রাতে বাহিরে থাকার সাথে ভালো মেয়ে, খারাপ মেয়ের কি সম্পর্ক? 

  • ফারজানা আক্তার 
  • অক্টোবর ২৫, ২০১৮

আমার বাবা মায়ের দুই মেয়ে, যার অর্থ আমরা দুই বোন। দুই বোনের পর আমাদের একটি ছোট ভাইও আছে। আমি কখনো আমার বাবা মাকে দেখি নি পর পর দুই মেয়ে হওয়াতে আফসোস করতে। আমি আমার বাবা মাকে দেখি নি দুই মেয়ের থেকে একমাত্র ছেলের যত্ন বেশি নিতে। তাদের চোখে সন্তানের জন্য ভালোবাসা দেখেছি, ছেলে মেয়ের আলাদা কোন অর্থ কখনো দেখি নি। 

মেয়ে হয়ে জন্মাবার জন্য পরিবার থেকে তেমন কোন আফসোসের কথা শুনি না। তবে সমাজ আমাকে ছাড়ে নি।  বারবার চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে আমি মেয়ে। আমার অনেক কিছু বলতে এবং করতে মানা। ছোটবেলার দিকে যাবো না। চাকরি জীবনের দুই একটা ঘটনা বলি। 

আমি একজন ওয়েব ডেভেলপার। যেখানে ইন্টার্নি করেছিলাম সেখানেই প্রথম জব পেয়েছিলাম আমি। আমি যেখানে ইন্টার্নি করেছিলাম সেখানে কোন মেয়ে ছিলো না এবং যতদিন সেখানে জব করেছি আমি একাই ছিলাম। সত্যি বলতে প্রথম প্রথম অফিসে আমি নিজেও ভয়ে থাকতাম।  চারপাশে মেয়েদের হ্যারাজমেন্ট নিয়ে কত কথা শুনি। তাছাড়া পুরো অফিসে আমি একমাত্র মেয়ে, নিজেই কেমন ভয়ে চুপসে থাকতাম। অফিসের বস এবং কলিগ তারা শুরু থেকেই অনেক ফ্রেন্ডলি ছিলো। আমি ইজি হতে পারছিলাম না এই বিষয়টা তারা বুঝতে পেরেছিল। তারা অফিসের পরিবেশটাকে পুরো পারিবারিক করে দিলো। তখন আমি হোস্টেলে থাকতাম। কয়েকদিন পর থেকে মনে হলো আমি হোস্টেল থেকে আমার অফিসে সবথেকে বেশি নিরাপদ। 

ইন্টার্নি করে ফেললাম। ইন্টার্নির রেজাল্ট খুব ভালো হলো।  অফিস থেকে একটা প্রোজেক্ট দিয়ে বললো সেটা কমপ্লিট করতে পারলে আমার জব কনফার্ম। ইন্টার্নির পর আমার জব পেতে দুই মাস সময় লাগলো। জব পাওয়ার পর আমি খুশী, অফিস খুশি কিন্তু হোস্টেলে কানাকানি শুরু হয়ে গেলো। হোস্টেলে কানাকানি শুরু হয়ে গেলো এতদিন ধরে আমি এতো ছেলেদের সাথে কাজ করছি। কোন ছেলে আমাকে কিছু বলছে না, ইন্টার্নির পর চাকরি হয়ে গেলো। সব কি এমনি এমনি হয়! নিশ্চয় কিছু তো একটা আছে!

ব্যাপারটা এমন ছেলে মানেই ইভটিজার হবে, ছেলে মানেই ধর্ষক হবে আর মেয়ে মানেই চরিত্রহীন হবে।  আমি আমার ইন্টার্নি লাইফে কি পরিশ্রম করেছি সেটা আমি জানি, আমার আগের অফিস জানে , আগের কলিগরা জানে। আমার পরিশ্রম, আমার মেধা জিরো হয়ে গেলো কারণ আমি মেয়ে। আমি মেয়ে বলেই আমার হোস্টেলের মেয়েরা চরিত্রে সহজে দাগ লাগিয়ে দিতে পারলো। আমাদের মানসিকতা এভাবে তৈরী হয়ে গেছে ছেলে মেয়ে একসাথে কাজ করা মানেই তাদের মধ্যে শারীরিক কিছু হবে এবং মেয়েরা যত বেশি চরিত্রহীন হবে তত উপরে উঠতে পারবে। 

আমার দ্বিতীয় অফিসে, তিনদিন আমার ডিউটি ছিলো দুপুর ২টা থেকে রাত ১০টা, আর তিনদিন সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৫টা। যেদিন রাতে ডিউটি থাকতো সেদিন আমার এক কলিগ আমাকে কিছুটা এগিয়ে দিতো। আমার সেই কলিগ আমার থেকে ৩বছরের জুনিয়র ছিলো। সেখানেও প্রব্লেম।  যেদিন রাতে ডিউটি থাকতো সেদিন আমার হোস্টেলে ফিরতে প্রায় রাত সাড়ে ১০টা বেজে যেত। আবার শুরু হলো কানাকানি! কলিগ কি এমনি এমনি আমাকে এগিয়ে দেয় নিশ্চয় কোন কারণ আছে! রাত ১০.৩০টায় বাসায় ফিরি নিশ্চয় বাহিরে কিছু আকাম কুকাম করে আসি!

আমার এক কপাল! তৃতীয় অফিসেও আমি একমাত্র মেয়ে। তবে বর্তমানে আমার সাথে আরেকটি মেয়ে আছে। মেয়ে বলে আমি কখনো এক্সট্রা সুবিধা নেই নি। অফিস আমার কাজের ডেডিকেশন দেখে আমাকে অনেক সুবিধা দিয়েছে। আমি প্রতিদিন সাভার থেকে বাড্ডা অফিস করেছি , এবং এখনো করি(এখন প্রতিদিন অফিস করতে হয় না )। আমি ফ্লিড ওয়ার্কে যাই। সংসারের প্রতিটা কাজ নিজ হাতে করি। অফিসে, ফ্লিডে যতটুকু কাজ করি অনেক ছেলে তার অর্ধেকও করে না। কিন্তু একটা ছেলে যখন সফলতা পায় সবাই বলে পরিশ্রম করে পেয়েছে, আর একটা মেয়ে যখন সফলতা পায় সবাই বলে বসের সাথে সম্পর্ক রয়েছে। 

এই সমাজে মেয়ে হওয়ায় অভিশপ্ত। গত ২২ অক্টোবর দিবাগত রাতে একটা মেয়েকে রাস্তার চেকপোস্টে থামিয়ে যেভাবে হয়রানি করা হলো সেটা দেখে আমি হতবাক। পুলিশ মেয়েকে জিজ্ঞেস করে রাত আড়াইটায় কোন ভদ্র মেয়ে বাসার বাহিরে থাকে কিনা! আচ্ছা রাত আড়াইটায় কোন মেয়ের বাহিরে কাজ থাকতে পারে না? রাতে বাহিরে থাকার সাথে ভালো মেয়ে, খারাপ মেয়ের কি সম্পর্ক? 

একজন অশিক্ষিত মানুষ এই কথা বললেও মনকে কিছুটা বুঝানো যায়। কিন্তু আমাদের রক্ষাকর্তারা যখন এই কথা বলেন তখন আসলে শংকিত হওয়া ছাড়া আমি আর উপায় দেখছি না। কত সহজে একটি মেয়ের চরিত্র এই সমাজ নির্ধারণ করে দেয়।  কত সহজে!!! সেদিন রাতের সেই মেয়ের কেউ অসুস্থ থাকতে পারে! হয়তো কোন কাজে আটকে গিয়েছিলো তাই ফিরতে রাত হয়েছে! ইত্যাদি কত কারণ থাকতে পারে। আর ধরেই নিলাম কোন কারণ ছাড়া মেয়েটি এমনি রাতের ঢাকা দেখতে বের হয়েছিলো। তো হয়েছেটা কি? একটি মেয়ে যদি নিরাপদে এই শহর দাঁপিয়ে বেড়াতে না পারে তাহলে তার দ্বায়ভার কার, হে সমাজ!


 

Leave a Comment