ধর্ষণের লাগামহীন ঘোড়া!

  • মারুফ ইমন 
  • মে ২৬, ২০১৯

বছর পনের আগেও বিকেল সাড়ে তিনটার বাংলা সিনেমায় যখনই কোন গোডাউনে বা ঘরে কিংবা জঙ্গলে ভিলেনেরা নায়িকা বা কোন নারীর প্রতি হামলে পড়তেন, তখন আমাদের মুরুব্বিদের দেখতাম কিছুক্ষণ হয় টিভি বন্ধ রাখতেন অথবা বাচ্চাদের চোখ ঢেকে রাখতেন। এর কারণ হল, বাচ্চারা না বুঝলেও অভিভাবকরা ঠিকই বুঝতেন এবার কোন ধর্ষণের দৃশ্য হবে। সিনেমায় সেই ধর্ষণ চোখ বন্ধ করে আড়াল করা যায় নি। আমরা সবাই জানি, ভিলেনের মত দুষ্টলোকেরা প্রতিশোধস্পৃহা বা লালসা মেটাতেন এই ধর্ষণ কার্য সমাধা করেই। তবে, সেক্ষেত্রে ধর্ষিতার বয়সসীমা ছিল অবশ্যই শিশু বা বৃদ্ধার মাঝামাঝি। কারণ, দর্শক বা বাংলা সেন্টিমেন্ট যৌনতার বহিঃপ্রকাশ কখনো বাচ্চা বা বৃদ্ধার মাধ্যমে দেখতে পছন্দ করবেন না। 'পছন্দ’ এই অর্থে বলছি, বাংলা সিনেমায় ধর্ষণদৃশ্য প্রায়শই অবধারিতভাবেই এসেছে আর অশ্লীল যুগে তো এটাই ছিল অন্যতম উপাদান এক শ্রেণীর লোককে হলে টানার জন্য। 

তবে সিনেমা নিয়ে কথা বলতে আসিনি। খুব মানসিক যন্ত্রণা থেকেই বলা যায় এক অবাধ্য লাগামহীন ঘোড়ার কথা বলতে এসেছি। এই ঘোড়া ছুটেই চলেছে তার অভিশপ্ত গতিতে আর তার ক্ষুরের শিকার হচ্ছে শিশু থেকে বৃদ্ধা সবাই।  ধর্ষণের কারন হিসেবে আমরা বারবার যে বিষয়টা এড়িয়ে যাই সেটা হল 'মানসিক যৌন বিকৃতি’। একজন মোটামুটি সুস্থ মানসিকতার কোন লোক প্রথমত কোন নারীকে ধর্ষণের কথা ভাবতেই পারেন না। আর যেসব ধর্ষক এই গর্হিত কাজটি করে তাদের মুখ থেকে বের হয়ে আসে প্রধাণত তিনটি কারন – হয় সে শত্রুতা করে কাজটি করে, সে হয়তো মেয়েটিকে সমাজে হেয় প্রতিপন্ন করতে চায় কিংবা সে সেক্সুয়াল ম্যানিয়াক বা বিকৃত রুচিসম্পন্ন। শিশু বা বৃদ্ধা ধর্ষনের ঘটনাগুলো পত্রিকার পাতায় যেভাবে একের পর আসছে, সেটা লাগামহীন ঘোড়ার গতির চেয়ে কম না। আর এই ঘোড়া বেজায় বিকৃত। আমরা না পারছি থামাতে, না পারছি দেখতে। 

একদম সম্প্রতি ২১ মে টাঙ্গাইলের মধুপুরে শতোর্ধ বৃদ্ধাকে ধর্ষণের ঘটনায় আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে অভিযুক্ত কিশোর। বৃহস্পতিবার বিকেলে সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট সুমন কুমার কর্মকারের আদালতে ৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তি প্রদান করে সে। শুনানি শেষে ওই সোহেলকে আদালতে প্রেরণ করার নির্দেশ দেন আদালত। একই দিন ভুক্তভোগী বৃদ্ধাও ২২ ধারায় আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন। সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট নওরীন মাহমুবা তার জবানবন্দি লিপিবদ্ধ করেন। অভিযুক্ত কিশোর জবানবন্দিতে আদালতকে জানায়, কেউ না থাকার সুযোগে ওই বৃদ্ধাকে সে জোরপূর্বক ধর্ষণ করে। ২২ ধারায় জবানবন্দিতে ভুক্তভোগী বৃদ্ধা আদালতকে বলেন, "ওই ছেলে আমাকে জোরপূর্বক ধর্ষক করেছে। ঘটনার সময় আমি রোজা ছিলাম। আমি রোজা রেখে তার কাছে মাফ চেয়েছিলাম, কিন্তু সে উল্টো আমার উপর পাশবিক নির্যাতন চালায়"।

মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ও মধুপুর থানার উপপরিদর্শক (এসআই) জুবাইদুল হক বলেন, "গ্রেফতার কিশোর দোষ স্বীকার করে আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছে। ভুক্তভোগী বৃদ্ধাও আদালতে ২২ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছেন। পরে জবানবন্দি শেষে আদালতের নির্দেশে ওই কিশোরকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। আমার জানা মতে পৃথিবীতে এতো বৃদ্ধ বয়সে ধর্ষণের শিকার আর কেউ হননি। এটি একটি ন্যাক্কারজনক ঘটনা"। 

আমি বারবার পড়েছি ধর্ষক ছেলেটি তার দাদীর চেয়েও বেশি বয়সের মহিলাকে ধর্ষণ করেছে বাড়িতে কেউ না থাকার সুবাদে। ভাবুন তো রোযাদার বৃদ্ধ মহিলা, বয়স একশোর বেশি, তার উপর বাধা হয়েছে মুখ। তাকে ধর্ষণ করা কতটুকু বিকৃত যৌনাচার! ভাবতেই অবাক লাগছে, সেক্সুয়াল কন্ট্রোলনেস এতটাই নিম্নপর্যায় বা শূন্যে নেমে এসেছে সে এক্ষেত্রে বয়সকে তেমন চোখেই দেখেনি। অনেকটা এমন যে , সুযোগ পেলাম তো রেইপ করলাম, নারী হলেই হল। 

আরেকটি জবানবন্দির কথা বলা যাক। এটিও সাম্প্রতিক ঘটনা। রাজশাহী মহানগরীতে ৬৫ বছর বয়সী এক বৃদ্ধাকে গণধর্ষণের অভিযোগ উঠেছে। ধর্ষণে জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেফতার দুই যুবক তুষার আলী (২০) ও মিশুল হাসান (১৯) আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। রাজশাহীর অতিরিক্ত চীফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) ড. আলমগীর হোসেন তাদের জবানবন্দি ১৬৪ ধারায় রেকর্ড করেন। নগরীর রাজপাড়া থানার ওসি হাফিজুর রহমান বলেন, সোমবার খুব ভোরে তুষার ও শিমুল নগরীর চৈতিরবাগান এলাকার পুকুর পাড়ে যায়। তারা বৃদ্ধ রমজান আলীকে নিজ ঘরের মধ্যে বেঁধে তার সামনেই বৃদ্ধা স্ত্রীকে পালাক্রমে ধর্ষণ করে। অভিযোগ পাওয়ার পরপরই পুলিশ আসামিদের ধরতে ওই এলাকায় অভিযান শুরু করে এবং গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়। 

সমাজে যখন বিকৃত রুচি সৃষ্টির অসংখ্য উপাদান থাকে আর সুস্থ মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্থ হয় তখনই এ ধরনের ম্যানিয়াকের জন্ম হয়। তার আরেকটি বড় উদাহরন -  শিশু ধর্ষণ। কিছু আতকে উঠার মত পরিসংখ্যান দেই। কদিন আগে বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের আয়োজনে ‘শিশু অধিকার সুরক্ষা ও অগ্রগতি শীর্ষক’ সেমিনারে বলা হয়, সাড়ে ৪ মাসে ৩৪৬ শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে এর মধ্যে ৩৮ শিশু গণধর্ষণের শিকার হয়। প্রতিবন্ধী শিশু ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ২২টি এবং ধর্ষণের পর হত্যার ঘটনা ঘটেছে ১৮টি। ১০ শিশু ধর্ষণের শিকার হওয়ার পর আত্মহত্যা করে। এ ছাড়া ৩৮ শিশু ধর্ষণচেষ্টার শিকার হয়েছে। আর গত এক বছরে ৪৩৩টি শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। মারা গেছে ২৮টি শিশু। এছাড়া ধর্ষণ, যৌন নির্যাতন ও শারীরিক নির্যাতনের কারণে মারা গেছে ২৭১টি শিশু। 

এছাড়াও বিভিন্ন ধরণের শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছে আরও ১০০৬ জন। বেসরকারি সংস্থা ‘মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন’-এর এক গবেষণা প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। সংস্থাটির প্রোগ্রাম কো-অর্ডিনেটর রাফিজা শাহীন বলেন, ২০১৮ সালে ধর্ষণের শিকার হওয়া বেশির ভাগ শিশুর বয়স ৭ থেকে ১২ বছর। ১৩ থেকে ১৮ বছর বয়সীরা যৌন নির্যাতনের শিকার হয় বেশি। বিশেষ করে পুরুষ শিক্ষকের হাতে এই ধরণের নির্যাতনের ঘটনা বেশি ঘটে। গত বছর এই সংখ্যা ছিল ১২৯ জন। এদের মধ্যে ১৭ জন ধর্ষণের শিকার হয়েছে। রাফিজা শাহীন বলেন, গত বছরের তুলনায় এবার তিন গুণ বেশি ধর্ষণের ঘটনা ঘটবে বলে মনে হচ্ছে। প্রথম চার মাসেই এক বছরের রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে।

বেশি দূর না, বৃদ্ধা ধর্ষনের আগের দিনই লোমহর্ষক শিশু ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে কক্সবাজারের পেকুয়ায়। অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র এখানে ধর্ষক। ধর্ষিতা মেয়ে শিশুটির পরিবারের ভাষ্য, পেকুয়া সদরের এক ব্যক্তির বাড়িতে গৃহকর্মী হিসেবে থাকত ১২ বছর বয়সী শিশুটি। গতকাল রোববার সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টার দিকে শিশুটিকে একটি ঝোপের মধ্যে নিয়ে ধর্ষণ করে কিশোরটি। পরে স্থানীয় কয়েকজন এগিয়ে গেলে কিশোরটি পালিয়ে যায়। শিশুটি লজ্জায় রাত ১১টার দিকে বিষপানে আত্মহত্যার চেষ্টা করে। বাড়ির মালিক মেয়েটিকে উদ্ধার করে পেকুয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করে। পেকুয়া থানার উপপরিদর্শক (এসআই) কাজী আবদুল মালেক বলেন, শিশুটিকে হাসপাতালে নেওয়ার পর সেদিন সকালে রক্তক্ষরণ শুরু হয়। পরে শিশুটিকে কক্সবাজার সদর হাসপাতালের ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে (ওসিসি) নিয়ে যাওয়া হয়। পেকুয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসা কর্মকর্তা আবদুর রহিম বলেন, রক্তক্ষরণ হলেও শিশুটি এখন আশঙ্কামুক্ত।

শিশুটি বেঁচে গেলেও মরে গেছে আমাদের সামাজিক রুচিবোধ আর ধিক্কারের যোগ্যতা পেয়েছে আমাদের বিকৃত অপরাধের এই সহনশীলতা। ঠান্ডা মাথায় পরিকল্পনা করে শিশু ধর্ষণের ঘটনাও ঘটছে অহরহ। ১৭ মে শুক্রবার দুপুরে শিশুটির বাবা-মায়ের অনুপস্থিতির সুযোগে মো. বাহার (২৫) নামের এক যুবক শিশুটির হাতে ১০ টাকার নোট ধরিয়ে দেন। পরে তাকে কোলে করে বাড়ির পাশের নবনির্মিত খালি দোকান ঘরে নিয়ে ধর্ষণ করেন। খোঁজাখুঁজির একপর্যায়ে শিশুটির মা ওই দোকান ঘরে গিয়ে শিশুটিকে উদ্ধার করেন। এ সময় ওই বখাটে যুবক দৌড়ে পালিয়ে যান। এ ঘটনায় শিশুর মা বাদী হয়ে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে ছাগলনাইয়া থানায় মামলা করেন। পুলিশ রাতেই অভিযান চালিয়ে আসামি বাহারকে গ্রেপ্তার করে।

এন্টিবায়োটিক খেতে খেতে একসময় আমাদের শরীর এন্টিবায়োটিক ওষুধের নিরোধ লাভ করে, তখন সেই ওষুধে আর কাজ করে না। আমাদের অপরাধ সহনশীলতার কারনেই কি এই বিকৃত অপরাধ ঘোড়ার মত ছুটেই চলেছে, সেটা আশু ভেবে দেখা দরকার। নইলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম হয়ে উঠবে অসুস্থ আর রুগ্ন জাতি। 

Leave a Comment