্মক কথা। কেন পারি? কারণ যে কিছু পারেনা সে কথাই বলে। কথা ছাড়া আর কোন কাজ তো নাই। কথা বলবেনাতো কি করবে? আমরা বুলিতে নয়, গালিতেই বাঁচিয়ে রাখতে পছন্দ করি এক একটি খসে যাওয়া ঝলমলে তারাকে। পৃথুলাকেই দেখেন না, নেপালিরা বলল বীর নারী। আমরা বললাম, চু*ত*মা*নি। এখানেই আমরা সারা দুনিয়া থেকে আলাদা। পৃথুলারা বেঁচে থাকুক বুলিতে। আর অধমেরা বাঁচুক গালিতে। 
 

Leave a Comment