শাশুড়ি - বৌমার সম্পর্ক যদি মা - মেয়ের সম্পর্ক হয়! 

  • কামরুন নাহার স্মৃতি
  • মার্চ ১৮, ২০১৯

শাশুড়ি - বৌমার সম্পর্ক যদি হয় মা - মেয়ের সম্পর্ক হয় তাহলেও কি রোজ পোহাতে হতো একই অশান্তির ঝড়? সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ে বয়স আর বয়সের সাথে সাথে বৃদ্ধি পায় বার্ধক্যের ভার। মরিয়ম বেওয়া তেমনই একজন মানুষ, হাঁটা - চলা, কাজ কর্ম করতে যিনি একেবারেই অপারগ। এক ছেলে আর এক মেয়ের ছোট্ট আনন্দ বেদনার সংসার এখন তার মুখে শুধুই গল্প। এখন সংসারটা ছেলের বউয়ের দখলে, ক্ষুধা লাগলে অনেক হাঁক ডাকে খেতে পান তিনি। 

- বউমা, খিধা লাগছে। ভাত দাও একটু....

-ভাত হওন লাগবো তো নাকি! সারাদিন খালি খাই খাই.... 

মরিয়ম বেওয়া আর কিছু বলার মতো পায় না। যে ছেলের জন্য নিজের সবটা বিসর্জন দিয়েছে অথচ সেই ছেলের বউয়ের কাছে তিনি মূল্যহীন। মেয়েটার বিয়ে হয়ে গেছে, নতুন সংসার হয়েছে। প্রতিটা মুহূর্তে খোঁজ নেয়ার মতো সময় তার কোথায়!  চলা ফেরা ঠিকমতো করতে পারেনা বলে শুয়ে বসে তিনি বলেন তার অতীতের গল্প। যে গল্পগুলো বলতে আজও তার ঠোঁটের কোনে হাঁসি ফুটে উঠে। সম্পর্কগুলো কখনো পুরাতন হয় না কিংবা পুরাতন হয় না ভালোবাসার বাঁধন।  মরিয়ম বেওয়া যখন খুব ছোট্টটি ছিলেন তখন চিৎকার - চেঁচামেচি, ছটফটানি গ্রামটাকে মুখর করে রাখত। মাত্র ১২বছর বয়সে নতুন সংসারে পা দিয়েছিলেন তিনি অথচ তখন তিনি সংসার কি জানতেন ও না কিংবা জানতেন না সংসার কিভাবে সামলাতে হয়! পুতুল বর - বউ সাজিয়ে খেলাচ্ছলে বিয়ে দেয়া ছোট্ট মেয়েটা একসময় পুতুলখেলার মতো বিয়ের সত্যিকার খেলায় খেলতে থাকে। 

যার কাছে বিয়েটা নিছক পুতুল খেলাই ছিল। ছোট্ট মেয়েটা সত্যিকারের খেলায় এসে হারিয়ে ফেলে নিজেকে, হারিয়ে ফেলে পাখির মতো উড়ার ডানাটাই!  যখন ইচ্ছে তখন পারেনা নিজের মতো ছুটতে কিংবা ইচ্ছে হলেই নদীর স্রোতে গা এলিয়ে দিতে। সংসারের নাকপাশ ছিড়ে পারেনি বেরিয়ে এসে স্বস্তির নিঃশ্বাস নিতে। গ্রামের সেই মাটির পথে ছুটেবেড়ানো মেয়েটা আর ছোটেনি, শান্ত ভাবে ধীরে ধীরে পেরিয়ে এসেছে মাটির রাস্তা। কোকিলের সাথে গলা মেলানো মেয়েটা আর গলা মেলায় নি কোকিলের ডাকে। কথায় কথায় হেসে ওঠা মেয়েটা শান্তভাবেই পাড়ি দিয়েছে সমস্তটা। একটুতেই বায়না, আবদার করা মেয়েটা নিজের বায়না, আবদারের কথা ভুলে গিয়ে ; অন্যের বায়না, আবদার পূরনে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। সংসার নামক খেলাটা খেলতে খেলতে একসময় সেই ছোট্ট মেয়েটি হয়ে উঠেছে সংসারী। আগলে রেখেছে সংসারের ভীতগুলি। সংসার সামলাতে সামলাতে একসময় ছিড়ে ফেলেছে অতীতের সমস্ত পিছুটান। সেই ছোট্ট মেয়েটা তার হাতে আগলে ধরেছে সংসারের হাল। মরিয়ম বেওয়ার সেই স্বপ্নগুলো আজ শুধুই গল্প। বিয়ের সময় পরিবারের সবাই তাকে বুঝিয়েছে,- মাইয়া মানুষগো সবসময় সবকিছু মাথা নিচু করে মেনে নিতে হয়, বায়না করা চলে না।

সব কথা শুনে এসেছেন মরিয়ম বেওয়া মাথা নিচু করেই । নিজের সমস্ত চাওয়া পাওয়া বিসর্জন দিয়ে বিলিয়ে দিয়েছে নিজেকে। জীবন পথে চলতে গিয়ে তিনি স্বামী সংসার সবকিছুই সামলে নিয়েছেন অথচ সময়ের ব্যবধানে, বার্ধক্যের ভারে সেই সংসারেই তিনি এখন জঞ্জাল, আবর্জনা ভরা স্তুপ। যেই সংসারের জন্য নিজের ছোট্টছোট্ট স্বপ্ন, পাখির মতো ডানা ভেঙে দিয়েছে।  ছোটছোট স্বপ্নগুলো অকালেই ঝড়ে গেছে, আজ সেগুলো শুধুই গল্প। হয়তো এখনও মাঝে মাঝে তিনি হারিয়ে যান তার সেই অতীতে কিংবা অতীতের গল্পের মাঝেই আবার নতুন করে খুঁজে পেতে চান নিজেকে। প্রতিটা মানুষের আলাদা আলাদা গল্প থাকে, আলাদা আলাদা স্বপ্ন আর আলাদা আলাদা রঙে জীবন রাঙানো থাকে। কারো জীবনের গল্প প্রায় সবাই জানে, কারো গল্প লুকিয়ে থাকে সবকিছুর অগোচরে। 

দিনশেষে ছেলের বউয়ের তিক্ত কথা আর ছেলের বিরক্তি যেন তাকে বারবার মৃত্যু ঘটায় নিজের সত্ত্বার। যে সন্তানের জন্য নিজের সবকিছু বিসর্জন দিয়েছে হাসিমুখে সেই সন্তানই নিজের মায়ের খোঁজ নেওয়ার সময়টুকু পায় না। শাশুড়ির সংসারে এতোটুকু কষ্ট পায়নি যে ছেলে বউ, সে ছেলে বউই দিনের পর দিন কষ্ট দিয়ে গেছে শাশুড়ি নামের মানুষটাকে। একটা মেয়েকে বিয়ের আগে থেকেই ধারনা দেয়া হয় শাশুড়িরা ভালো হয় না, সেই ধারনাই জন্ম দেয় শাশুড়ি বউমার বিরোধ। ছেলে বউকে যদি একটা মা তার মেয়ের মত আর ছেলে বউ শাশুড়িকে মায়ের মতো তাহলে রোজকারের এই ভুল ধারনা জন্ম নিতে পারতো না। প্রতিনিয়ত প্রতিটা সংসারে লড়াই হতো না শাশুড়ি বউয়ের।
 

Leave a Comment